সাফল্যেগাঁথা একজন জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ার

বিশেষ প্রতিবেদক : বিলেতে বাঙালী কমিউনিটিতে হুজ হু এখন একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ড। গত ১১ বছরে বিভিন্ন পেশার প্রায় ১২শ ব্রিটিশ বাঙালীর প্রোফাইল উঠে এসেছে হুজ হু’র পাতায়। যাদের জীবন বৃত্তান্ত অন্যদের অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। আর ২০০৯ সাল থেকে তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে কমিউনিটিতে বা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্নজনকে সম্মাননা জানিয়ে আসছে হুজ হু। লন্ডনে বাংলা মিরর সম্পাদক আব্দুল করিম গনি এর প্রবর্তক। অনুপ্রাণের উতস বলা যায় যাদের, এরকম প্রায় পয়ষট্টি জনকে এ পর্যন্ত এওয়ার্ড দিয়ে সম্মাননা জানিয়েছে হুজ হু।
বিলেতের বাঙালী কমিউনিটিতে এওয়ার্ডের প্রচলন অনেক আগে থেকেই। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এওয়ার্ড প্রদান করে আসছে। এরমধ্যে হুজ হু ব্যতিক্রম। রেষ্টুরেন্ট সেক্টরকে প্রাধান্য দিয়ে তথাকতিথ বাণিজিক্য এওয়ার্ড নয়, হুজ হু বিভিন্ন পেশাজীবিদের সঙ্গে বিলেতের বাংলা মিডিয়ায় কর্মরত বা কমিউনিটির মিডিয়া ব্যক্তিত্বদেরও মূল্যায়ন করে আসছে। বিশিষ্ট কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবি শামীম আজাদের মতো দেশে-বিদেশে খ্যাতনামা লেখক-সাংবাদিকদেরও এওয়ার্ড দিয়ে সম্মাননা জানিয়েছে হুজ হু।
গত বছর লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি সৈয়দ নাহাশ পাশাকে এওয়ার্ড দিয়ে সম্মাননা জানায় হুজ হু। বর্ষিয়ান এই সাংবাদিক দক্ষতার সঙ্গে প্রেস ক্লাবকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, এখনো নিউজের খুঁজে নিউজের পেছনে ঘুরেন এবং নিজ হাতে রিপোর্ট লিখেন। এবার প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিনকেও এওয়ার্ড দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছে। নাট্যকার, লেখক, সম্পাদক এবং সর্বোপরি একজন দক্ষ সংগঠক নবাব উদ্দিন। কমিউনিটি মিডিয়ায় কাজ করতে আগ্রহীরা সৈয়দ নাহাশ পাশা এবং নবাব উদ্দিনের জীবন থেকে অনেক কিছুই নিতে পারেন।
তবে এবার আমার কাছে হুজ হু এওয়ার্ড ব্যতিক্রম মনে হয়েছে কমিউনিটির সুপরিচিত এবং অনুপ্রাণিত হবার মতো আরো একজন ব্যক্তিকে সম্মান জানানোয়। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার পরিচিত মুখ ডক্টর জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ার। আমার কাছে মনে হয়েছে, অনুপ্রাণিত হবার মতো ব্যক্তিদের সম্মাননা জানানোর ক্ষেত্রে ডক্টর জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ারকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে হুজ হু যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা অনেকাংশেই সফল হয়েছে এবার। এ জন্যে হুজ হু টিম ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।


এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ডক্টর জাকিকে এওয়ার্ড প্রদানের মাধ্যমে এমন আলাদা কী আছে? আমি কাউকেই বা কারো অবদানকেই ছোট করে দেখছি না। হুজ হু’র পাতায় গত ১১ বছরে যাদের প্রোফাইল ছাপা হয়েছে এবং যাদেরকে এওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে আমাদের অনুপ্রেরণরা উতস হয়ে আছেন বা থাকবেন। কিন্তু বহুগুণে গুণান্বিতা ডক্টর জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ারের মত মহিলা আমাদের কমিউনিটিতে ক’জন আছেন শুধুমাত্র এ কথাটা জানান দেওয়াই আমার লিখার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে ডক্টর জাকির জীবন বৃত্তান্ত থেকে আমাদের কমিউনিটির অন্যান্য মহিলাদের শক্তি এবং অনুপ্রেরণা দেওয়া। শুধু তাই নয় জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেও কিভাবে সসন্মানে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় এবং জীবনকে এবং সমাজকে অর্থবহ করে তোলা যায় সে ব্যাপারে ডক্টর জাকির ব্যক্তিত্ব আমাদের কমিউনিটি তথা সমাজে অনেক মহিলার জন্য আজ রোল মডেল।
বৃটিশ বাংলাদেশী স্বনামধন্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত মুষ্ঠিমেয় ক’জন নারীর নাম করলে যার নাম এসে যায়, তিনি হলেন ডক্টর জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ার। একাধারে চিকিৎসা বিজ্ঞান, মিডিয়া ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বৃটিশ বাংলাদেশীদের কাছে তিনি একজন অত্যন্ত প্রিয় মুখ।


