লন্ডনে স্মরণসভা : প্রিয়জন হারানো বসনিয়ানদের সাথে আমরা আছি

বসনিয়ার স্রেবরেনিসা গণহত্যার ২৬ বছর পার হয়েছে গত ১১ জুলাই। ১৯৯৫ সালের এই দিনে সার্ববাহিনী একরাতে ১০ হাজারেরও বেশি মুসলমানকে নির্মম কায়দায় হত্যা করেছিলো।এরপর থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ, ইসলামিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দিবসটি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আসছে। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত মুসলমানদের গর্ত করে মাটিচাপা দেয়া হয় । সেই লাশগুলো খুঁজে বের করে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণ শেষে প্রতি বছর হত্যাকাণ্ড দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাজা ও দাফন করা হয়। এবার ১১ জুলাই ২৬তম গণহত্যা দিবসে ১৯জনের লাশ শনাক্ত করার পর জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ১২ জুলাই সোমবার ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও বসনিয়া হ্যারিটেজ ফাউন্ডশনের উদ্যোগে এক ভার্চ‌্যুয়াল স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় । ইস্ট লন্ডন মসজিদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ও ড. আব্দুল্লাহ ফলিকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণসভার শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে অনুবাদসহ তেলাওয়াত করেন তুরস্কের হাজিয়া সুফিয়া গ্রান্ড মসজিদের ইমাম শায়খ ফেররুহ মোস্তার। কুরআন তেলাওয়াত শেষে এবারের শনাক্ত করা ১৯ শহীদের নাম পড়ে শোনানো হয়।
স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন বসনিয়া হারজেগোভিনার কাউন্সিল অব মিনিষ্ট্রিজ এর কাউন্সিলর ও সহযোগী অধ্যাপক ড. আদমির মুলোসমানোভিস, বৃটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির শ্যাডো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্ট এমপি, মানবাধিকার সংগঠন দাওয়ান এর নির্বাহী পরিচালক সারাহ হোয়াইটসন, বেথনাল গ্রীন ও বো আসনের লেবারদলীয় এমপি রুশনারা আলী, সারায়েভো ইউনিভার্সিটির হাদীস বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক হাফিজ ড. কেনান মিউসিস, আরবী ও রাশিয়ান ভাষার অনুবাদক সাংবাদিক আয়েশা হাফিজোবিস, বসনিয়া হারজেগোবিনা ইসলামিক কমিউনিটির ফরেন এফেয়ার্স এন্ড ডায়াসপরা ডিপার্টমেন্টের অফিস প্রধান ড. দিবাদা সুসকো ও মুসলিম কাউন্সিল অব বৃটেনের সেক্রেটারি জেনারেল জারা মাহমুদ।

এতে গণহত্যা নিয়ে রচিত কবিতা ‘দ্যা সাইলেন্স’ আবৃত্তি করেন লন্ডনের কুইনমেরি ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইব্রাহিম দাইয়ান। এরপর স্রেবরেনিসা হত্যাকাণ্ডের আলোকচিত্র প্রদর্শনী করা হয়। সারায়েভোর বিখ্যাত ফটোগ্রাফার জাসমিন অ্যাগোবিস ছবিগুলো প্রদর্শন করেন । ইয়া ইলাহি জাতি পাকি (অহ মাই প্রিয় লর্ড) নামক নাশিদ পরিবেশন করেন সারায়েভো নোভা ব্রিকা মসজিদের ইমাম মোস্তাফা ইসাকোভিস। দোয়া পরিচালনা করেন শায়খ ফেররুহ মাসতোর।ড. আদমির মুলোসমানোভিচ বলেন, উনিশ শতকের গোড়া থেকেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে সার্বিয়ান রাজনৈতিক অভিজাত বা সার্ব রাজনৈতিক অভিজাতরা এই অঞ্চলটিকে বিশুদ্ধ করার নামে দেশ থেকে মুসলমান ও ইসলামকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করে আসছে।গত দু’শো বছর ধরে, আমরা বলতে পারি যে বৃহত্তর সার্বিয়ান মতাদর্শ ভিন্নমতকে মেনে নিতে পারছে না । তারা সংঘটিত অপরাধ ও নৃশংসতার জন্য দায় স্বীকার করছে না।

