মায়াবী জোছনা

ফারজানা ইসলাম লিনু

সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। আকাশ ভাঙা ভরা জোছনায় আলোকিত ভুবন। জ্যৈষ্ঠের লম্বা দিনের রোজা শেষে ইফতারান্তে একটু বিশ্রাম নিয়েই মা-চাচিরা তারাবীর নামাজও সেরে ফেলেছেন। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত বিদ্যুৎ তো অমাবস্যার চাঁদ। এসময় বিদ্যুতের দেখা মিলতো কস্মিনকালে। তাই তো বিদ্যুতের অপেক্ষা না করে তারাবির নামাজ সেরে ফেলতেন মা চাচিরা। নামাজ শেষে হাত পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে মাঝ উঠানে বসে এক পশলা আড্ডা হত মায়েদের। বাপেরা তখনো তারাবির নামাজে। চারদিকে সুনসান নিরবতা। পুকুরের ওপারের বাঁশবনে জোনাকিরা আপন মনে ঘুরে বেড়ায়। ছায়ারা ভয় দেখিয়ে নড়ে উঠে ক্ষণে ক্ষণে। ঝিঁঝিঁ পোকারা ডেকে চলে অবিরাম। হুরুদাদি বলতেন খিরানি পোঁকা ডাকে, দেশে খরা হবে এবার। মায়েদের চাঁদনি রাতের আড্ডায় সঙ্গী আমরা ডজন খানেক ছানাপোনা। আপনমনে উঠানের চারপাশে ঘুরেঘুরে খেলতে থাকি ।

আমাদের কিলবিলানি মায়েদের গল্পে ব্যাঘাত ঘটায়। মধ্যেম সাইজের ধমক দিয়ে মায়েরা আবারো গল্পে মশগুল হয়ে যান। ঘরের ভেতর থেকে আসে আধা ভাঙা পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণ। আমগাছের উচু ডালটাতে বাদুড় এসে বসে। ডানার ঝাপটায় নড়ে উঠে পাকা আম সমেত ডাল। টপাস করে পড়ে পাকা আম। আম আনতে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। দৌড়ে গিয়ে আমটা ছোঁ মেরে নিয়ে আসে কোন সৌভগ্যবান। আবারো আম পড়ে টপাটপ। আবারও ভোঁ দৌড়। পুকুর পাড়ের আমগাছ, আমগুলো গড়িয়ে মাঝেমাঝে পুকুরে গিয়ে পড়ে। জায়গা দেখে রাখি। পরের দিন গোসলের সময় পা দিয়ে ঠাওর করে করে ডুব দিয়ে তুলবো আম। আম কুড়ানোতে ছেদ পড়ে হঠাৎ।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কানে ভাসে গগনবিদারী চিৎকার আগুন, আগুন, বাঁচাও, বাঁচাও। গ্রামের বাড়িঘরে প্রায়ই আগুন লাগে। কখনো প্রতিবেশীর শত্রুতায় পুড়ে ছাই হয় ছনের ঘর খানা, কখনো বা নিজেদের অসাবধানতায় পুড়ে যায় খড়ের গাদা বা গোয়াল ঘর। আমরা ভেবেছি সে রকম কিছু হবে হয়ত। চিৎকার চেঁচামেচি কিছুটা থেমে থেমে শুনা যায়। জানা যায় না সঠিক ঘটনা, কোথায় আগুন লেগেছে, কার ঘর পুড়েছে। মসজিদের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরা মুসল্লি ও পথিকের কাছ থেকে জানা যায় চেঁচামেচির আসল কারণ। গ্রামের অপর প্রান্তে আগুনে পুড়ে ঝলসানো এক গৃহবধুকে বাঁচানোর জন্য এই আকুতি।