বাংলাদেশ টেলিভিশনে অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পর পর পাঁচ বছর দলনেত্রী হিসেবে তার দলকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার সন্মান অর্জন করেছিলেন। তার সংবাদ পাঠের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা রেডিওতে ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তারপর বিরতিহীনভাবে তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, বাংলা টিভি ও বর্তমানে চ্যানেল এস-এ। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যাস কমিউনিকেশন থেকে তিনি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সংবাদ তৈরী ও সংবাদ পরিবেশনের উপর লংকোর্সে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সংবাদ পাঠে ডক্টর জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ারের অনন্য অভিজ্ঞতা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ তাকে বৃটিশ বাংলাদেশী মিডিয়ায় সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে একটি অন্যরকম স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। বেষ্ট ফিমেল নিউজ কাষ্টার হিসাবে  ঈষ্টউড এওয়ার্ড প্রদান করা হয় তাঁকে। এছাড়া অল ইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অব আমেরিকা ও বিবিসি-টুতে তার কাজের ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বৃটেনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং ক্যাটরিং সার্কেলসহ দু’টি সোশাল এন্টারপ্রাইজে তিনি মেন্টরিং করছেন।


বহু বছর ওস্তাদ আখতার সাদমানীর কাছ থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নেওয়া ডক্টর জাকি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘নতুন কুঁড়ি’ অনুষ্ঠানে কয়েকবার জাতীয় পুরস্কার পেলেও পরবর্তীতে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও পাশাপাশি সাংবাদ পাঠকে বেশী গুরুত্ব দেওয়ায় সংগীত জগতে তার পদচারনা কম দেখা যায়। তবে তিনি এখনও গানের চর্চ্চা করেন এবং তার সংগীত জ্ঞানটুকু নিজের মেয়ের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

প্রাথমিক স্কুল থেকে শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি মেধা ভিত্তিক বৃত্তি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। ঢাকায় এমবিবিএস পাশ করার পর লন্ডনে ডি টি এম এন্ড এইচ করার জন্য তিনি বৃটিশ কাউন্সিল স্কলারশিপ পান, তারপর মাদার এন্ড চাইল্ড হেলথে এম এস সি করার জন্য ড্যানিডা স্কলারশিপ পান এবং সবশেষে পি এইচ ডি করার জন্য কমনওয়েলথ স্কলার হিসাবে সন্মানজনক কমনওয়েলথ স্কলারশিপ অর্জন করেন। গ্ল্যাক্সো স্মিথ ক্লাইনের অর্থায়নে বৃটেনের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ ও ঢাকার আই সি ডি ডি আর বি-র কোলাবোরেশনে টাঙ্গাইলে আয়োডিনের অভাবজনিত পুষ্টিতে ভোগা গর্ভবতী মা ও শিশুদের উপর ডক্টর জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ারের প্রজেক্টি বিবিসি-র প্রখ্যাত সংবাদ পাঠক মাইকেল বাকের নেতৃত্বে বিবিসির একটি টীম পরিদর্শনে যায়, যা পরে বিবিসি-টুতে ‘দ্য রেইন প্লেগ’ নামে একটি ডকুমেন্টরি হিসেবে দেখানো হয় এবং যা প্রিন্সেস এ্যন কর্তৃক বছরের তিনটি গবেষণামূলক প্রজেক্টের মধ্যে একটি হিসাবে স্বীকৃতি পায়। একশন ফর সেইফ মাদারহুড ইউকে-র – প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা হিসেবে তিনি ব্রাজিলের মাতৃ-মৃত্যু হার হ্রাস প্রজেক্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং গ্যম্বিয়ায় এফ জি এম (ফিমেইল জেনিটাল মিউটিলেশন)-এর বিরূদ্ধে ক্যাম্পেইনে গ্যম্বিয়ার কয়েকটি এনজিও-র সাথে কাজ করেছেন। তিনি গ্লাসগোতে ইউনেস্কো, ওয়ারিক ইউনিভার্সিটিতে বৃটিশ প্যাডিয়াট্রিক এসোসিয়েশনে ও লন্ডনে থ্রী এফ এফ এবং বাংলাদেশে ডাব্লিউ এইচ ও এবং এশিয়ান নিউট্রিশন কংগ্রেসে গেষ্ট স্পিকার হিসাবে বক্তব্য রাখেন। ল্যন্সেট, ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিকাল নিউট্রিশন এবং রয়েল সোসাইটি ফর ট্রপিক্যাল মেডিসিনে তার গবেষণালদ্ধ উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে।

