লন্ডনে সংহতি গ্রন্থমেলা: বই লেখক পাঠক এর নন্দিত সমাবেশ

:আনোয়ারুল ইসলাম অভি:

 বিলেতবাসী লেখকদের বই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো লন্ডনে অনুষ্ঠিত হলো সংহতি গ্রন্থমেলা ও লেখক সমাবেশ। ১৫ সেপ্টেম্বর রবিবার পূর্ব লন্ডনের ব্রার্ডি আর্ট সেন্টারে গ্রন্থমেলা পরিণত হয়েছিল বিলেতের লেখক-পাঠকদের মিলন মেলায়।

বই এর টানে লন্ডনের বাইরের শহরগুলো থেকেও অনেক লেখক,পাঠক উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। অনেকে তাদের পরিবার নিয়ে এসেছেন। যা অন্যান্য মেলায় সচরাচর চোখে পড়েনা।গ্রন্থমেলার আয়োজক সংগঠন সংহতি সাহিত্য পরিষদ।

দুপুর বারোটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলা গ্রন্থমেলায় ছিল বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা- আলোচনা ,কবিতা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি,প্রকাশিত বই এর মোড়ক উন্মোচন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তিন পর্বের অনুষ্টান সঞ্চালনায় ছিলেন ছড়াকার রেজুয়ান মারুফ, কবি ইকবাল হোসেন বুলবুল ও কবি, সাংবাদিক আনোয়ারুল ইসলাম অভি।

মেলায় অতিথি হিসাবে আলোচনায় অংশ নেন কবি শামীম আজাদ,সাংবাদিক- গবেষক ইসহাক কাজল,লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব এর সভাপতি সাংবাদিক সৈয়দ নাহাস পাশা, চ্যানেল আই ইউরোপের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সাংবাদিক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী শুয়েব, লেখক হামিদ মোহাম্মদ,সাপ্তাহিক সুরমা সম্পাদক কবি আহমেদ ময়েজ,কবি গোলাম কবির।

অনুষ্টানে সভাপতিত্ব করেন- সংহতি সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কবি ফারুক আহমেদ রনি।

মেলায় বিলেতের প্রায় শতাধিক লেখকের বই স্থান পায়। এছাড়াও অতিথিদের নিয়ে ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিলেতবাসী ৪০জন লেখক এর বই এর মোড়ক উন্মোচন এর আয়োজন করে সংহতি। ২১জন লেখক তাঁদের প্রকাশিত বই এর মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিদের নিয়ে।

আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি কবি শামীম আজাদ বলেন-বিলেতে আমরা বাঙালিরা দুই ভাষাতেই ভালো লিখছি, নিয়মিত প্রকাশ করছি, আমাদের সৃজনকর্মে প্রকাশিত হচ্ছি। বাংলাদেশী হিসাবে আমাদের পরিচিতি গর্ব করার মতো।আমাদের প্রজন্মও আমাদের পথে, মাল্টিকালচারাল দেশে হাটছে; আলো হাতে। ডায়াসপোরায় আমাদের অর্জন অনুচ্চারিত নয় মোটেও।

সাম্প্রতিক সময়ে,নতুন প্রজন্মর এগিয়ে যাওয়া আমাদেরকে অনেক বেশী অনুপ্রাণীত করছে।

বিশেষ অতিথি চ্যানেল আই ইউরোপ ডাইরেক্টর রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী বলেন- প্রবাসে লেখকদের মৌলিক ও সৃজনশীল সাহিত্য চর্চা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছে সন্দেহ নেই।