রুশনারা আলী এমপি বলেন, বসনিয়াতে যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছে এবং যারা এখনও আক্রান্ত হচ্ছে তাদের সাথে আমরা আছি। আমরা সকলেই এখানে সমবেত হয়েছি বসনিয়ানদের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে, তাদের প্রতি আমাদের সংহতিবোধ বাড়াতে। আমরা দেখছি সমাজ পুনরুদ্ধার এবং পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।যারা এই নৃশংসতার আদেশ দিয়েছিলো আমরা যদি তাদেরকে জবাবহিদী করতে না পারি তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসাবে আমরা একটি বিপজ্জনক বার্তা প্রেরণ করবো যে, গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূলকরণ সরকারীভাবে গ্রহণযোগ্য।ক্যাথারিন ওয়েস্ট এমপি বলেন, যদি আমরা ভবিষ্যতের প্রতি নিজেদেরকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে পারি এবং সেই শান্তি রচনার জন্য নিজেকে ধনী অর্থনীতি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারি, তবে আমি মনে করি যে, আমরা সামগ্রিকভাবে আরও সুরক্ষিত একটি বিশ্ব এবং এমন একটি দেশে পরিণত হব যেখানে আমরা সত্যিকার অর্থে মানবাধিকারের বিষয়টি বলতে পারবো।

এমসিবির সেক্রেটারি জেনারেল জারা মোহাম্মদ বলেন, আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব যে, কেবল বইয়ের পাতায় বা যারা মারা গেছেন তাদের কবরেই ইতিহাস চাপা পড়ে থাকবে না। মুসলিম কাউন্সিল অব বৃটেনের সর্বকনিষ্ঠ নেতা হিসেবে আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত এবং এটি সত্যই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এটি এতটাই মৌলিক যে আমরা সকলেই সেই পরিবর্তনের অংশ এবং আমরা এই গল্পগুলি তরুণদের সাথে ভাগ করে নিতে হবে। তাদেরকে আশাবাদী ও অনুপ্রাণিত করতে হবে। সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে এখানে আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে । আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে।

ইস্ট লন্ডন মসজিদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা এই ভার্চ্যুয়াল স্মরণসভায় সমবেত হয়েছি স্রেবরেনিসা গণহত্যায় নিহত ১৯ শহীদের দাফনের মাত্র একদিন পরে। আপনারা অনেকেই হয়তো ১১ জুলাই স্রেব্রেনিসার স্মরণসভার খবর টেলিভিশনে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ঝলক দেখেছেন । যুক্তরাজ্য সেদিন ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এরপরও আমরা সার্ব বাহিনীর হাতে খুন হওয়া স্রেব্রেনিসার সেই সাহসী মানুষদের ভুলে যাইনি ।প্রকৃতপক্ষে আমরা জানাজা, দাফন, কুরআন তিলাওয়াতের দৃশ্য দেখলাম । আমরা পরিবারের সদস্যদের গালে কান্নাও দেখেছি যারা স্রেবরেনিসায় গিয়েছিলেন তাদের প্রিয়জনকে চূড়ান্ত বিদায় জানানোর জন্য। তবে অন্যদের জন্য এটি এখনও একটি দীর্ঘ অপেক্ষা । যারা ২৬ বছর পরেও জানেন না যে তাদের প্রিয়জন কোথায়।সুতরাং আজকের এই স্মরণসভা থেকে আমরা আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত- আমরা ইতিহাসের এই ন্যাক্কারজনক অধ্যায় থেকে কী শিখলাম- যা ইউরোপেরই কেন্দ্রবিন্দুতে ঘটেছিলো।

Advertisement