জারুলের ফাঁক গলে একঝলক রোদ এসে পড়লো অর্পার চোখে। ভীষণবিরক্ত হলো ও। ওর স্বভাবটাই এমন। অকারণে কেউ ওকে বিরক্ত করলে কিছুতেই তা মেনে নিতে পারেনা। এমনিতেই ভরদুপুরে ক্লাস নিতে নিতে ক্লান্ত তার উপর চারপাশ কেমন যেন থমথমে, রিকশা গাড়ির লেশমাত্র নেই। মনে হচ্ছে হেঁটেই যেতে হবে অনেকটা পথ। বাসায় ফিরে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামাতেই মায়ের উৎসুক আর রহস্যের হাসিমাখা মুখটা দেখে বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর সমস্ত দেহ মনে। বুঝতে বাকি থাকলো না মা আবার নতুন কোন ছেলের খোঁজ পেয়েছে আর শতভাগ পছন্দও করে ফেলেছে।
বিকেলে চায়ের ফাঁকে ব্যালকনিতে গাছেদের সাথে গল্প করতে করতে হাতে পেয়ে গেল সেই একটি ছবি। মা আলতো করে চুল বুলিয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ছবিটি। ছেলেটির নাম রুদ্র। সব মিলিয়ে মন্দ নয় ভাবলো অর্পা।
আজ ফুলেদের সুঘ্রানে পুরো বাড়িটা মোহময় হয়ে উঠেছে যেন। আজ যে অর্পার পান চিনি ! আর ছয়মাস পরেই নাকি অর্পার বিয়ে। নিজের কানকেই যেন সে বিশ্বাস করতে পারলোনা। সারাজীবন কতই না স্বপ্ন তার এ নিয়ে!
ফোনে কথা হয়, দেখাও হয় মাঝে মধ্যে রুদ্রের সাথে কলেজ শেষে। ইদানিং কী যেন হয়েছে অর্পার। প্রায়ই রান্নাঘরে ঢুকে পরে আনমনে, সে কী তবে বরের জন্য রান্না শিখতে চায় ?
সেদিন কিচেনে মুরগি বিরিয়ানি রান্না করতে গিয়ে অর্পা আবিষ্কার করলো ওর ডান কব্জির ওপরে একটি ছোট্ট সাদা বিন্দুর মতো দাগ। আর বারবারই চোখ যাচ্ছে ঐ ছোট্ট দাগটির উপর।
….কীরে অর্পা ? তোর হাতে ওটা কীসের দাগ ?
….জানিনা তো মা। এখনই চোখে পড়লো। থাক বাদ দাও তো।
মা ও মেয়ের দুজনের মনটি কেমন যেন উসখুস করতে লাগলো। দু‘দিন পার হতে না হতেই ঐ দাগটির পাশে আরও একটি ছোট্ট সাদা দাগ চোখে পড়লো তার। আর তা দেখে অর্পা দৌঁড়ে গেল মায়ের কাছে।
…. দেখ মা, আরও একটি সাদা দাগ ভেসে উঠছে ঐ দাগটির পাশে।
….বলিস কী রে ? দেখিতো। চল আজ সন্ধ্যাই তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
সেদিন সন্ধ্যাই গেল ওরা ডাক্তারের কাছে। ঔষধ খেলেই যে সেরে যাবে তা তিনি বলেন নি। সেই দাগগুলোতে লাগানোর জন্য একটি ক্রিম ও মুখে খাওয়ার জন্য কিছু ঔষধ দিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তার পুরো শরীরের বিভিন্ন স্থানে সাদা দাগ বেড়েই চলছে। খুবই মন খারাপ ওদের সবার। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে ওর শ্বেতী রোগ হয়েছে।
অর্পার শ্বেতী রোগ হয়েছে আর তাকে উদ্ভট দেখাচ্ছে এজন্য সে কোথায় লুকাবে ভেবেই পায়না। এক পর্যায়ে সে সকলের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য বোরখা পরা শুরু করলো। আর ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছু ইসলামিক কথা বলে থাকে। কারণ সে সকলকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে, সে এখন ইসলামিক চেতনায় উজ্জ্বীবিত। একদিন কলেজে শেষে রুদ্রের সঙ্গে ঘুরতে বের হলো।
….আরেহ্ অর্পা, হঠাৎ করে পর্দা শুরু করলে যে।
….হুম, ভাবছি এখন থেকে বোরখাই পরবো। মরতে হবে না। কখন যে ওপারের ডাক চলে আসে। এ ভেবেই পর্দা শুরু করলাম।
…. বাহ ভালোই তো। হঠাৎ তুমি নিজেকে এতটা পরিবর্তন করতে পারবে আমি ভাবতেই পারিনি।
অর্পার বিয়ের দিনক্ষণ প্রায় কাছাকাছি। কথা নেই বলা নেই এমনিতে তার হবু শাশুড়ি এক সন্ধ্যায় হাজির তাকে দেখার জন্য। তিনি তাকে এ অবস্থায় দেখে তো রীতিমতো হতবাক!
