সন্তানদের দ্বৈত নাগরিকত্ব : নিজে সচেতন না হলে সবক্ষেত্রে সরকারকে দোষা যাবে না

।। কামাল মেহেদী ।।
ব্রিটেনের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে স্বদেশের নাগরিক অধিকার বা নাগরিকত্ব নিয়ে একটা ফেকড়া বাঁধে প্রায় সময়েই। এ কারণে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনকে ঘষা-মজা করে বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের দেশের নাগরিকত্ব বহাল রাখার নিশ্চয়তা দেওয়ার চেষ্টা করে সরকার।
৫১ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে জন্মসুত্রে, (বাই বার্থ) পিতা-মাতার সূত্রে (বাই ডিসেন্টস) এবং প্রাকৃতিকভাবে (বাই ন্যাচারাইলেজশন)। আইনে এই তিন ক্যাটাগরির নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। এই তিন ক্যাটাগরির মধ্যে ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের সবচাইতে বেশি স্বার্থ নিহিত রয়েছে পিতা-মাতার সূত্রে অর্থাৎ বাই ডিসেন্ট নাগরিকত্বের উপর।

যদিও ২০১৫ সালে সরকার নতুন করে নাগরিকত্ব আইন প্রনয়ণের লক্ষ্যে দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনের একটি খসড়া তৈরী করেছে। প্রস্তাবিত আইনে দ্বৈত নাগরিকদের স্বার্থ-সংশিষ্ট বিষয়ে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের সন্তানদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বা নাগরিক অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে এতো জটিল কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে, যা সরাসরি প্রবাসীদের স্বার্থ বিরোধী মনে করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবিরা। আমার মনে আছে, এই প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি হাতে পাবার পর সহকর্মী ডক্টর জাকি রিজওয়ানা বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। এরপর ডক্টর জাকি আপা, ব্যারিষ্টার নজরুল খসরু এবং ব্যারিষ্টার নাজির আহমেদকে নিয়ে স্পষ্টভাবে প্রবাসীদের আপত্তির জায়গাগুলো চিহ্নিত করে তা চ্যানেল এসে রিপোর্টে তুলে ধরেছিলাম। এরপর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং কমিউনিটির শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা প্রথম মন্টিফিউরি সেন্টারে একটি গোল টেবিল বৈঠকও করেছিলাম। সেখান থেকে সবার মতামত এবং প্রস্তাব সংগ্রহ করে, বিকল্প প্রস্তাবনা হিসেবে সহকর্মী ডক্টর জাকি রিজওয়ানা এবং ব্যারিষ্টার নজরুল খসরু ঢাকায় গিয়ে তা আইনমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। গোল টেবিল বৈঠকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন আজিজ চৌধুরী। এরপর বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে লন্ডনসহ ইউকের বিভিন্ন শহরে এ নিয়ে সভা-সমাবেশ হয়েছে এবং সবাই স্ব স্ব প্রস্তাবনা লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের হাতে জমা দিয়েছেন।


২০১৫ সালের প্রস্তাবিত সেই নাগরিকত্ব আইনটি এখনো পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়নি। তবে ডক্টর জাকি রিজওয়ানা আনোয়ার এবং ব্যারিষ্টার নজরুল খসরু সব সময় বিষয়টির খবরা খবরও রাখছেন বলে আমি জানি।