গ্রাম সম্পর্ক ছাড়াও মহিলা ছিলেন আমাদের আত্মীয়া। আম্মা, মতিফুফু ও বড়চাচি আম্মা হারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে রওয়ানা দিলেন ঐ বাড়িতে। কোনকিছু না বুঝেই ত্যাঁদড় ছানাপোনাদের কয়জন পিছু নিলাম মায়েদের। একটু পায়ে হাঁটা পথ মাড়িয়ে বড় মোকামের পাশে বাড়িটা। বাড়ি ভর্তি উৎসুক মানুষ। পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন মহিলা। কেউ কাচা ডিম ভেঙ্গে শরীরে ঢালছেন, কেউ কলা গাছ ছেচে কষ টুকু ছড়িয়ে দিচ্ছেন পুড়ে যাওয়া শরীরে। চলছে আরো নানা প্রাথমিক চিকিৎসা। আম্মা বাধা দেন এসব চিকিৎসায়। স্থানীয় হাসপাতালে এই ধরনের অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসার ন্যুনতম ব্যবস্থা নেই জেনেও আম্মা হাসপাতালে নেওয়ার তাড়া দেন। অন্তত এই অপচিকিৎসা থেকে তো বাঁচানো যাবে মহিলাকে। আম্মার কথায় চিকিৎসাদাত্রী মহিলারা বড়ই বিরক্ত হন। পর পুরুষ ব্যাটা ডাক্তাররা শরীরে ঔষধ লাগিয়ে দিবে তা কেমন করে হয়। এসব তোয়াক্কা না করে আম্মা আরো জোর গলায় হাসপাতালে নিতে বলেন। এই রাতদুপুরে সিলেটে নেওয়ার কোন সুব্যবস্থা নেই। গাড়ি একটা কোনমতে জোগাড় হলেও নদীতে কোন ফেরি থাকবেনা। দু’দুটো ফেরিঘাট পার হওয়া চাট্টিখানি কথা না। গৃহবধুর স্বামী বিদেশে তাই ছোট দুই সন্তান ও ছোট ভাইকে নিয়ে একা থাকতেন। ভাই তখন নামাজে ছিল। তারাবির নামাজ অর্ধেক শেষ করে খেয়াল করলেন কুপির আলো নিভু নিভু। কেরোসিন ভরতে হবে। কুপিতে আগুন রেখেই কেরোসিন দিতে গেলেন। ধপ করে জ্বলে উঠে আগুন। কাপড় থেকে শরীরে, শরীর থেকে চুলে ছড়িয়ে যায় সর্বনেশে আগুন। কিছু বুঝে উঠার আগেই পুড়ে যায় পুরো শরীর। চিৎকারে ছোট বাচ্চাদের ঘুম ভাঙলেও দরজা খুলতে পারেনা তারা। আগুন লাগা শরীর নিয়ে দরজা খুলে দিলেও ততক্ষণে মহিলা ঝলসে একেবারে একাকার।
আম্মার কথায় পুরুষদের মধ্যে কয়েকজন মিলে একটা পলো নিয়ে আসেন। ঝলসানো শরীর নিয়ে সেই পলোতে বসতে পারেন না মহিলা। নিয়ে আসা হলো দুই খানা তক্তা। সেই তক্তায় বিছানা পেতে শুইয়ে মহিলাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাত পার করে পরের দিন নেয়া হবে সিলেটে।
এত সুন্দর জোছনাময়ী রাত্রিতে মহিলা কাতরাতে কাতরাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে পৌছান। আমরা ফিরে আসি বাড়িতে। ভয়ে গা ছমছম করে। মহিলার আর্তনাদ কানে বাজে। চোখে ভাসে ঝলসানো শরীর। এত সুন্দর জোছনা তবুও রাতটা বড় বিবর্ন লাগে। ঘুমাতে গিয়ে ঘুমাতে পারিনা। হাঁসফাঁস দেখে আম্মা ধমক দেন, চুপ করে ঘুমাও, না করলে তো শুনোনা, যাও কেন?
কি করবো চোখ বন্ধ করলেই দেখি দগদগে পোড়া শরীর। চোখ মেলে থাকি। টিনের চালের ফাঁক গলে জোছনা সরু হয়ে ঘরে ঢুকে, ভালো লাগেনা আমার। পাশ ফিরে শুই। এই খানেও বিপত্তি ঘটে। কাঠের জানালার চিপা দিয়ে আবারও জোছনা হানা দেয়। সর্বনাশী জোছনা আমার সহ্য হয়না। নিদ্রাবিলাসী আমার রাতটা কাটে অনিদ্রায়।

