সর্বোচ্চ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ২০১৭ সালের বড় খবর

। । ড. আর এম দেবনাথ। ।

জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ আজ। সাল ২০১৮। ২০১৭ সাল পেছনে ফেলে ২০১৮ সালে। অর্থবছরের হিসেবে আরও ছয় মাস গেলে পরের বছর শেষ হবে। ক্যালেন্ডার বছর ২০১৭ শেষ হয়েছে মাত্র। কেমন গেল ২০১৭ সাল? রাজনৈতিকভাবে বছরটি ছিল স্থিতিশীল। সামাজিকভাবেও তাই। অর্থনৈতিকভাবে? অর্থনৈতিকভাবেও বছরটি ছিল স্থিতিশীল। অর্থনীতির সকল সূচকই ছিল স্বস্তিকর। যেমন মূল্যস্ফীতি। সরকারী হিসেবে মূল্যস্ফীতি ছিল ক্রমহ্রাসমান। বছরের মাঝখানে কিছুটা উদ্বেগ ছিল। কিন্তু শেষের দিকে মূল্যস্ফীতি নেমে আসে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২০১৭ সালের শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশে। গত অক্টোবরের তুলনায় অবশ্য তা ছিল বেশ কম। মূল্যস্ফীতির নিরিখে তাই বলা যায়, বছরটি শেষ হয়েছে স্বস্তির মধ্যে। কারণ, মূল্যস্ফীতির বিষয়টিই মানুষকে ভাবায় বেশি। আমদানি বাড়ল, রফতানি বাড়ল, বিনিয়োগ বাড়ল, বেসরকারী ঋণ বাড়ল, শিল্প উৎপাদন বাড়ল এসব খবর সাধারণ মানুষের কাছে বড় খবর, এসবে তাদের উৎসাহ কম। তারা বছর বোঝে কষ্টের নিরিখে। সেই হিসেবে ২০১৭ সালটি ছিল স্বস্তিরই, যদিও এ বছরেই অর্থনীতির ওপর দিয়ে দুটো বন্যার ঝড় বয়ে যায়। একটি ছিল অকাল বন্যা, অন্যটি ছিল নিয়মিত বন্যা। দুটো বন্যার কারণে অনেক ফসল নষ্ট হয়। এক হিসেবে ১৫ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত আমদানির। টাকা যায় বেশ। এটি ছিল অর্থনীতির ওপর বোঝা। খাদ্যের স্টক গড়ে তুলতে হয়। এই বন্যাজনিত বোঝা বাদে আরেকটি বোঝাও হঠাৎ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপে। আর সেটি হচ্ছে রোহিঙ্গার বোঝা। সাত লাখের অধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের খাওয়া-পরা, ওষুধ-চিকিৎসা ইত্যাদি বাবদ প্রতিমাসে খবর হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বলাবাহুল্য, এসব সমস্যা সত্ত্বেও অর্থনীতির পারফর্মেন্স ভাল। যেমন রফতানি। বছরের শেষের দিকের হিসেবে রফতানি বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। এটা জুলাই নবেম্বরের হিসাব। এই সময়ে রফতানি ১ হাজার ১১৩ কোটি ডলারের স্থলে ১ হাজার ৪৫৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।

