যে প্রযুক্তিগুলো স্বাস্থ্যসেবার সহায়ক

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: প্রযুক্তির ব্যবহারে বিশ্বব্যাপী ইতোমধ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। চিকিত্সা সেবার আজকের এই উন্নতির মূলেও রয়েছে প্রযুক্তি। তবে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার এই খাতে আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

আজ থেকে বছর দশের আগেও সামান্য ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ পরিমাপ করার জন্যও ছুটে যেতে হতো বাড়ির পাশের ফার্মেসিতে কিংবা কোনো ডাক্তারের কাছে। অথচ আজকের আধুনিক কোনো তরুণের হাতে পড়া ফিট ব্যান্ড খুব সহজেই পরিমাপ করে দিচ্ছে এই রক্তচাপ। স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেট পিসি আর বিভিন্ন ধরনের পরিধেয় গ্যাজেটের কল্যাণে এখন হূদস্পন্দন, রক্তচাপ, ক্যালরি খরচ তো বটেই; হূদপিণ্ডের গতিবিধিও জানা যাচ্ছে নিজে নিজেই। আবার এসব গ্যাজেটের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করে দিলে সেখান থেকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শও মিলছে। ফলে চিকিত্সা সেবায় বলতে গেলে এক নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে এসব গ্যাজেটের মাধ্যমে।

টেলিমেডিসিনের যুগ

টেলিমেডিসিনের ধারণা নতুন এই সময়ে এসে প্রাচীন হতে শুরু করেছে। টেলিমেডিসিনের ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে টেলিমেডিসিন সেন্টারে অবস্থান করেন রোগী। আর দূরের কোনো শহরে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক তার সাথে যুক্ত হন টেলিকনফারেন্স কিংবা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। রোগীর বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট অনলাইনে তাত্ক্ষণিকভাবেই পৌঁছে যায় ডাক্তারের কাছে এবং তিনি সাথে সাথেই রোগীর জন্য ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন করে দিতে সমর্থ হন। টেলিমেডিসিন সেন্টারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকলে ডাক্তার দূরে বসেই রিয়েল-টাইমে রোগীর শারীরিক সব তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন। আমাদের দেশে টেলিমেডিসিন সেবার ছোঁয়া লাগতে শুরু হয়েছে। এই রূপটি পুরোনো হয়ে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বে। এসব দেশে পরীক্ষামূলকভাবে এখন এমন অনেক সুযোগ তৈরি করা গেছে, যেখানে রোগীকে কোনো টেলিমেডিসিন সেন্টারে যেতে হয় না। ঘরে বসে রোগী তার স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেট পিসির সাহায্যেই যুক্ত হয়ে যান ডাক্তারের সাথে।

স্বাস্থ্যসেবায় সাশ্রয়ে প্রযুক্তি

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবার পেছনে প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৬.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। গবেষণা সংস্থা পিডাব্লিউসি তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, মোবাইলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে ২০১৭ সাল নাগাদ কেবল ইউরোপিয় ইউনিয়ন সাশ্রয় হয়েছে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি বর্তমান অবকাঠামো ব্যবহার করেই আরও অতিরিক্ত ২৪ মিলিয়ন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা যাবে। যে কারণে আধুনিক মোবাইল ডিভাইস এবং গ্যাজেটের ব্যবহার স্বাস্থ্যসেবাকে আরও বেশি স্থিতিশীল করে তুলবে বলে মন্তব্য করছে তারা। তাদের এই প্রতিবেদনের সাথে একমত হতে দেখা যায় প্রায় সংশ্লিষ্ট সকল বিশেষজ্ঞদের।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গ্যাজেট

নিজের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতে ইতোমধ্যেই গ্যাজেটের দ্বারস্থ হতে শুরু করেছে মানুষ। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতাদের নিয়ে আসা নতুন নতুন গ্যাজেটেও। কনজ্যুমার ইলেক্ট্রনিক্স শোয়ের (সিইএস) গত দুই বছরের প্রদর্শিত পণ্যের তালিকা দেখলেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই দুই আসরের প্রতিটিতেই প্রদর্শিত হয়েছে ৩০-৪০টি করে গ্যাজেট যেগুলো বিভিন্ন ধরনের শরীরবৃত্তীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে সক্ষম। এবারের সিইএসে প্রদর্শিত এমন গ্যাজেটের মধ্যে উল্লেখ করা যায় উইদিংস অরার কথা। ছোট্ট এই গ্যাজেটটি ঘুম পাড়াতে সহায়তা করবে। নিট্যাটমো জুন নামের আরেকটি অলঙ্কারাকৃতির গ্যাজেট সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি অতিবেগুনি রশ্মির পরিমাণ নির্ধারণ করে জানিয়ে দিতে পারে যে তা ক্ষতিকর মাত্রাকে অতিক্রম করছে কি না। টিংকে নামের আরেকটি গ্যাজেট হূদস্পন্দনের গতি, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি মনিটর করতে সক্ষম। বৃদ্ধাঙ্গুলির ত্বক থেকেই সে এই তথ্যগুলো মনিটর করতে পারে। টাও ওয়েলশেল নামের আরেকটি গ্যাজেট যাবতীয় শারীরিক পরিশ্রম ও কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ হিসাব রাখতে সক্ষম। এলজি, স্যামসাং, সনির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানও এখন এই ধারাবাহিকতায় তৈরি করছে শারীরিক তথ্য মনিটর করার উপযোগী ব্রেসলেট, ব্যান্ড এবং অন্যান্য গ্যাজেট। এগুলো ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে বিশ্বব্যাপী।

