#মি টু (#MeToo) আমার দেশে!

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: গত ৩০ অক্টোবর ফেসবুকে ঢুকে চমকে গেলাম একটা স্ট্যাটাস পড়ে। আমার বান্ধবীর মেয়ে শুচিস্মিতা সীমন্তির স্ট্যাটাস। দম বন্ধ করে স্ট্যাটাসটি পড়লাম। পড়ার পর চুপ বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। চোখের সামনে সীমন্তির চেহারা আর আমার দুই মেয়ের চেহারা যেন মিশে একাকার হয়ে গেছে। বছর চারেক আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে এক বন্ধুর বাসার আড্ডায় সীমন্তির সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে। মেধাবী মেয়েটি এখন বৃত্তি নিয়ে ইউরোপের একটি দেশে পড়াশোনা করছে।

১৬ বছর বয়সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় ঘটনার কথা লিখেছে সীমন্তি। মায়ের বন্ধুর দ্বারা যৌন হয়রানির কথা লিখেছে। ইংরেজিতে লেখা স্ট্যাটাসটিতে সে নিপীড়কের পুরো নাম না লিখে নামের আদ্যক্ষর ‘পিএস’ বলে সম্বোধন করেছে। আমরা যাঁরা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কাজ করেছি, তাঁরা এই ‘পিএস’কে ভালো করেই চিনি। যেহেতু সীমন্তি লিখেছে, তাই আমিও লেখায় ‘পিএস’ নামেই সম্বোধন করলাম সেই ব্যক্তিকে। ‘পিএস’ এখন দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অন্যতম সম্পাদক।

সীমন্তি লিখেছে, ‘পিএস’ তাকে একাধিকবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করেছে। সীমন্তির মা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারী অধিকার আন্দোলনের সম্মুখভাগে থাকলেও টেরই পাননি নিজের মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল তাঁরই বন্ধুর দ্বারা। ১১ বছর ধরে বুকের মধ্যে সেই কদর্য স্পর্শের ক্ষত নিয়ে বেড়াচ্ছিল মেয়েটি। এখন মুখ খুলেছে, যাতে অন্য মা-বাবারা সচেতন হন তাঁদের সন্তানের প্রতি, লক্ষ রাখেন শিশুসন্তানের সঙ্গে এমন বিভীষিকাময় ঘটনা যেন না ঘটে। স্ট্যাটাসে সীমন্তি জানিয়েছে, দশক ধরে সে ওই বেদনা নিয়ে বসবাস করছে। তার হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে ওই ঘটনা। পরিবারগুলো যেন তাদের শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থান দিতে পারে, যাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তারা তা বলতে পারে, সেই প্রত্যাশা জানিয়েছে সে। তার শেষ লাইনটি ছিল, ‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি পিএস! এবং আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না!’

সীমন্তি জানিয়েছে, কাউকে বলতে পারেনি ওই দিনের ঘটনা, মায়ের বন্ধু, যে কিনা বাবাসম। ভয় ছিল মা হয়তো বিশ্বাস না-ও করতে পারেন।

হ্যাঁ বলা যায়, বাংলাদেশে #মি টু (#MeToo) আন্দোলনের সূচনা হলো বাংলাদেশের দুই মেয়ে সাবেক মিস আয়ারল্যান্ড মাকসুদা আখতার প্রিয়তী ও শুচিস্মিতা সীমন্তির হাত ধরে। দুনিয়া তোলপাড় করা এ আন্দোলন চলছে পৃথিবীজুড়ে। বাংলাদেশে এই আন্দোলনের এখন পর্যন্ত যতটুকু সাড়া পাওয়া গেছে, তা দেখলে কে বলবে দেশটিতে নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান, ১০০:১০৩। অথবা ভেবে নেওয়া যেতে পারে, এই দেশে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি হয় না, তাই কারও মুখ খোলার প্রয়োজন হয় না অথবা এ দেশের পুরুষদের সবাই নিতান্তই সচ্চরিত্রের মানুষ!