বিলেতে লেখকদের বই প্রকাশনায় অনেক যাতনা আছে। সংহতি গ্রন্থমেলাকে সামনে রেখে চ্যানেল আই একটি অনুষ্ঠান করেছে- জানা গেল, ব্রিকলেনের সর্বশেষ বই এর দোকানটিও আজ আর নেই। টাওয়ারহ্যামলেটস এর ল্যোকাল লাইব্রেরী গুলোও এখন নাকি আর বাংলা বই কিনছেনা। আবার বাংলাদেশে বই প্রকাশ কওে, বই গুলো বিমানে আনতে প্রতি কেজিতে প্রায় ১২০০ টাকা একজন লেখককে দিতে হয়। অথচ বাংলাদেশ বিমান অনেক সময় প্রায় অর্ধেক যাত্রি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে লন্ডন আসে। ব্রিটেনে বাংলাদেশ হাই কমিশন এবং বাংলাদেশ বিমান এই দায় কোন ভাবেই এড়াতে পারেনা।

অতীতের মতো চ্যানেল আই ইউরোপ সাহিত্য ও সংস্কৃতিবান্ধব থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

কবি লেখক হামিদ মোহাম্মদ বলেন- সংহতির গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পেরেছে। আমরা অনেক লেখককে যেমন জানতে পারছি তেমনি তাঁর লেখার সাথেও পরিচিত হবার সুযোগ পাচ্ছি সংহতি গ্রন্থ মেলার মাধ্যমে। সংহতি প্রতিবছর গ্রন্থমেলার উদ্যোগ নিবে আমার প্রত্যাশা।

সাপ্তাহিক সুরমা সম্পাদক কবি আহমেদ ময়েজ বলেন-একজন লেখকের আসলে নিদিষ্ট গন্ডি নেই।

তিনি যে কোন জায়গা থেকে প্রকাশিত বা লিখতে পারেন। আমরা বিলেত থেকে লিখছি এবং অনেকে খুব ভালো লিখছেনও।সংহতি গ্রন্থমেলা প্রবাসী লেখকদের মেল বন্ধন করছে যা অত্যন্ত ভালো কাজ।

কবি গোলাম কবির মেলাকে ঘিরে বিলেতবাসী লেখক-পাঠক সমাবেশের জন্য আয়োজক সংগঠন সংহতিকে ধন্যবাদ জানান।

বিলেতের লেখকদের প্রকাশিত বই এর মোড়ক উন্মোচণ পর্বে- বিশেষ অতিথি বিশিষ্ট সাংবাদিক লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব এর সভাপতি সৈয়দ নাহাস পাশা সংহতিকে গ্রন্থমেলাটি ধারাবাহিক ভাবে চালিয়ে চালিয়ে যাবার আশা ব্যক্ত করে বলেন- আমার বিশ্বাস সংহতি গ্রন্থমেলা ধারাবাহিক ভাবে চালিয়ে যাবার সকল যোগ্যতা রাখে। ভালো বই পড়া ও কেনায় লেখক-পাঠকদের আরও বেশী মনোযোগি হওয়া দরকার আছে।

বিশিষ্ট সাংবাদিক,গবেষক ইসহাক কাজল বলেন লেখক-পাঠকের মধ্যে মিলন ঘটাতে সংহতির গ্রন্থমেলা অশেষ ভূমিকা রাখছে। সংহতির পক্ষ থেকে একটি বুকসপ খোলা যায় কিনা ভেবে দেখবেন।যদি সম্ভব হয় -আমি সামান্য লেখক হিসাবে সর্বাত্বক সহযোগীতায় থাকবো।

আলোচনা পর্ব অনুষ্টানটির সভাপতি এবং গ্রন্থমেলা ও লেখক সমাবেশ ২০১৭ উপকমিটির সভাপতি কবি গল্পকার ময়নূর রহমান বাবুল বলেন- আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক ভালো লেখক প্রবাস থেকে বাংলা সাহিত্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছেন।

