সফলদের স্বপ্নগাথা, তোমাদের আমার হিংসা হয়

আমরা একই ধরনের চ্যালেঞ্জ ভালোবাসি বলেই, মনে হচ্ছে খুব কাছের মানুষদের সামনে কথা বলছি। এই ক্যাম্পাস আমার নিজের ঘরের মতো। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির প্রধান দায়িত্বে ছিলেন আমার বাবা। ছোটবেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি এই লাইব্রেরিতে। বইয়ের স্তূপের মধ্য থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে আমি পড়তাম, বিজ্ঞানের দুনিয়ায় নতুন কী এল, কী হলো। গ্র্যাজুয়েট কম্পিউটার সায়েন্স ল্যাবে কাটত অধিকাংশ সময়। সেখানে অবশ্য আমার থাকার কথা নয়। কারণ তখন আমি সবে হাইস্কুলে পড়ি। হাইস্কুলে পড়লে যা হয় আরকি, কিছুদিন পর আমি আমার বন্ধুদেরও লাইব্রেরিতে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করলাম। এই ঘটনার আগ পর্যন্ত অধ্যাপকেরা আমার উপস্থিতি মেনে নিয়েছিলেন।

আমাদের বের করে দেওয়ার জন্য কম্পিউটার ল্যাবের পরিচালক ড. হেলমিক গোল্ডি যে চিঠিটা লিখেছিলেন, সেটা আমার কাছে এখনো আছে। চিঠির কয়েকটা লাইন পড়লে আজও হাসি পায়। ‘প্রিয় মিস্টার অ্যালেন’ সম্বোধন দিয়ে শুরু হলেও চিঠির বাকি অংশে লেখা ছিল, কী কী কারণে তিনি আমাদের বের করে দিতে চান। প্রথম অভিযোগ: আমরা সবকটি টার্মিনাল দখল করে রাখতাম। আমাদের কোলাহলের কারণে বাকিদের কাজে অসুবিধা হতো। দ্বিতীয় অভিযোগ: আমার দুই বন্ধু যন্ত্রপাতি নেওয়ার নিয়মকানুন ঠিকভাবে মানেনি। তৃতীয় অভিযোগটা খুবই গুরুতর। অধ্যাপক লিখেছিলেন, ‘কয়েক দিন আগে বিনা অনুমতিতে তোমরা ড. হান্টসের অফিস থেকে অ্যাকোয়েস্টিক কপলারটা নিয়ে গেছ। এটা অপরাধ।’

অথচ আমরা ভেবেছিলাম, কেউ যখন যন্ত্রটা ব্যবহার করছে না, এটা বাড়িতে নিয়ে গেলে ক্ষতি কী! মজার ব্যাপার হলো, চিঠির শেষে অধ্যাপক লিখেছেন, ‘এমনকি তোমরা কপলারের জায়গায় একটা চিরকুটও রেখে যাওনি! এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’ এই কথা দিয়ে তিনি কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছেন।

সেই সময়ে আমি যদি পুরোনো কম্পিউটারে বুঁদ হয়ে না থাকতাম, যদি আমার আগ্রহের বিষয়টা সম্পর্কে যতটা সম্ভব জ্ঞান আহরণ না করতাম, হয়তো মাইক্রোসফটের জন্ম হতো না। এখানে শেখার বিষয় হলো, কখনো কখনো তোমার সামনে কোনো পথ থাকবে না। কখনো কখনো ভুল পথ তোমাকে ঠিক পথের দিকে ঠেলে দেবে। যদি শেখার নিরন্তর চেষ্টা থাকে, তাহলে তুমি নিশ্চয় সাফল্যের পথেই হাঁটবে।

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি নিয়ে কথা বলতে গেলে কর্মক্ষেত্রে এর প্রভাব সম্পর্কেও তোমাদের ভাবতে হবে। আমার কাছে মনে হয়, আমরা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই, তাহলে কোনো ঝুঁকিই পাত্তা পাবে না। উড়োজাহাজ যখন আবিষ্কৃত হলো, রেল শিল্পের ওপর সেটা প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মানবজাতির উন্নয়নের নতুন নতুন পথ খুলে দিয়েছে। যখন আমরা আরও বুদ্ধিদীপ্ত কম্পিউটারের সহায়তা পাব, এটা মানুষের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।

তোমরা যারা তরুণ কম্পিউটার প্রকৌশলী, তোমাদের আমার হিংসা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তোমরা তোমাদের জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছ। মুহূর্তেই তোমরা জটিল প্রোগ্রামিংয়ের কাজগুলো করে ফেলতে পারছ। হাতের কাছেই আছে সব সুবিধা। আমাদের সময়ে এটা কল্পনাও করা যেত না। ১৯৭২ সালে ছাত্রছাত্রীরা যে সিডিসি ৬৪০০ কম্পিউটার ব্যবহার করত, তার চেয়ে হাজার গুণ দ্রুত গতির যন্ত্র এখন তোমাদের পকেটে আছে। যে প্রোগ্রাম তোমরা ব্যবহার করছ, তার ক্ষমতা তোমার কল্পনার চেয়েও বেশি। অথচ আমরা যে কম্পিউটার ব্যবহার করেছি, তার ‘মেমোরি’ আর ‘স্টোরেজ’ ছিল খুবই স্বল্প।

তোমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী হতে পারে, সেটা নিয়ে কিছু কথা বলি। বর্তমানে মানুষের কারণে জলবায়ুর কী কী পরিবর্তন হচ্ছে, আর ভবিষ্যতে কী কী পরিবর্তন আসছে, তা নির্ণয়ে তোমরা কাজ করতে পারো। কার্বন নিঃসরণ ও দুর্ঘটনা রোধ করতে উন্নত যানবাহনের নকশা করতে পারো। এমন কোনো প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারো, যেটা সঠিকভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকদের সাহায্য করবে। জীববিজ্ঞান–সংক্রান্ত কোনো মডেলও তৈরি করতে পারো, যা কিনা কোষ বিশ্লেষণ করে সুস্থ শরীর ও রোগাক্রান্ত শরীরের মধ্যে পার্থক্য দ্রুতই শনাক্ত করতে পারবে। রোবটিকস নিয়ে কাজ করো, যেন কর্মক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে সহায়তা করতে আমরা রোবট ব্যবহার করতে পারি।

আমরা সত্যিই কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক স্বর্ণালি সময়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। তোমরাই এই সময়টার নেতৃত্ব দেবে। সাহসী হও, সত্যের পথে থাকো। বিশ্বাস আর দুঃসাহসই আমাদের মাইক্রোসফট গড়তে সাহায্য করেছিল। মনে রেখো, স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তুমি অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছ, এই অভিযোগে যদি কেউ তোমার দিকে আঙুল তোলে, তার মানে তুমি ঠিক পথেই আছো।

Advertisement