রেমিটেন্স বেড়েছে কতটুকু? রেমিটেন্স বাড়েনি সেভাবে, তবে হ্রাসের গতি কমেছে। হিসাবে দেখা যায়, মোটের হিসাবে জুলাই-নবেম্বরে রেমিটেন্স তিন শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। পূর্ববর্তী বছরের জুলাই-নবেম্বরে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার, সেই তুলনায় ২০১৭ সালের জুলাই-নবেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৩৭ কোটি ডলার। আমদানির পরিমাণ অবশ্য বহুল পরিমাণে বেড়েছে। শেষের ৫ মাসে আমদানি ঋণপত্র বেড়েছে ৯০ শতাংশেরও বেশি। এর কারণ অবশ্য একটি বিশেষ ঋণপত্র। এটি রূপপুর আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের জন্য। আণবিক বিদ্যুতের জন্য যন্ত্রপাতির ঋণপত্র। এ কারণে মধ্যবর্তী বছরের ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলারের স্থলে ২০১৭ সালের জুলাই-নবেম্বরে ঋণপত্রের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৭৫ কোটি ডলার। অবশ্য এতে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে কিছুটা চাপ পড়েছে। এর বহির্প্রকাশ ঘটেছে ডলারের মূল্যে। ডলারের মূল্য উর্ধমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করছে। এতদসত্ত্বেও ডলারের দাম স্থিতিশীল হচ্ছে না। বহুদিন ডলারের দাম ৮১-৮২ টাকা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তা ৮৪-৮৫ টাকায় উন্নীত হয়। এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশের রুপীর ওপরও পড়েছে। তাদের কারেন্সির দাম টাকার তুলনায় বেড়েছে। এতে ভারত থেকে আমদানিকৃত চালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলারের মূল্য স্থিতিশীল করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কয়েকবার পদক্ষেপ নিয়েছে।

ব্যাংকগুলোকে তারা হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত খোলাবাজারে এর প্রভাব পড়েনি। অথচ ডলারের দাম উর্ধমুখী হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ, আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। অধিকন্তু আন্তর্জাতিক বাজার ইদানীংকালে আবার উর্ধমুখী বলে মনে হচ্ছে। এটি হলে আমাদের সাবধান থাকার আবশ্যকতা আছে। এ ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য, ২০১৭ সালটি ছিল ব্যাংকিংয়ের ওপর খবরে পরিপূর্ণ। নতুন ব্যাংকের নানা ধরনের অনিয়মের খবর ছিল প্রায় প্রতিদিন। দুই-তিনটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংক অপসারণ করেছে। ব্যাসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানকে ‘দুদকে’ ডাকা হয়েছে ২০১৭ সালেই। দৃশ্যতই এই খাতটি ছিল অস্থিতিশীল। তবে অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত শেয়ারবাজার ২০১৭ সালে খুবই ভাল করেছে। ‘ঢাকা স্টক একচেঞ্জে’ (ডিএসই) সূচক বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এই প্রথম সূচক ৬ হাজার অতিক্রম করেছে। বিদেশে বিনিয়োগও শেয়ারবাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘রাইট শেয়ার’ ইস্যু ২০১৭ সালে হয়েছে তিনটি। বহুদিন পর শেয়ারবাজারের এই খবর ইতিবাচক যদিও ‘স্পেকুলেটর’রা সময়ে সময়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে বলেও খবর আছে। সুখবর আছে বেসরকারী ঋণের ক্ষেত্রে। বেসরকারী ঋণবৃদ্ধিকে ব্যবসাবৃদ্ধির সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে বোঝা যায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ বেসরকারী ঋণ ক্রমেই বৃদ্ধির দিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেসরকারী ঋণ বৃদ্ধির টার্গেট যেখানে মাত্র সাড়ে ষোলো শতাংশের মতো, সেখানে অক্টোবর-নবেম্বর মাসে বেসরকারী ঋণবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯ শতাংশ। এটি আরেক হিসাবে ক্ষতিকর বৃদ্ধি। ঋণবৃদ্ধি বেশি হলে তা অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায়। ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করে ঋণ সম্প্রসারণ ক্ষতিকর হয়। ২০০৭-০৮ সালের দিকে তা একবার ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে সতর্কতা জারি করে রেখেছে। কারণ, এতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিদেশে টাকা পাচারের ঝুঁকি। নির্বাচন সামনে। কিছু ব্যবসায়ী চেষ্টা করবে বিদেশে টাকা পাঠাতে। এসব দুশ্চিন্তার বিষয়। ব্যাংক মালিকানাতেও বড় বড় পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক ব্যাংকের পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে ২০১৭ সালে। পরিবর্তন মানেই বড় লেনদেন। এসব লেনদেনে বিদেশী উপাদান থাকে। অতএব, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটা উদ্বেগের বিষয় ছিল বলে অনুমান করি। এদিকে আরেকটি ভাল লক্ষণ দেখা গেছে ২০১৭ সালে। আর সেটি হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের একই সময়ে তা ছিল মাত্র ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা মাত্র। এটা একদিকে যেমন সুখবর, তেমনি সতর্কতা অবলম্বনের আবশ্যকতারও খবর। কারণ, এ ঋণের ক্ষেত্রে দুটো ঘটনা ঘটছে। এতে অনেক অব্যবসায়িক বিবেচনাপ্রসূত ঋণও ঢুকে যাচ্ছে বলে খবর হচ্ছে। ফলে, এখাতেও খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আরও একটা অসুবিধা এখানে হচ্ছে। নামটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ (এসএমই) হলেও টাকার অঙ্কে কিন্তু খারাপ পরিমাণের ঋণ নয়। এখানে সংজ্ঞা একটা সমস্যা। বড় বড় ঋণও এই ‘এসএমই’তে ঢুকে যাচ্ছে। ‘এসএমই’ থেকে বড় খবর আছে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালে ১০ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে পাড়ি দিয়েছে চাকরি নিয়ে। এর মধ্যে সাড়ে ৫ লাখই গিয়েছে সৌদি আরবে। এক লাখ গিয়েছে মালয়েশিয়ায়। এই খবরে মনে হয় জনশক্তি রফতানিতে জট খুলতে শুরু করেছে। আর এটি হলে আমাদের বড় উপকার হবে। কারণ, রেমিটেন্স সার্বিকভাবে হ্রাসমান। অধিকতর জনশক্তি রফতানি হলে রেমিটেন্সের পরিমাণ হ্রাসের প্রবণতা কমবে। দ্বিতীয়ত, দেশীয়ভাবে কর্মসংস্থানের চাপও কিছুটা কমবে। অধিকতর রফতানি, কম আমদানি এবং অধিকতর রেমিটেন্সের ফল দেখা যায় রিজার্ভে। এই রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধির দিকে। এটা আমাদের একটা শক্তি। ২০১৭ সালে জানুয়ারি মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর ২৮ তারিখে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভ বৃদ্ধির কারণে ডলারের বাজার স্থিতিশীল থাকে। এই শক্তিতেই এখন একেকজন বাংলাদেশীকে বিদেশ ভ্রমণকালে পাঁচ হাজার ডলার দেয়া হয়। এমনকি এখন একজন বাংলাদেশী নাগরিক ৮ হাজার ডলার বিনা ঘোষণায় দেশে নিয়ে আসতে পারে এবং সেই ডলার বিনা ঘোষণায় বিদেশে নিয়ে যেতে পারে। এটা শক্তির লক্ষণ। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে ২৫ ডলার পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। অতএব, বোঝাই যায় আমাদের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি।

রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা ভাল করলেও টার্গেট অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। জুলাই-নবেম্বরে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৪ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। অথচ টার্গেট ছিল ৮৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। ভ্যাটের কালেকশনেও একই অবস্থা। সেই ক্ষেত্রেও গত বছরের তুলনায় বেশি কিন্তু টার্গেটের তুলনায় কম। তার মানে কি? টার্গেটটি অবাস্তব? নাকি রাজস্ব আদায়ে গাফিলতি? নাকি অর্থনৈতিক এবং ব্যবসায়িক পরিস্থিতি এমন যেখানে এত পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়। অর্থাৎ যে ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকা-ের ভিত্তিতে টার্গেট নির্ণয় করা হয়েছিল সেটাই ছিল অবাস্তব। জানি না কোনটা সত্য। তবে তা ঠিক করা দরকার। কারণ, প্রতিবছরই এসব ঘটছে টার্গেট অবাস্তব হলে কেউ কাজ করে না। কারণ, এ কথা জানা যে, অবাস্তব টার্গেটের পেছনে ঘুরে লাভ নেই। সার্বিকভাবে বলাই যায়, ২০১৭ ছিল স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল একটা বছর। এই বছরই সরকার ঘোষণা করে যে, ২০১৬-’১৭ অর্থবছরে সর্বোচ্চ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে।

Advertisement