যে সানাই বাজলো বিউগলের করুণ সুরে…

    :ময়নূর রহমান বাবুল:

মানুষ মরণশীল। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ এ কথাটি চিরন্তন। খুবই সত্য এবং বাস্তব। এই মৃত্যু হয়তো ভিন্ন নিয়মে, ভিন্ন কারনে অথবা ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় হতে পারে। স্বাভাবিক মৃত্যু, দুর্ঘটনা জনিত কিংবা হত্যাজনিত মৃত্যু। মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন তা কারো কাম্য নয়। অভিপ্রেত নয় – প্রত্যাশিতও নয়। অথচ একমাত্র মৃত্যুই সবচেয়ে সত্য, বাস্তব, চিরন্তন। মৃত্যু হবেই, মৃত্যু অনিবার্য।

কিছু কিছু মৃত্যু আমরা বুঝতে পারি – যা স্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে বিবেচিত। যেমন একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর অথবা বার্ধক্য জনিত কারনে মৃত্যু। কিন্তু দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যু আমাদেরকে খুব কষ্ট দেয়। মানসিক ভাবে অপ্রস্তুত এসব মৃত্যু আমাদেরে যেন তড়িতাহত করে।

এমনি এক দুর্ঘটনা ঘটে গত ১৪ই জুন ২০১৭ মধ্যরাতে। পশ্চিম লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে। ২৪তলা উঁচু এই ভবনে শতাধিক ফ্ল্যাট ছিল। টাওয়ারটিতে লোক বসতি ছিল প্রায় ছয় শতাধিক। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে নীচ থেকে সর্বোচ্চ ফ্লোর পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়। দুর্ঘটনার সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে পোড়া বিল্ডিং এর কালো রঙের কঙ্কাল। আর এ দুর্ঘটনায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শ’তের কাছাকাছি মানুষ। প্রাণপণ চেষ্টায় অনেকেই বেঁচে গেলেন ঠিকই। কিন্তু দেহে ও মনে আহতের চিহ্ন তারা হয়তো বয়ে বেড়াবেন বাকী জীবন। কেউ কেউ অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেলেন। এরকম দুর্ঘটনায় এরকম আশ্চর্যজনক ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন গল্পের জন্ম দিয়ে অনেকেই বাঁচে। আমরা যাকে বলি অলৌকিক ভাবে বাঁচা। দশতলা উঁচু থেকে মা তার ছোট্ট সন্তানকে ফেলে দেন নিচে। বেঁচে যায় সন্তানটি অলৌকিকভাবে। একই কক্ষে অবস্থানকারী স্বামী-স্ত্রী। অথচ স্বামী বেঁচেবর্তে চলে এসেছেন বাইরে – স্ত্রী মৃত্যুকে করেছেন বরণ। কেউ পোষা কুকুরকে নিয়ে আসতে পারেননি বলে নিজেও আসেননি। ফলে মৃত্যু। সে তো অনেক কথা, অনেক ঘটনা, অনেক কাহিনী।

আমি বলছি কমরু মিয়া (৮২), রাবেয়া(৬০) দম্পতি এবং তাদের তিন সন্তান, হামিদ(২৯) হানিফ(২৬) আর হুসনা(২২) এর কথা। তারা থাকতেন এই বিল্ডিং এর ১৭তলায়। মধ্যরাতে আগুন লাগার পর তারা অনেক্ষন ধরে ফোনে কথা বলেছেন তাদের নিকট আত্মীয়দের সাথে। আগুনের লেলিহান শিখা নীচ থাকে উপরের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো । তারা তাদের চোখের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুকে দেখছিলেন। মৃত্যু ভয়াবহ জেনেও মানুষ কখন সে মৃত্যুকে বরণ করতে পারে ? নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও মানুষ কখনো কখনো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ! সে হয়তো দেশপ্রেমে উদ্ভোদ্ধ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বা দেশের কাজে। কিন্তু কমরু মিয়ার তিন ছেলে মেয়ে মৃত্যুকে মেনে নিলেন অন্য আরেক ভাবে, অন্য এক কারনে। বাবা ৮২ বছর বয়সের। অসুস্থ। চলন ক্ষমতাহীন। মা ও বয়স্কা। ১৭তলার উপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা তাদের পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব নয়। সন্তানরাও এ মুহূর্তে কোলে কাঁধে বয়ে নিয়ে নামানো অসম্ভব। এতো উঁচু। ছোট্ট সিঁড়ি। তার উপর আগুনের লেলিহান শিখা, ঘন কালো ধোঁয়া, ভয় ইত্যাদি এই অসম্ভবের প্রধান কারন। হামিদ হানিফ আর মেয়ে হুসনাকে হয়তো বাবা মা বার বার তাগিদ দিয়েছেন বেরিয়ে যেতে। কিন্তু বাবা মা কে নিশ্চিৎ মৃত্যুর মুখোমুখি রেখে চলে যাবে এমন সন্তান তো তারা নয়। যদিও জগতের সচরাচর একটা নিয়ম হলো, সন্তানদেরই কম দয়ামায়া থাকে মা বাবার প্রতি। তুলনামুলক ভাবে মা বাবাই সন্তানদের জন্য সব কিছু করেন। প্রয়োজনে নিজের প্রাণ দিয়েও সন্তানের জীবন রক্ষা করেন। নিজের আঘাতে যতটুকু ব্যথিত হন, সন্তানের কষ্টে তার চেয়ে বেশী কুণ্ঠিত হন। নিজের গা কেটে গেলেও সন্তাকে কোলে কাঁধে বুকের পাঁজরে নিরাপদ রাখেন সকল মা বাবাই। অর্থাৎ তুলনা মূলক সন্তানরাই মা বাবাকে কম গুরুত্ব দেয়, যদিও এরও বহু ব্যতিক্রম রয়েছ।