…. এ কী অর্পা, তোমার শরীরে এসব কী ? তুমি যে শ্বেতী রোগী। অসম্ভব, এ শ্বেতী রোগীর সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে হতে পারেনা।
….আপা, একটু শোনেন প্লীজ, এ বিয়েটা আপনি ভেঙে দেবেন না। আমি যে কোথাও মুখ দেখাতেই পারবোনা। আর আমার অর্পা যে গত পাঁচ মাস যাবত কত স্বপ্নই না বুনছে।
….চুপ থাকুন, এ বিয়ে হবেনা, ব্যাস।
অর্পার মনে হলো পুরো আকাশটাই যেন ওর মাথার উপর ভেঙে পড়লো। কষ্টে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তা স্বপ্নময় বুকটা। এতদিন ধরে যে লালিত স্বপ্ন সে বুনছিল তা মুহূর্তেই ভেঙ্গে চূরমার হয়ে গেল।
ক‘দিন ধরে আরও একটি কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছিল। তার খুব আদুরের মুরগির বাচ্চা রুমঝুম। সেও মরে গিয়ে তাকে অনেক ভীষণ কষ্ট দিয়ে গেল। এসবকিছু মিলিয়ে একেবারেই স্তব্ধ অর্পা। শুধুমাত্র একটিই অপেক্ষা ছিল তার রুদ্রের একটি ফোনের। কিন্তু এ অপেক্ষাটি শুধু অপেক্ষাই রয়ে গেল।
অর্পার বড় বোন তাকে চিকিৎসা করানোর জন্য সুদূর অষ্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গেল। সেখানকার এক বাঙালি ডাক্তার রনক। শ্বেতী রোগ নিয়ে সে নিজেকে যেভাবে আড়াল করছে তা ভেবে ডাক্তার তো রীতিমতো হতবাক!
….কী হলো অর্পা? আপনি কেন নিজেকে এভাবে লুকিয়ে রাখছেন? কেনই বা আড়াল করে থাকছেন সবার কাছ থেকে? আর এটিতো কোনও ছোঁয়াচে রোগও নয়।
….ডাক্তার সাহেব, আমি সেরে উঠবো তো?