সংহতি গ্রন্থমেলা অভিবাসে তাঁদের কাজ গুলোকে এক ছাতায় নিয়ে আসতে পেরেছে ,যা লেখক-পাঠকের জন্য খুব ভালো দিক। সংহতির এইধারা অব্যাহত থাকবে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মৌলিক গানে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন জনপ্রিয় গীতিকার শেখ রানা ও জাহাঙ্গীর রানা। আবৃত্তি করেন বিলেতের জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী রেজুয়ান মারুফ,মুনিরা পারভিন, সালাউদ্দিন শাহীন, শহিদুল ইসলাম সাগর,সুদীপ চক্রবর্তী, তাহেরা চৌধুরী লিপি,জিয়াউর রহমান সাকলাইন, শতরুপা চৌধুরী, মুস্তাফা জামান নিপুন নজরুল ইসলাম অকিব,পলিন মাঝি।
ছড়াপাঠ করেন শাহাদাৎ করিম,রেজুয়ান মারুফ, সৈয়দ হিলাল সাইফ।

অনুষ্ঠানে বিলেত প্রবাসী ৩৫ জনের অধিক কবি স্বরচিত কবিতাপাঠ করেছেন- গোলাম কবির, আহমদ ময়েজ,দিলু নাসের, কুতুব আফতাব,সৈয়দ রুম্মান,জাহাঙ্গীর রানা, মজিবুল হক মনি, ইকবাল হোসেন বাল্মীকি,মোহাম্মদ ইকবাল, আহমদ হোসেন বাবলু ,জামিল সুলতান,উদয় শংকর দুর্জয়,এ কে এম আব্দুল্লাহ,এম মোশাহিদ খান, শাহ সুহেল,কাইয়ুম আব্দুল্লাহ,মোহাম্মদ মুহিদ,আসমা মতিন,গোলশান আরা রুবি, জাকারিয়া রিপন, বাসেরা ইসলাম রেখা,সাইম খন্দকার,কামরুল বশির,শামীম আহমেদ,নজরুল ইসলাম, শেখ সামসুল ইসলাম,ফারাহ নাজ,সাইফুদ্দিন বাবর, বেগম নুরুন নাহার ইসলাম,আফসানা আহমেদ,শামসুল ইসলাম শাহ আলম, আফসানা ইসলাম প্রমূখ।

সংহতি সহ সভাপতি ছড়াকার রেজুয়ান মারুফ বলেন- বিলেতে বাস করা অনেক লেখক আছেন বাংলা সাহিত্যে উচ্চারিত। আমাদের নতুন প্রজন্মরাও ভালো লিখছে।গ্রন্থমেলাটি লেখক-পাঠকের মধ্যে শুধু মেলবন্ধনই করে দেয়নি। পাঠক সমাবেশ ও বর্ণাঢ্য অনুষ্টানের মাধ্যমে লেখক-পাঠকের মধ্যে আত্নিক সম্পর্ক তৈরী করতে পেরেছে।

সংহতির ধারাবাহিক সাহিত্য, সংস্কৃতিবান্ধব কর্মকান্ত তুলে ধরেন সংগঠনের যুগ্মসম্পাদক কবি তুহীন চৌধুরী।

প্রতিষ্টালগ্ন থেকে বিষয় ভিত্তিক বইসহ অন্যান্য প্রকাশনা, বিলেতে বহুবাসী কবি লেখকদের সাথে বাংলাভাষি লেখকদের কাজ ও সংহতির উদ্যোগে পরিচালিত মৌলিক কর্মকান্ড এর সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন সাহিত্য সম্পাদক কবি শামীম শাহান।

‘২০১৭ সালের একুশে বই মেলা ও পরবর্তী সময়ে বিলেতবাসী চল্লিশ জন লেখকদের পয়তাল্লিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে ২১ জন লেখকের বই এর মোড়ক উন্মোচন লেখকদের সাথে নিয়েই করা হলো। এবারের মেলায়, বিলেতের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১০০জন লেখকদের গ্রন্থমেলায় সম্পৃক্ত করতে সংহতি সক্ষম হয়েছে। এবং নিকট ভবিষ্যতে ইউরোপের লেখকদেরও সম্পৃক্ত করা হবে’- সংহতির পরিকল্পনার কথা বলেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক কবি সাংবাদিক আনোয়ারুল ইসলাম অভি।

