রোজিনা নয় সাংবাদিকতাকেই গলা চেপে ধরলেন এই আমলা

।। হিমিকা আযাদ ।।

আমরা এক বাক্যেই বলতে পারি, “রোজিনা” সরকারের একটি নতুন টিউমারের নাম। যে টিউমার অপসারণে সফল হতে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। খুব বেশি কৌশলও অবলম্বন করতে হয়নি। সহজেই লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব হয়েছে। তবে যদি আমরা আইনের দিকে দৃষ্টিপাত করি এমন কি ২০১১ সালে জনস্বার্থসংশ্নিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) যে আইনটি পাস হয়েছে সেটি লক্ষ্য করি । তাতেই কিছুটা পরিষ্কার ধারণা পেতে পারি। এই আইনে বলা হয়েছে- “জনস্বার্থে জরুরি মনে হলে গোপনীয় হলেও সে তথ্য প্রকাশ করা যাবে। এমনকি যদি তথ্যের সমর্থনে ডকুমেন্ট না থাকে কিন্তু তথ্য সত্য বলে বিশ্বাস করার দৃঢ় ভিত্তি আছে, তাহলেও তথ্য প্রকাশ করা যাবে এবং তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা দিতে হবে” এমনকি এ আইনে জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশকারীকে পুরস্কৃত করার বিধানও আছে।
রোজিনা ইসলাম জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ করেছেন কিংবা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এই আইন-ই বলে দিচ্ছে তার বিচার কি হওয়া উচিৎ। আদতে সাংবাদিক রোজিনা কোনো বিচারের আওতায় পড়েন কিনা তাও দেখবার বিষয় । তবে সরকারি কর্মকর্তারা তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করেছেন। এ কারণে এ আইনের ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী এ ঘটনা ঘটিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন বলেও প্রতীয়মান।” ।
এবার আসা যাক তাকে যে মামলায় আটক করা হয়েছে তার কিছু বিশ্লষণে। দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাতে তার বিরুদ্ধে ‘বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র এবং ডকুমেন্টস চুরির’ অভিযোগ আনা হয়েছে। সোমবার (১৭ মে) রাত পৌনে ১২টার দিকে শাহবাগ থানায় এ মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী।
মামলা হয়েছে দণ্ডবিধির ৩৬৯ ও ৪১১ ধারা এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের ৩ ও ৫ ধারায়। কিন্তু রোজিনা ইসলামের পক্ষে শুনানিতে আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, এই মামলাটি একটি ত্রুটিপূর্ণ মামলা। এই মামলায় দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ এবং অফিসিয়ালস সিক্রেসি অ্যাক্ট ৩ ও ৫ ধারায় যে মামলা করা হয়েছে সেটি মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেননা এই মামলায় যে ডকুমেন্টের কথা বলা হয়েছে ওই ডকুমেন্টের কথা মামলার এজাহারে বর্ণনা নেই। মামলায় যে জব্দ তালিকা দেখানো হয়েছে এই জব্দ তালিকার ডকুমেন্টও আসামির কাছ থেকে উদ্ধার হয়নি। তা উদ্ধার হয়েছে একজন সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে। কাজেই আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা ও মানহানিকর।
তিনি আরও বলেন, আমরা আদালতকে বলেছি যদি দণ্ডবিধি ৩৭৯ ধারা বিশ্বাস করতে হয় তাহলে চুরি হতে হবে প্রকাশ্য স্থানে অথচ ঘটনাটি ঘটেছিল সচিবালয়ে। তিনি তার মহান পেশা পালন করতে গিয়ে সচিবালয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া এরইমধ্যে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তিনি মহান পেশা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন ।
সবরকমের তথ্য এবং আইন বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি সাংবাদিক রোজিনা কোনো ভাবে দোষী নন । বরং এখানে কোনো অসাধু চক্র কাজ করে যাচ্ছে তাকে হেনস্থা করার জন্য। অন্যদিকে সচিবালয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আমলাদের আতংক ছিলেন রোজিনা ইসলাম। অন্তত ছয়জন সচিবের চাকরি তার প্রতিবেদনের জন্য চলে গিয়েছিল, মানে তাদের স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। তার মধ্যে স্বাস্থ্য সচিবও ছিলেন। এ ছাড়া আরও ১৬ জন সচিবও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছিলেন, তাদের সেই দাবিও বাতিল হয়েছিল রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানী রিপোর্টের কারণে৷
২০১৪ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদারের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। আর সাবেক সচিব এবং সেসময়ের প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানেরও সনদ ও গেজেট বাতিল করা হয়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য রোজিনা ইসলাম কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ইন বাংলাদেশি জার্নালিজম (২০১১), টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার (২০১৫), পিআইবি ও দুদকের উদ্যোগে দুর্নীতি প্রতিরোধে গণমাধ্যম পুরস্কার বাংলাদেশসহ (২০১৪) বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন।
দু:খজনক হলেও সত্য যে আমরা আতংকিত আগামী ২৩ মে রবিবার তার শুনানীর দিন ধার্য করা হয়েছে সেদিনও বিজ্ঞ আদালত তার জামীন মন্জুর করেন কি না। নাকি দূর্নিতীগ্রস্থ প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য আন্তর্জাতিক পুরুস্কার প্রাপ্ত এই সাংবাদিককে কারা ভোগ করতে হতে পারে এমন কি যে আইনে ১৪ বছরের জেল ও হতে পারে ।

লেখক : ব্রিটেন প্রবাসী ব্রডকাস্ট জার্নালিষ্ট।

Advertisement