অথচ গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত যা বলছে, তাতে যে–কেউ আঁতকে উঠবেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে, ৭৫ শতাংশ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে। আর ছেলেশিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রতি ছয়জন ছেলেশিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার। মেয়েশিশুদের মধ্যে তা প্রতি চারজনে একজন।#Me Too আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন সমাজকর্মী টারানা বার্কে। ছবি: টুইটারএখানে পুরুষেরাই প্রধানত যৌন হয়রানিকারীর ভূমিকায়।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মেয়ে আর ৫ শতাংশ ছেলে। শিশুদের যৌন হয়রানির মধ্যে ধর্ষণ ছাড়াও তাদের ওপর নানা ধরনের শারীরিক আক্রমণ, বলাৎকার, স্পর্শকাতর ও যৌনাঙ্গে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ অন্যতম বিষয়।

দুই বছর আগে করা ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা (ভিএডব্লিউ)’ শীর্ষক এক জরিপে বলা হয়েছে, ২২ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১১ শতাংশ, গাড়ি, সড়ক ও রাস্তায় ১০ শতাংশ নারীকে শারীরিক নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে।

বলা হয়, নির্যাতনের তথ্য-উপাত্তের বাইরে আরও বহুগুণ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু দেশে #মি টু আন্দোলনের যে সাড়া দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এ আন্দোলন সফল হওয়া দুরূহ। কারণ, এখানে নিপীড়নের শিকারের চেয়ে নিপীড়কের প্রতি জনসমর্থন বেশি থাকে। মনে করা হয়, ছেলেরা তো একটু–আধটু ‘দুষ্টুমি’ করবেই। নারীকে যৌন হয়রানি যেন পুরুষের জন্মগত অধিকার!

আমাদের দেশে #মি টুর প্রভাব তেমন একটা না দেখা গেলেও দুনিয়া তোলপাড় হচ্ছে এর জোয়ারে। দেশে দেশে #মি টু আন্দোলনের অবস্থা জানাতে গুগল ট্রেন্ডিং ইতিমধ্যে এ রকম একটি ম্যাপ তৈরি করেছে। ম্যাপে এই মুহূর্তে #মি টু আন্দোলনের আলো জ্বলজ্বল করছে ভারতে। ভারতজুড়েই এই মুহূর্তে মানুষ #মি টু নিয়ে কথা বলছে, গুগলে #মি টু লিখে সার্চ দিচ্ছে।

মার্কিন নারীবাদী কবি মিউরিয়েল রুকেসারের একটি উদ্ধৃতি গুগল ব্যবহার করেছে এই ম্যাপে, ‘যদি একজন নারী তার জীবনের সত্য প্রকাশ করে, তাহলে কী ঘটবে? দুনিয়া দুই ভাগ হয়ে যাবে।’

আসলেই দুনিয়া বুঝি দুই ভাগ হয়ে যাবে। ভারতে #মি টু আন্দোলনের অন্যতম দুই নাম নন্দিতা দাস ও মল্লিকা দুয়ার। প্রথমজন ভারতের নামী অভিনেত্রী ও পরিচালক, আর দ্বিতীয়জন দেশের সেরা স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানদের একজন; অভিনয়ও করেন সিনেমাতে। দুজনই নারীদের অধিকার আন্দোলনের লড়াইতে আগাগোড়াই সরব, পরিচিত মুখ। সাহসী ও বলিষ্ঠ মতামত ও স্পষ্ট ভাষার জন্য দুজনকেই মানুষ চেনে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁরা দুজনই কিছুটা অস্বস্তিতে। কারণ, ভারতে #মি টু আন্দোলনের জোয়ারে ভাসছে তাঁদের দুজনেরই বাবার নাম। তাঁরা যথাক্রমে শিল্পী যতীন দাস ও সাংবাদিক বিনোদ দুয়া।

‘পদ্মভূষণ’ খেতাবে ভূষিত যতীন দাস ভারতের জীবিত শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বলা যায়। তিনি একাধারে চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর, বহু স্মরণীয় শিল্পকর্মের স্রষ্টা। আর বিনোদ দুয়া প্রায় চার দশক ধরে ভারতের হিন্দি সাংবাদিকতার জগতের একজন দিকপাল, বিখ্যাত টিভি অ্যাঙ্কর। এই মুহূর্তে তিনি ‘জনগণমন কি বাত’ বলে একটি সাপ্তাহিক ভিডিও বার্তা পরিবেশন করে থাকেন, সেটিও তুমুল জনপ্রিয়।

গত ১৬ অক্টোবর নিশা বোরা নামে একজন নারী প্রথম টুইটারে যতীন দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, ১৪ বছর আগে তিনি ওই শিল্পীর হাতে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন। এদিকে পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধে ‘স্টকিং’ ও যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ এনেছেন নিষ্ঠা জৈন নামের আর এক চিত্রনির্মাতা ও সাংবাদিক। বলিউডের ১১জন নারী চিত্রনির্মাতা একসঙ্গে মিলে অঙ্গীকার করেছেন #মি টু-তে অভিযুক্ত কারও সঙ্গে কোনো কাজ করবেন না, নন্দিতা তাঁদেরও একজন। অভিযোগ উঠেছে, নানা পাটেকর, আলোক নাথ, অনু মালিক, কৈলাশ খেরের বিরুদ্ধেও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভারতীয় সাংবাদিক পল্লবী গগৈ অভিযোগ করেছেন, ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য এশিয়ান এজ’–এর প্রধান সম্পাদক থাকার সময় এম জে আকবর তাঁকে যৌন হয়রানি করেছিলেন।