স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তারদের পরামর্শে অতি দ্রুত সিলেটে নেয়া হয় আগুনে পোড়া মহিলাকে। কদিন পর সাথে যাওয়া লোকদের কাছ থেকে জানা যায় কাচা ডিম আর কলা গাছের কষ দেয়াতে ডাক্তাররা যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন। এই অপথেরাপির কারনে আগুনে পোড়া ঝলসানো চামড়া ও মাংস পেশী শরীরের জোড়ায় জোড়ায় জমা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসায় মহিলা এ যাত্রা বেঁচে গেলেও মাংসপেশির ক্ষতটা ভোগাবে অনেকদিন।
সপ্তাহ যেতে না যেতেই আবারও খবর আসে দূর গ্রামে আরেক মহিলার শরীর কুপির আগুনে ঝলসে গিয়েছে। ঘনঘন আগুনে পোড়ার খবর আসে দূর বা কাছের গ্রাম থেকে। সবগুলোই কুপির বা হারিকেনের আগুনের দুর্ঘটনা। আমি এসব খবরে কান হাত দেই, চোখ বুজি। আমার খালি বিরক্ত লাগে জোছনা রাত। সবাই উঠানে বসে চাঁদনী রাতে আসর বসায়। আমি ঘরে লুকিয়ে থাকি। কাউকে বলে বোঝাতে পারিনা আমার কষ্ট। আম্মারা বলাবলি করেন আমদানিকৃত কেরোসিনের কন্টেইনার খালাসের সময় পেট্রোল বা অন্য কোন দাহ্য পদার্থের মিশ্রণের কারণে ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা এড়াতে সবাইকে আরো সতর্ক করা হয়। আস্তে আস্তে কমে আসে কেরোসিনের আগুনে পোড়ার প্রকোপ।
কিন্তু আমার ভয় তো কাটেনা। চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙা আলো থেকে আমি নিজেকে আড়ালে রাখি। এরমধ্যে দশ বারো বছর সময় পেরিয়েছে। গ্রামের পাঠ শেষ করে শুরু হয়েছে শহুরে হোস্টেল জীবন।

চাঁদনী রাতে সবাই ছাদে উঠে মজা করে, আমি যেতে চাইনা, ভয়ের কথাও কাউকে বলিনা। একা রুমের মধ্যে মন টিকেনা। রুমের জানালার কাচ বেয়ে নেমে আসে আবেগী জোছনা। আজকের জোছনারূপ দেখতে আগের মত খারাপ লাগেনা। ক্ষণিক মুগ্ধতায় চেয়ে দেখি জোছনার আলো। আস্তে আস্তে পা ফেলে ছাদে যাই। সবাই কোরাসে গায়……. “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো”। আমি হারিয়ে যাই কি এক অদ্ভুত ভালো লাগায়।

এরপর থেকে ভরা পুর্ণিমায় ছাদে উঠে জোছনা বিলাস রুটিন হয়ে যায়। নিজের মনে ভাবি, জোছনা রাতের ভয় মনে হয় আমায় ত্যাগ করেছে।
সময় আরো গড়ায় , কষ্টের সেই স্মৃতি ও সেই দগ্ধ মহিলাকে অনেকটা ভুলে যাই। দুর্ঘটনার পর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে তিনি স্বামীর সাথে বিদেশে চলে যান। উন্নত চিকিৎসায় ফিরে পান নবজীবন।

