শিল্পের সংসারে, পাহাড়ের জঙ্গলে

:: রণজিৎ দাস ::

নেওড়া ভ্যালিতে এক আর্ট কর্মশালায় গিয়েছিলেন শিল্পী রণজিৎ দাস। তিনি লিখেছেন সেই অভিজ্ঞতা

পাহাড়ে উঠতেই মোটামুটি রাত হয়ে গেল। যখন ফিরছি এই যে পথটা ফ্লুরোসেন্ট কালারের, যেই আলোটা পড়ে গাড়ির, তার ভেতর দিয়ে দেখলাম ঘুর ঘুর করছে চার-পাঁচটা বুনো ছাগল। বলছি নেওড়া ভ্যালির কথা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত জাতীয় উদ্যান নেওড়া ভ্যালি।

৬ থেকে ১০ মার্চ। গ্যালারি কায়ার আয়োজনে বাংলাদেশি ১০ শিল্পীকে নিয়ে হয়ে গেল এই আর্ট কর্মশালা। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন নবীন আর প্রবীণের মিশেল। অগ্রজদের মধ্যে আমি ছাড়াও ছিলেন শামসুদ্দোহা, শেখ আফজাল ও শিশির ভট্টাচার্য্য। নবীনদের ভেতর ছিলেন আনিসুজ্জামান, সোহাগ পারভেজ, তারেক আজিম, আলপ্তগীন তুষার প্রমুখ। দুজন সাংবাদিকও ছিলেন আমাদের সঙ্গে—একাত্তর টেলিভিশনের শাম্মী এবং তাঁর চিত্রগ্রাহক স্বামী। আর গ্যালারি কায়ার পরিচালক শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী এবং কর্মকর্তা জামিল আহমেদ—তাঁরা কি না থেকে পারেন? ছিলেনও।

নেওড়া ভ্যালি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেশি দূরে নয়। হেলিকপ্টারে আধা ঘণ্টার মতো লাগে। পুরু বরফে চাওয়া পাহাড়। দেখার মতো সূর্যোদয়। ধীরে ধীরে হলুদ থেকে লাল হয়ে যায় পাহাড়ের পরিবেশ। সোনালি সৌধের মতো দেখায় তখন তাকে। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রঙের উন্মাদনা।

সবুজ নেওড়া উপত্যকা। পাইন, ঝাউ, বুনো বাঁশঝাড়ে আবৃত, পাখির স্বর্গ যেন। পর্যটকেরা ছুটে যায় পাখিদের সন্ধানে, গহিন বনে। আমরা ছিলাম নেওড়া ভ্যালি জাঙ্গল রিসোর্টে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে কটেজ, ডাইনিং, অফিস। ডাইনিংয়ে আমরা একসঙ্গে প্রাতরাশ, রাতের খাবার খেতাম। খাবারদাবার ছিল অপূর্ব। রিসোর্টের যিনি মালিক ভদ্রলোকের নাম পাল বাবু, বাঙালি। তাঁর স্ত্রী পাহাড়ি। ফলে আমরা পেয়েছি পাহাড়ি-বাঙালির মিশ্রিত আতিথেয়তা।

ছবি এঁকেছি প্রত্যেকেই। জলরঙেই বেশি। চারকোল, প্যাস্টেল, স্কেচ, লাইন ড্রয়িং। সবাই ধুমসে কাজ করেছেন। তরুণদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতাই লেগে গেল কাজের। পথে যেতে যেতে শেখ আফজাল, শিশির ভট্টাচার্য্যের গান, আলপ্তুগীন তুষারের শিস আনন্দ দিয়েছে।

ছোট পাহাড়ি গ্রাম। সন্ধ্যায় টিমটিমে আলো জ্বলছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে। নেপালি গোর্খারা আছে। এটি বৌদ্ধসংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। তবে খ্রিষ্টান, সনাতন নানা জাতিগোষ্ঠীর মিলিত বসবাস এখানে। এদের একটি বৈশিষ্ট্য, এরা শান্তিপ্রিয়। মন্দির থেকে সকালে ভেসে আসে অপূর্ব সব মন্ত্রের ধ্বনি। সেখানে কিছু দূর মসৃণ, কিছু দূর পাথুরে পথ এবড়োখেবড়ো। আদিম প্রকৃতিকে সংরক্ষণের প্রয়াস দেখা গেল। এলাকাটি ভীষণ পাথুরে। সেই পাথুরে পরিবেশের মধ্যে বুনো ফুল আর গুল্ম। আর ছিল সবুজ এবং সবুজের পাশ দিয়ে পাহাড়ি ঝরনা নেমে এসে পানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল রাস্তায়। চলতে চলতে দেখা যাচ্ছিল বনবিড়াল ও ময়ূর। এখানে বানর, ভালুক এবং বাঘও আছে।

পাঁচ দিনের এই কর্মশালার এক দিন সেদিন বৃষ্টি হলো, দুপুরের দিকে, বরফ পড়েছে ঘাসের ওপর। পাহাড়ে ছোপ ছোপ সাদা বরফ। আমরা অনেকেই ভাবতে পারিনি এমন বরফ এবং ঠান্ডার মুখোমুখি হতে হবে। কেউ কেউ লাভায় গিয়ে কিনে নিয়ে এলাম গরম কাপড়।

এই আর্ট কর্মশালার তরুণ শিল্পীদের কথা বারবার বলতে হয়, তাঁরা দারুণভাবে উপভোগ করেছেন কর্মশালাটি; বলা যায়, মাতিয়ে রেখেছেন। আর গ্যালারি কায়া এবং গৌতম চক্রবর্তীর পৃষ্ঠপোষকতা, তরুণদের নিয়ে তাঁর ভাবনা বরাবরের মতো এবারও মুগ্ধ করেছে আমাকে। বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্প আন্দোলনে গৌতমের অবদানকে আমি বড় করেই দেখি। কেননা, চিত্রকলার প্রসারে তাঁর নিষ্ঠা ও একাগ্রতা, রীতিমতো ঈর্ষণীয়।

প্রকৃতি আমাদের শিক্ষক। একঘেয়ে জীবন থেকে উত্তরণের জন্য তার কাছে যেতে হয়। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান করতে হয় প্রকৃতির কাছে। সেটা যদি পাহাড়ে হয় নির্জনতায় তাহলে যেন মনে হয়, ওখানে ধ্যানস্থ একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। এই জগতে মানুষজনের যে বসবাস, ছয় হাজার ফুট ওপর থেকে তাকে দেখলে মনে হয়, হায় কত তৃণসমই না মানুষ, কত ক্ষুদ্র জীব! আমরা যদি প্রকৃতিকে অবলোকন না করতে পারি, তার কাছ থেকে আন্দোলিত না হই, তবে কীভাবে আমরা সৃষ্টি করব?

Advertisement