….দেখুন এ রোগের চিকিৎসা অনেক সময় সাপেক্ষ। পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাথমিক পর্যায় হলে সম্প্রতি আবিষ্কৃত Recap নামে ঔষধ এর সফল ব্যবহার আছে। সে সাথে Vitiligo Nature এবং Antigo খেতে হবে। এটি শ্বেতী রোগের মহাষৌধ। এতে মেলালিন সৃষ্টি হয়। যাই হোক, এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনাকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। আমার দেওয়া ঔষধগুলো চালিয়ে যান। আর নিজেকে স্বাভাবিকভাবে রাখুন।
….হুম, ঠিক আছে ।
অর্পাও চেষ্টা করতে লাগলো নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য। তাই সে বোরখা ছেড়ে নিজেকে সাজাতে চেয়েছে অষ্ট্রেলিয়ার ভীনদেশী সাদা চামড়ার মানুষগুলোর ভীড়ে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না। যতই দিন যেতে লাগলো ততই তার ব্যাকুলতা বেড়েই চলছে দেশে ফেরার। ভীনদেশীদের বন্ধন বলতে কিছুই নেই। এ কথা শুনে ডাক্তার রনক বলে উঠলো
….না, তা হয়না। আপনি দেশে ফিরে গিয়ে আবারো নিজেকে গুটিয়ে ফেলবেন। একটি কথা বলবো অর্পা?
….জ্বী বলুন।
আমি কী আপনার হাতটি ধরতে পারি? আর আমি আপনার হাতটি চিরকালের জন্যই ধরে রাখতে চাই!
….কী বাজে বকবক করছেন ডাক্তার সাহেব। আপনারা পুরুষ নামের জীবগুলো নিজেদেরকে একটা ভদ্রতা আর আধুনিকতার খোলসে মুড়িয়ে রাখতে পারেন মাত্র। কিন্তু ভেতরটা একই। কিন্তু যে বিশ্বাস আমার ভেঙে গেছে তা আর কখনও জোড়া লাগবেনা এবং এর দাগও যাবেনা।
….এভাবে বলছেন কেন অর্পা? সব পুরুষকে কিন্তু একই পাল্লায় ওজন করবেন না।
….হুম, পৃথিবীর সব পুরুষরাই একই রকম। পুরুষেরা প্রয়োজনে কাছে টানতে পারে আবার প্রয়োজন ফুরালে ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনা। আসলে আপনাদের মতো পুরুষেরা প্রয়োজন বুঝেন ভালোবাসা বুঝেন না। আর ভালোবাসার পবিত্র বন্ধন আপনাদেরকে বেঁধে রাখতে পারেনা।
….দেখেন অর্পা, আপনি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছেন। আর যা কিছু ভাবছেন তা একেবারেই আপনার ভ্রান্ত ধারণা।
…চুপ করুন। বারবার শুধু একই কথা বলছেন। এ শ্বেতী রোগের কারণে আমার বিয়েটা ভেঙে গেল! আমার বিয়ের পর যদি এ রোগটা হতো তাহলে আমার স্বামী কী আমায় ছেড়ে যেতে পারতো? ভালবাসার বন্ধনের কারণেই স্বামী–স্ত্রী একই ছাদের নিচে তাদের জীবনটা কাটিয়ে দেয়। আর যদি কোনও কারণে তাদের সন্তান না হয় তাহলে কিন্তু সে স্বামীই এ বন্ধন ছিড়ে আরেকটি বিয়ে করতে কুণ্ঠাবোধও করেনা। তাহলে ভালোবাসার বন্ধন কী শুধুই সন্তান? ভালবাসার বন্ধনের কোনও মূল্য নেই??
নিজেকে আর কত আড়াল করবে অর্পা? এসিড দগ্ধ নারীর মতো নাকি ধর্ষিতা কিশোরীর মতো? না নিজেকে আর ঢেকে রাখবেনা সে। যেমন তেমন করেই বাঁচবে সে। তার বাঁচা তো কোনও পুরুষের জন্য নয়, সে বাঁচবে নিজের জন্য।
ক্রমশ পুরুষবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছে বোধ হয় অর্পা ভাবে চারপাশের মানুষগুলো। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার দিনগুলো, একাকী ….
অনন্তকাল ধরে একাকীত্বের সাধ পেতে চায় সে। মানুষ ক‘দিন বাঁচে? কেন বাঁচে এত অল্পদিন! কত্তকিছু যে করার আছে তার ! ইদানিং অসহায় নিবেদিতাদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে সে।
মীরপুর, ঢাকা।