অনেক বছর পর সেবার বাড়িতে গিয়ে শুনি মহিলা দেশে এসেছেন। আমি দেখতে যাই মহিলাকে। বিশ বছরের বেশি সময় পেরিয়েছে কোন ফাঁকে টেরই পাইনি। ভয়াবহ সেই আগুনে পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি, এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে? অন্তর্যামীর অশেষ কৃপায় ভালোভাবেই বেঁচে আছেন। মুখ ছাড়া শরীরের সব জায়গায় আছে পোড়া দাগ। মহিলাকে দেখে বড় ভালো লাগে। আমার শৈশবের সেই ভয়াবহ স্মৃতির সাথে মেলেনা। আমি বেরিয়ে আসি সেই দুঃস্বপ্ন থেকে।

বাসায় ফিরে একদিন ভরা পুর্ণিমায় বারান্দায় এসে বসি। রুমের লাগোয়া আমার এক চিলতে বারান্দায় জোছনা বিলাসের অতি ক্ষুদ্র এই আয়োজন কাউকে না হউক নিজেকে বড় মুগ্ধ করে। বারান্দার গা ঘেষে দাঁড়ানো বিশাল কড়ই গাছটার গা বেয়ে নেমে আসে মমতাময়ী জোছনা। বিছানায় শুয়েও দেখা যায় মায়াবতি চাঁদ। ঝরে পড়া জোছনায় মনের আনন্দে আমি অবগাহন করি। একবারতো জোছনা দেখতে গিয়ে কাচের দরজায় ধাক্কা খেয়ে কপাল ফুলে যায়। কর্তার ধমক, “হুশ করে চলতে পারোনা?” হুশ করে চলতে পারিনা দেখে ফুলা কপাল নিয়ে গাল ফুলিয়ে অর্ধরাত্রি বারান্দায় বসে জোছনা বিলাস করি। ধমক দিলেও জোছনা বিলাসে কেউ সঙ্গী হয় আমার। জোছনা প্রীতি আমার নিদ্রাবিলাস কেড়ে নেয়। ফেলে আসা দিনে জোছনা রাতে জোনাকিদের আনাগোনা থাকতো। জোছনার আলো আধারিতে গা ছমছম করতো। ইট পাথরের এই শহরে জোনাকি পোকারা পালিয়েছে সেই কবে। অজানা ভয়ে গা ছম ছম করেনা আমার। ভয় পাওয়াও যে এক ধরনের বিলাসিতা টের পাই হঠাৎ হঠাৎ। আশৈশবের বন্ধু জোনাকিদের বড় মিস করি আমি।

মাঝেমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভালো লাগার ক্ষণ অকারনে হানা দেয় জীবনে। গতরাতে বড় কন্যার একটা অনুষ্ঠানে সাস্টে যাই। ফিরতে অনেক রাত হয়। মনেই ছিলনা পুর্ণিমার কথা। অপ্রত্যাশিত ভাবেই আকাশের মোটা থালাসম চাঁদটা হ্যাংলার মত আমার পিছু নেয়। বড়সড় এক গাছের আড়াল থেকে আমাকে অনুসরণ করে। ফিরে তাকালে চরকা কাটা বুড়িটা ফোকলা দাঁতে হাসে। বড় মায়া লাগে। চলতি পথে এক ঝাঁক জোনাকির দেখা মিলে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনা যায়। আমি মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করি জোছনার অপার সৌন্দর্য। ফিরে যাই হারিয়ে যাওয়া আমার শৈশবে। কি এক ভালো লাগায় আবিষ্ট আমি অতি সন্তর্পনে স্মৃতির ফাইল নাড়া দেই। পাছে সেইসব হাবিজাবি দৃশ্য যদি ভেসে উঠে চোখের সামনে। না সে রকম কিছু হয়না। খারাপ লাগা অনুভুতিগুলো হারিয়ে যায় বড় ভালো লাগার আবেশে।

ফারজানা ইসলাম লিনু,(গল্পকার,শিক্ষক, কন্টিবিউটর ব্রিটবাংলা)

Advertisement