এইতো মাত্র সপ্তাহ দুয়েক হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদপত্র ইত্যাদিতে অনেকেরই হয়তো একটি বীভৎস সংবাদ চোখে পড়েছে। এক বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার শিল্পপতি এক ছেলেকে এ খবর জানিয়ে ফোন করেছেন। উত্তরে ছেলে বলেছেন, তিনি এখন প্রয়োজনীয় মিটিং এ আছেন। লাশ যেন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। এই বাবার আরো দুই প্রতিষ্ঠিত ছেলে আছেন। তারাও বাবার মৃত্যু সংবাদে কবর দেয়া দাপন-কাপন করা দূরে থাক, লাশ দেখতেও আসেনি! যদিও এটাও এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ।

২৯শে জুলাই তারিখে কমরু মিয়ার মেয়ে হুসনার বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা ছিলো। সানাই বাজবে। বিয়ের হল রিজার্ভ করা হয়েছে। নিমন্ত্রনপত্র ছাপানো হয়েছে। দাওয়াত দেওয়াও শুরু হয়েছে। পান-চিনি, এঙ্গেজমেন্টও হয়েছে। কাপড় চোপড় গহনাপত্র কেনাকাটা হয়েছে, হচ্ছে। লন্ডনে এখন বছর ছয়মাস পূর্ব থেকেই বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বিয়ের লেহেঙ্গা অর্ডার দিলে তা বোম্বে থেকে তৈরি হয়ে আসে। গহনা আসে কলকাতা দিল্লি কিংবা মধপ্রাচ্য থেকে। অতএব হুসনার বেলায়ও হয়তো এর তেমন ব্যতিক্রম হয়নি। বিয়ের পরে অন্য কোন দেশে হানিমুনে না গিয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে – মা বাবাসহ সপরিবারে। তাও নির্ধারিত ছিলো।

২৯ শে জুলাই হুসনার বিয়ের সানাই বাজবে। মেহেদী হলুদের রঙ লাগবে তার আগেই। সামনে কতো স্বপ্ন। রচিত হবে কতো গল্প। বিয়ে মানেই নতুন কিছু। আনন্দ আহ্লাদ কৌতূহলে পরিপূর্ণ। আশার সাথে আশঙ্কারও যেন শেষ নাই। কিন্তু তার আর দরকার হলোনা। তার আর অপেক্ষা করতে হলোনা। তার মাসাধিক আগেই তা নিভে গেল। আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিলো টাওয়ারের লেলিহান আগুনের শিখা। গ্রেনফেল টাওয়ারের ১৪৪ নং ফ্ল্যাটে আজ সানাই বাঁজার কথা ছিলো। সানাইয়ের আনন্দঘন মাতালকরা মিষ্টি সুরে সারা টাওয়ারের প্রতিটি ফ্ল্যাটে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু গ্রেনফেল টাওয়ারের কালো ছাই রঙের কংকালের ফাঁকে ফাঁকে আজ যেন বিউগলের সুর বাজছে। বিউগলে বাজছে আজ বিয়ের সানাই। করুন এই সুরে আমরা বারবার ঝাপসা চোখে এক হুসনাকে দেখি – মা বাবার প্রিয় এক সন্তান হাতে মেহেদী, চোখে রঙিন স্বপ্ন – সামনে নতুন এক পুরুষ মানুষ – নতুন এক জীবন। বেশ কিছু আশা… । অথচ বাবা মাকে নিশ্চিৎ মৃত্যুর জিম্মায় রেখে স্বার্থপরের মতো নিজে না বেঁচে মা বাবার সাথে সহমরণ বরণ করা এক নির্ভীক নির্লোভ সন্তান হুসনা আজ অপূর্ব সুন্দরী কন্যা সাজে আমাদের প্লাবিত চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়! বাজুক সানাইয়ে বিউগলের সুর। তবু এমন সন্তান নিয়ে আমরা গর্বিতই হই।
***নোটঃময়নূর রহমান বাবুল এক সময়ের মেধাবী ছাত্রনেতা এম সি বিশ্ব্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ(১৯৭৯) ভিপি বিলেতের প্রধান কবিদের একজন।

ব্রিটবাংলার পাঠকদের জন্য এখন থেকে লিখবেন৷

 

Advertisement