কিন্তু সম্প্রতি ব্রিটেনের স্পেশাল ইমিগ্রেশন আপিল কমিশনের একটি রায় ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশীদের দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি আবারো আলোচনায় নিয়ে এসেছে। গত মার্চে এই রায়টি হয়েছে। সি থ্রি, সি ফোর, এবং সি সেভেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত তিন ব্রিটিশ নাগরিকের সাংকেতিক নাম। এর মধ্যে প্রথম দুজন মহিলা। আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া ভ্রমণের অভিযোগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাদের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করে হোম অফিস। সি সেভেন পুরুষ। একই অভিযোগে ২০২০ সালের মার্চে তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। কিন্তু তিনজনই স্পেশাল ইমিগ্রেশন আপিল কমিশনে আপিল করে তাদের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পান। যখন তাদের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করা হয় তখন তিন জনেরই বয়স একুশ বছরের উপরে। কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনে ব্রিদেশে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভুতদের ২১ বছর বয়স পর্যন্ত পিতা-মাতার সূত্রে (বাই ডিসেন্ট) বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকে। ২১ বছরের ভেতরে নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন না করলে পরবর্তীতে সেই অধিকার বা নাগরিকত্ব থাকে না। সি থ্রি, সি ফোর এবং সি সেভেন একুশ বছরের ভেতরে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করেনি। হোম অফিস যখন তাদের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করেছিল তখন তাদের বয়স ছির একুশ বছরের উপরে। তাই ১৯৫১ সালের আইন অনুযায়ী তারা আর বাংলাদেশের নাগরিক নন এবং ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নিলে তারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে। আর ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী কাউকে রাষ্ট্রহীন করার অধিকার কারো নেই। সূতরাং সি থ্রি, সি ফোর এবং সি সেভেনের পক্ষে রায় দেয় স্পেশাল ইমিগ্রেশন আপিল কমিশন।
ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ ব্যারিসষ্টার আবুল কালাম চৌধুরী এবং ব্যারিস্টার নাজির আহমদ জানালেন, ৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনসহ সব ধরনের সংশোধনী ও জারিকৃত সব প্রজ্ঞাপন এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই স্পেশাল ইমিগ্রেশন আপিল কমিশন সি থ্রি, সি ফোর এবং সি সেভেনের পক্ষে রায় দিয়েছে।
এখানে আলোচনায় আইএস বধু শামীমা বেগমের প্রসঙ্গটিও এসেছে। শামীমার বর্তমান বয়স ২১ বছর। ১৯৯৯ সালের ২৫শে অগাস্ট তার জন্ম। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সাবেক হোম সেক্রেটারী সাজিদ জাভিদ যখন শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করেন তখন তার বয়স ছিল ২১ বছরের নীচে। শামীমার বাবা বাংলাদেশের গ্রামে বসে সংবাদ মাধ্যমে মেয়ের পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন তখন। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তিনি তাঁর মেয়ের দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্যে ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী আবেদন করেছিলেন কি না?
বাংলাদেশের বর্তমান আইন অনুযায়ী, ২১ বছরের ভেতরে পিতা-মাতার সূত্রে নাগরিকত্ব পাবার অধিকার থাকে। তবে সে জন্যে আবেদন করতে হয়। কিন্তু ২১ বছর বয়সের উপরে গিয়ে আবেদন করলে, নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে কি না তা সরকারের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে।
সি থ্রি, সি ফোর এবং সি সেভেনের রায়ের দিকে থাকালে শামীমার অবস্থান পরিস্কার হয়ে যায়। ২১ বছর বয়স পর্যন্ত পিতা-মাতার সূত্রে শামীমা বাংলাদেশের নাগরিক বলেই তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান নাগরিকত্ব আইনে আপাতত সি থ্রি, সি ফোর এবং সি সেভেনের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব রক্ষা পেলেও এর উল্টো চিত্র একবার ভেবে দেখুন তো! দেশে আপনার সহায়-সম্পত্তি রয়েছে। সম্পদ অর্জনের ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই সন্তানের ২২তম জন্মদিন পালন করলেন। কিন্তু একবারও খেয়াল হল না তার বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে! এরমধ্যে অবশ্য কয়েকবার সন্তানদের বাংলাদেশেও নিয়ে গেছেন, তখন তাদের পাসপোর্টে নো ভিসাও লাগিয়েছেন। জীবনের শেষাংশে গিয়ে মনে হলো, সন্তানের নামে সহায়-সম্পদ লিখে দিবেন কিন্তু তখন দেখা গেল আপনার সন্তান বাংলাদেশের নাগরিকই নয়! তখন আপনি কি করবেন?
সি থ্রি, সি ফোর এবং সি সেভেনের মামলার রায় প্রকাশের পর দ্বৈত নাগরিকদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব রক্ষায় উপায় কি? এবং নো ভিসা রিকোয়ার্ডের মাজেজা কি? এই দুটি বিষয় জানতে চেয়েছিলাম লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে। অনুরোধ করেছিলাম, হাইকমিশনের কাউকে ক্যামেরার সামনে এসে এ দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে। হাইকমিশনার ব্যস্ত থাকতেই পারেন। কিন্তু ফার্ষ্ট সেক্রেটারী বা সংশ্লিষ্ট যে কেউ ক্যামেরার সামনে এসে বক্তব্য দিতে পারতেন। কিন্তু না, সেটা হয়নি। আমরা কমিউনিটির স্বার্থে যখন কোনো কথা বলব, আর সেক্ষেত্রে হাইকমিশনের বক্তব্য প্রয়োজন হলে তখন চৌদ্দঘাট দেখানো হয় এখন! আমার স্পষ্ট মনে আছে, হাইকমিশনে যখন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইস্যুর সব যন্ত্রপাতি বসানো হয়, তখন আমি এবং সুবাস দা (ক্যামেরায় ছিলেন সুবাস দাশ) কয়েক ঘন্টা হাইকমিশনের ভেতরে ছিলাম। তখনকার ফার্স্ট সেক্রেটারী আমাদেরকে পুরো প্রক্রিয়াটি ঘুরে ঘুরে দেখান। এখন অবশ্য সময় বদলেছে। তো যাই হোক, শেষ পর্যন্ত একটা লিখিত জবাব আসে আমার কাছে।
বাংলাদেশে তিন ধরনের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। জন্মসূত্রে (বাই বার্থ), পিতা-মাতার সূত্রে (বাই ডিসেন্ট) এবং প্রাকৃতিক (বাই ন্যাচারাইলেজশন) এই তিন ক্যাটাগরি। আর আমরা কিন্তু কথা বলছি পিতা-মাতার সূত্রে (বাই ডিসেন্ট) নাগরিকত্ব নিয়ে।
হাইকমিশন থেকে ২০০৮ সালের জারিকৃত রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপন এবং ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনের সাথে একটি লিখিত বক্তব্যও পাঠানো হয়েছে। লিখিত বক্তব্যে নো ভিসা রিকোয়ার্ডকে একটি দীর্ঘ মেয়াদ ভিসা বা পারমিট বলে উল্লেখ করা হয়। এর মাধ্যমে যে কোনো সময় বাংলাদেশ ভ্রমণ এবং যতোদিন ইচ্ছে বাংলাদেশে অবস্থান করা যাবে। পাসপোর্টের মেয়াদের ফুরিয়ে গেলে নতুন পাসপোর্টে তা ট্রান্সফার করা যাবে। কিন্তু নো ভিসা নাগরিত্বের প্রমাণ নয়! নাগরিকত্ব প্রদানের যে কয়টি শর্ত রয়েছে তার মধ্যে অন্তত একটি শর্ত পূরণ করতে না পারলে নো ভিসা দেওয়া হয় না। অনেকেই হয়তো এই নো ভিসাকেই নিজেদের দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরে নিয়ে বসে আছেন।
ব্যারিষ্টার নাজির আহমেদ হাইকমিশনের এই বক্তব্য মানতে রাজি হননি। তাঁর মতে, যে ডকুমেন্টের উপর নির্ভর করে নো ভিসা দেওয়া হয় তা কোনো অংশেই নাগরিকত্বের চাইতে কম হতে পারে না। দ্বৈত নাগরিকত্বের যে কয়টি শর্ত আছে তার মধ্যে অন্তত একটি শর্ত পুরণ করতে হয় নো ভিসার জন্যে। তাই নো ভিসা নাগরিকত্বের চাইতে কোনো অংশে কম নয় বলেও মনে করেন তিনি। তবে এই ইস্যুতে হাইকমিশনকে পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ হয়নি। উপরেই বলেছি, লিখিত বক্তব্য এসেছে। ক্যামেরার সামনে পেলে হয়তো পাল্টা প্রশ্নের সুযোগ থাকত। তবে রামাদানের পরে এ নিয়ে আরো কথা বলা যাবে। আরো বিশেষজ্ঞদের মতামত জানা যাবে।