স্বাস্থ্যসেবায় এম-হেলথ

বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে তথ্যের যুগ। যার কাছে যত বেশি তথ্য রয়েছে, সেই তত বেশি সমৃদ্ধ। স্বাস্থ্যসেবায় এই তথ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশেই ব্যবহূত হচ্ছে এম-হেলথের বিভিন্ন উদ্যোগ। মোবাইল হেলথের এই মডেলগুলো বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনেক বেশি উপযোগী। উদাহরণস্বরূপ পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের কথা বলা যায়। দেশটির গ্রামাঞ্চলে কয়েক হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র একজন ডাক্তার। ফলে সেখানে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই প্রকট। তবে সেখানেও এখন মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে মোবাইল ফোন। দেশটির নেটওয়ার্ক অপারেটর অরেঞ্জ ক্যামেরুন দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্প্রতি যৌথ উদ্যোগে চালু করেছে একটি বিশেষ এসএমএস হেলথ সেবা। এই সেবার আওতায় যে কেউ নিজের নাম-পরিচয় না জানিয়েই এসএমএস করে জানতে চাইতে পারে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক যেকোনো তথ্য। আর এসএমএস করার অল্প সময়ের মধ্যেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ হাজির হয়ে যাবে। উন্নয়নশীল অনেক দেশেসহ বাংলাদেশেও এমন ধরনের মডেল অনুসরণ করে তৈরি হচ্ছে মোবাইল হেলথ সেবা।

সহজে স্থাপনযোগ্য চেম্বার

ওহাইওর একটি স্টার্ট-আপ কোম্পানি সম্প্রতি হেলথস্পট নামে টেলিকনসাল্টিং বুথ চালু করেছে। এই বুথগুলো খুব বেশি জায়গা না নিয়ে যেকোনো শপিং মল কিংবা অফিসেই চালু করা যায়। এই বুথগুলোতে এইচডি ক্যামেরা, মাইক্রোফোন এবং ভিডিও স্ক্রিন থাকে, যার মাধ্যমে রোগীরা দূরবর্তী ডাক্তারের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারে। এর সাথে সাথে সেখানে রয়েছে স্টেথোস্কোপ, থার্মোমিটারের মতো প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মেডিকেল ইকুইপমেন্ট। ডাক্তারের সাথে অনলাইনে যুক্ত হয়ে তার নির্দেশনা অনুযায়ী রোগী নিজেই এগুলোই ব্যবহার করে থাকে এই বুথে। আর এর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য সরাসরি অনলাইনে পৌঁছে যায় ডাক্তারের কাছে। তার প্রেসক্রিপশনও হাজির হয় অনলাইনেই। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে এটি স্থাপন করা হয়েছে অনেক আগেই। পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশে বর্তমানে এমন সেবা চালু হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল, এগুলো স্থাপনের জন্য কাজ শুরু করবে হেলথস্পট।

ঘরে বসেই স্বাস্থ্যসেবা

অগমেন্টেড রিয়েলিটি ডিভাইসের ব্যবহার ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে গেমিংয়ের ক্ষেত্রে। মাইক্রোসফটের কাইনেক্টের মতো এমন অনেক ডিভাইসই এখন আসছে, যেগুলো সরাসরি গেমের চরিত্রগুলোকে নিজের শারীরিক নড়াচড়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের সুবিধা দেয়। এই ধরনের ডিভাইসকে স্বাস্থ্যসেবাতেও ব্যবহারের প্রবণতা শুরু হয়েছে। আর্থ্রাইটিস কিংবা ডায়াবেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত রোগীরা এক্সবক্স ও কাইনেক্ট ব্যবহার করে সরাসরি সংযুক্ত হয় ডাক্তারের সাথে। এরপর ডাক্তার তাকে যে শারীরিক কসরত্ করতে পরামর্শ প্রদান করেন, সেটি অ্যানিমেটেড অ্যাভাটার হয়ে হাজির হয় রোগীর কাছে। সেই অ্যাভাটারের অনুরূপ কসরত্ রোগী করলে সেটি কতটুকু সঠিক হচ্ছে, তা পূঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে কনসোল। এই পদ্ধতিতে সরাসরি রোগীর তথ্যও পেতে পারেন ডাক্তার। এভাবেই প্রযুক্তির সহায়তায় স্বাস্থ্যসেবা ছড়িয়ে পড়ছে বৈচিত্র্যময় সব উপায়ে।

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির ব্যবহারে স্বাস্থ্যসেবা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তার বিভিন্ন মডেল আমাদের দেশেও বাস্তবায়িত হতে পারে। বিশেষ করে আমাদের দেশে গ্রামে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে এগুলো কার্যকর ভূকিকা রাখতে পারে।

Advertisement