পেশাগত ও সংবাদ পাঠের বাইরে তিনি জনসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে আসছেন সব সময়। জি এস সি-র সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটির মহিলা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সেক্রেটারি হিসাবে তিনি বৃটেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘হার্ড টু রিচ’ মহিলাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যজ্ঞান সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। স্বামী ডা: আনোয়ার সাঈদ উদয়ের আকস্মিক অকাল মৃত্যুর পর থেকে তিনি ইক্বরা ইন্টারনেশনালের সহায়তায় সিলেটের জালালাবাদে বিধবা প্রজেক্ট প্রতিষ্ঠা কোরতে যান এবং টাঙাইলে আরেকটি বিধবা প্রজেক্টে তিনি সাহায্য কোরছেন। অকাল বিধবাদের সসন্মানে নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে বাঙালি নারী সমাজের কাছে ডা: জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ার একজন রোল মডেল।

তিনি বাংলাদেশে ‘জাকি রিজ্ওয়ানা স্কলারশিপ নামে দরিদ্র এতিম মেধাবী কন্যা শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে সহায়তা কোরছেন। এছাড়া বন্যার্তদের, চিকিৎসা বা যে কোনো মানবতার কাজে সহজেই তিনি এগিয়ে আসেন। তিনি লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সদস্য এবং ছাত্রী জীবনে রোটারেক্টর ক্লাবের প্রচার সম্পাদিকা হিসেবে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন (রক্ত ও চক্ষুদান) প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের দরিদ্র রোগীদের জন্য মেডিসিন ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে, মানুষ মানুষের জন্য এবং ইকরা ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবন্ধী শিশু, সেন্টার ফর রিহেবিলিটেশন অব প্যারালাইজডকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য দিয়ে আসছেন। ডা: জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ারের সমাজ সেবামূলক কাজের জন্য তিনি মেয়র সিভিক এওয়ার্ড লাভ করেন।


ডা: জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ার বৃটিশ বাংলাদেশীদের দৈত্ব নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের ব্যাপারে চ্যানেল এসে প্রথম জনমত গঠনের ব্যাপারে কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে আইন মন্ত্রীর সাথেও এ নিয়ে আলোচনা কোরতে যান এবং এখনো এই বিলটি আইনে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ বিষয়টির ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে খোঁজখবর রাখছেন।

সম্প্রতি তিনি তার সোশাল মেডিসিন ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে ‘কে ও এইচ বি’ (কীপ আওয়ার হার্টস বিটিং) নামে তার নতুন সোশাল এন্টারপ্রাইজের যাত্রা শুরু কোরেছেন যেটির সি ই ও ডা: জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ার এবং তিনি ও তার মেয়ে এটির যৌথ প্রতিষ্ঠাতা। ‘কে ও এইচ বি’ (কীপ আওয়ার হার্টস বিটিং) এন এস এইচের পার্টনারশিপে অর্গান ডোনেশনের উপর কাজ শুরু কোরেছে।

ডা: জাকি রিজ্ওয়ানা আনোয়ার অনেক আগেই তার চোখ, কিডনী, লিভার হার্টসহ সব অংগ দান কোরেছেন যাতে তার মৃত্যুর পর নয়জন রোগী মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে সুস্থ জীবন পেতে পারেন। তার ছেলে ও মেয়েও মাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বেচ্ছায় তাদের অর্গান দান কোরেছে। ‘বৃটেনে ভবিষ্যতে আর্গানের অভাবে কাউকে মরতে হবেনা এবং কষ্ট পেতে হবেনা’ – এটিই তার স্বপ্ন।

Advertisement