#মি টু আন্দোলনে যাঁরা শরিক হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিনোদন জগতের ও সংবাদমাধ্যমের ব্যক্তি। কিন্তু এর মানে নিশ্চয় এই না যে অন্য মাধ্যমে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে না। ঘটে ঠিকই, কিন্তু সীমন্তি, প্রিয়তীসহ এই নারীদের মতো সাহসী হয়ে ওঠা হয় না তাঁদের।গত বছরের অক্টোবরে নতুন করে #Me Too গড়ে তোলেন মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। ছবি: এএফপিকিছু কিছু শব্দ আছে, যা কালে কালে আমাদের জীবনের সুদূরপ্রসারী ছাপ রেখে যায়। সেই শব্দগুলো আমাদের ভাবতে শেখায়, সব বাধা পেরিয়ে মনের আগল খুলে দেয়। আমার কাছে #মি টু নিঃসন্দেহে সেই শব্দ। ১৯৯৭ সালে মার্কিন সমাজকর্মী টারানা বার্কে যখন ১৩ বছরের এক কিশোরীর মুখে তার ওপর ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন, তখনই তাঁর বুকের ভেতর জন্ম নিয়েছিল ওই ‘মি টু’।

পরে যৌন হিংসার বিরুদ্ধে তাঁর প্রচার আন্দোলনের নাম দেন ‘মি টু’, মানে ‘আমিও’ যৌন হেনস্তার শিকার ।

অযুতকাল ধরে মেয়েরা পৃথিবীর সর্বত্র যৌন হিংসার শিকার হয়ে আসছেন। তারপরও কৃষ্ণাঙ্গ বার্কের ২০০৬ সালে গড়ে তোলা ওই আন্দোলনকে সাদা চামড়ার নারীবাদীরা বেশি দিন পাত্তা দেননি, দেননি কোনো সমর্থন।

নতুন করে মি টু যাঁর হাত ফিরে এসে দুনিয়া কাঁপানো শুরু করেছে, যেই মি টু আন্দোলনকে প্ল্যাটফর্ম ধরে বাংলাদেশের দুজন নারী প্রিয়তী ও সীমন্তি সুনির্দিষ্টভাবে প্রভাবশালী দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তা নিয়ে একটু পেছনের কথা না বললেই নয়। নতুন করে গত বছরের ১৫ অক্টোবর যৌন নিপীড়নবিরোধী প্রচারাভিযান শুরু করেন মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। হলিউডের মুভি-মুঘল হার্ভে উইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির খবর ফাঁসের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এই উদ্যোগ নেন তিনি।

এরপর তো ইতিহাস! অ্যালিসার টুইটের মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ তাতে কমেন্ট করেন। হাজার হাজার নারী #মি টু লিখে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। শুরুর মাত্র ২ দিনে ১০ লাখের বেশিবার এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইট করা হয়েছে। আর এই প্রচার শুরুর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বিষয়টি নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন ও কমেন্ট করেছেন ফেসবুকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে যুক্ত হচ্ছে বহু নারী।

এর ফলাফল কিন্তু একেবারে শূন্য নয়।
ভারতে সাংবাদিক থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা এম জে আকবর যৌন হয়রানির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন।
#মি টু আন্দোলনে সাড়া দিয়ে বলিউড অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত খ্যাতনামা অভিনেতা নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে ১০ বছর আগে এক ছবির শুটিংয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন। এর জের ধরে বিগ বাজেটের ছবি ‘হাউসফুল ফোর’ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন নানা পাটেকর।

যাঁকে ঘিরে #মি টু আন্দোলন শুরু, সেই মিডিয়া-মুঘল হার্ভে উইনস্টাইনও ছাড় পাননি। আদালতের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।

এ কথাগুলো উল্লেখ করা এই কারণে যে আশার আলো কখনো নিভে যায় না। অভিযোগ করলে হয়তো সব সময় বিচার মেলে না। তাই বলে দমে যাওয়া তো যাবে না। সামাজিক বিচার বলেও তো একটা কথা আছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলছি, ওপরের ঘটনাগুলোকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করুন। নারীর প্রতি যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার কথা শুধু মুখে না বলে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তা কার্যকর করুন। আসুন, সবাই মিলে বর্জন করি নিপীড়কদের।

Advertisement