সংহতির সাবেক সভাপতি ইকবাল হেসেন বুলবুল- সংহতি গ্রন্থমেলা ও লেখক সমাবেশ প্রবাসীদের কাছে বই পড়া এবং বাংলা সাহিত্যকে জানার একটা সুযোগ সৃষ্টি করেছে।কঠিক কাজটি ধারাবাহিক ভাবেই করছে সংহতি। জানা এবং জানাবার বিয়টি গ্রন্থমেলা সহজ করে দিল।

সংহতির ধারাবাহিক কাজের প্রত্যয় ব্যক্ত করে সংহতির সভাপতি ফারুক আহমেদ রনি বলেন- ৮০দশকে বর্ণবাদ আন্দোলন ও কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু গুলোতে সংহতি অগ্রভাগে থেকে কাজ করেছে। সংহতি কবিতা উৎসবের মতো সংহতি গ্রন্থমেলা- আমাদের একটি ধারবাহিক কাজ। আগামীতে আরও বড় কলবরে নতুন প্রজন্মদের অংশগ্রহনেই আয়োজন করা হবে।

সংহতি সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থমেলাকে সামনে রেখে সংহতি: নির্বাচিত কাব্য সংকলন-৩ প্রকাশ করে।সংহতির সদস্যদের নিয়ে মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিবৃন্দ।

প্রসঙ্গত এটি সংহতির নবম প্রকাশিত গ্রন্থ।
এছাড়াও দিনব্যাপি অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন- সংহতির কোষাধক্য হেলাল উদ্দিন,সাংবাদিক আব্দুল কাদির মুরাদ,কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ, এম মোশাইদ খান, কবি মোহাম্মদ ইকবাল,মুনিরা পারভিন,শাহেদ চৌধুরী, ইকবালুল হক।

অনুষ্টানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- সাংবাদিক আবু মুসা হাসান, লেখক ফারুক আহমদ,সাংবাদিক আসম মাছুম,সুশান্ত দাস,তাইছির মাহমুদ,ইব্রাহিম খলিল, মোস্তাক বাবুল,রেজাউল করিম মৃধা,গোলাম কিবরিয়া, গীতিকার আশরাফ নেছওয়ার,লেখক দিনার হোসেন,রাজনীতিক ছায়াদ আহমদ সাদ, লুৎফুর রহমান ছায়াদ, সাদেক খান এবং সংহতি সাহিত্য পরিষদের মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল,সেলিম উদ্দিন,সৈয়দা নাজমীন চৌধুরী, কবি শাসসুল হক শাহ আলম, নজরুল আলম আনাই প্রমূখ।

গ্রন্থমেলার দিন কবি শামীম শাহানের ছিল জন্মদিন। লেখক সমাবেশে সংহতি ও কবিতা স্বজন এর উদ্যোগে সৃজনআবহে শুভেচ্ছা বার্তা ও কেক কেটে কবির জন্মদিনকে প্রাণজ করে রাখা হয়।

উল্লেখ্য সংহতি ১৯৮৯ সাল থেকে বিলেতে বাংলা ভাষা,সাহিত্য সংস্কৃতি এবং বহুভাষাভাষী লেখক ও সংগঠকদের সাথে কাজ করছে। দেশের বাইরে ধারাবাহিক বড় কবিতা উৎসব করে আসছে দুই হাজার আট সাল থেকে।

বিলেতের সাহিত্যপাড়ায় দুই হাজার পনের সালে প্রথম সংহতি গ্রন্থমেলা ও লেখক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।আগামী বছর থেকে ইউরোপে বসবাসকারী বাংলাভাষী লেখকদেরও এইমেলায় সম্পৃক্ত করা হবে বলে সংহতি সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

Advertisement