সি-থ্রি, সি-ফোর, সি সেভেন কিংবা শামীমা বেগম…হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। সবাই সন্ত্রাসী বা টেরোরিস্ট হয়ে যায় না। ব্রিটেনে আমাদের নতুন প্রজন্মের বিশাল একটি অংশ অহংকারের আলো ছড়াচ্ছে দেশে-বিদেশে। ব্রিটেনে তাদের জন্ম হলেও পিতা-মাতার সূত্রে দ্বৈত নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। অনেক পিতা-মাতা হয়তো মনে করছেন তাদের সন্তানও বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু আসলে কি তাই? না। সি থ্রি, সি ফোর এবং সি সেভেনের মামলার রায় থেকে অন্তত সেই শিক্ষা আমরা পেয়ে গেছি।
দেশের প্রচলতি নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, সন্তানের বয়স ২১ বছর পূর্ন হবার আগেই বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করা উচিত বলে জানালেন ব্যারিষ্টার নাজির আহমদ এবং ব্যারিষ্টার কালাম চৌধুরী। নিজে একটু সতর্ক হলে সন্তানরা দেশের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না বলে মনে করেন তারা।
একই সঙ্গে নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়াটি আরো সহজ করার জন্যেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এই দুই আইনজীবি মনে করেন, এটি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি উৎস হতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে সহজেই নাগরিকত্বের আবেদনের প্রক্রিয়া এবং নাগরিকত্ব প্রাপ্তির যে শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলোও যাতে খুব সহজে প্রবাসীরা পেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারলে সরকার এখান থেকে প্রচুর রাজস্ব আয় করতে পারবে বলে মনে করছেন এই দুই আইনজীবি।

লেখক : হেড অব নিউজ, চ্যানেল এস এবং সম্পাদক, ব্রিটবাংলা ২৪ কম। email : mehedi@chsuk.tv

 

 

Advertisement