সিলেটে ৯ মাসে ৫৮৮ চিহ্নিত জুয়াড়ি গ্রেপ্তার

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে :: সিলেটের জুয়া বন্ধে আগে থেকেই তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বারবার অভিযানের কারণে নগরের পরিচিত জুয়ার আস্তানাগুলো ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরও বসে নেই আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতিদিনই এসব আস্তানায় ‘ঢুঁ’ মারছে র‌্যাব ও পুলিশ। চালাচ্ছে অভিযানও। তাদের অভিযানের কারণে নীরব হয়ে পড়েছে জুয়ার আস্তানাগুলো। গা-ঢাকা দিয়েছে নিয়ন্ত্রকরা। সিলেট মহানগর পুলিশ জানিয়েছে- গত ৯ মাসে সিলেটে প্রায় ৫৮৮ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ৭২টির মতো মামলাও করা হয়। গত দুই দিনে দুটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব সদস্যরা ১৪ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে। সিলেটে ক্যাসিনো নির্ভর জুয়ার আখড়া নেই। তবে- ক্লাবকেন্দ্রিক কিছু কিছু জুয়া রয়েছে। অভিজাত দুটি ক্লাব নিয়েও আছে অভিযোগ। রাজনৈতিক, ব্যবসায়ীসহ কালো টাকার মালিকরা ক্লাবকেন্দ্রিক এই জুয়াতে মেতে উঠেন। দু-একটি অভিজাত হোটেলও আছে এই তালিকায়। তবে- এখনো এসবে অভিযান শুরু করেনি আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহনী। সিলেটের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আস্তানাগুলো এরই মধ্যে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। মাস খানেক আগে অভিযান চালানো হয়েছে সৈনিক ক্লাবে।

সেখান থেকে জুয়া বোর্ডের নিয়ন্ত্রকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত রমজানে কয়েক বার অভিযান চালিয়ে কাজিরবাজারের জুয়ার আস্তানা তছনছ করে দিয়েছিল পুলিশ। এর আগে র‌্যাবও অভিযান চালায়। সিলেটের রিকাবিবাজার এক সময় ছিল জুুয়ার চিহ্নিত আস্তানা। বিভিন্ন ক্লাবকেন্দ্রিক এসব আস্তানায় এক সময় সরগরম থাকতো ওই আস্তানা। এসব আসরে অংশ নিতে ছুটে আসতেন ঢাকার জুয়াড়িরাও। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে এখন আর বসে না জুয়ার আসর। প্রশাসনের তৎপরতার কারণে এখন দু-একটি অভিজাত ক্লাবে ঢুকে পড়েছেন চিহ্নিত জুয়াড়িরা। ব্যক্তিকেন্দ্রিক জুয়ার আস্তানাগুলোও বছর খানেক আগে ছিল বেশ রমরমা। ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হতো ওয়ানটেনের পার্টি। তাদের দিয়েই সিলেটে রাতের আঁধারে চালানো হতো কোটি কোটি টাকার জুয়া। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রশাসন অভিযান শুরু করার কারণে ঢাকার ওয়ানটেন পার্টি এখন আর সিলেটমুখী হতে সাহস পান না। সম্প্রতি সময়ে ঢাকার দুটি পার্টি সিলেটে আস্তানা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতি রাতেই হানা দিচ্ছে জুয়ার আস্তানাগুলোতে।

এখন তাদের টার্গেট হচ্ছে নিয়ন্ত্রকরা। নিয়ন্ত্রকদের গ্রেপ্তার করতে পারলেই সিলেটের জুয়া নির্মূল করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তারা জানান- ব্যক্তিকেন্দ্রিক জুয়ার আস্তানার নিয়ন্ত্রকদের তালিকা এরই মধ্যে তারা সংগ্রহ করেছেন। তাদের ধরতে পারলেই অনেকখানি সফলতা আসবে। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুছা মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সিলেটের জুয়া নিয়ে জিরো টলারেন্সে পুলিশ। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা সরাসরি জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন চালাচ্ছেন। এদিকে- সিলেট মহানগর পুলিশের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে- গত ৯ মাসে পুলিশের হাতে ৫৫৮ জন জুয়াড়ি গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে আছে কয়েকজন নিয়ন্ত্রকও। সবচেয়ে বেশি ৩৮৮ জন জুয়াড়ি আটক হয়েছে কোতোয়ালি থানায়। এ থানায় মামলা করা হয়েছে ৪৮টি। এয়ারপোর্ট থানায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৫৪জন, মামলা করা হয়েছে ৯টি। জালালাবাদ থানায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৪১ জন, মামলা করা হয়েছে ৪টি।

দক্ষিণ সুরমা থানায় গ্রেপ্তার ৮৪ জন ও মামলা করা হয়েছে ৯টি। এ ছাড়া মোগলাবাজার থানায় গ্রেপ্তার হয়েছে ২১ জন, মামলা দুটি। সিলেটের তালতলার চন্দ্রিকা মার্কেট। ওই মার্কেট থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে সবচেয়ে বেশি জুয়াড়ি। র‌্যাব ও পুলিশ গত কয়েক মাসে কমপক্ষে ১৫ বার এই মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রকরা গ্রেপ্তার না হওয়ার কারণে ওই মার্কেটে জুয়ার আখড়া বন্ধ হচ্ছে না। তবে- গত কয়েক দিন ওই মার্কেটে অভিযানে গিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। সিলেটের পরিচিত জুয়া ‘শিলং তীর’। ভারতের মেঘালয়ের শিলং রাজ্যের এই জুয়া সিলেটকে গ্রাস করেছে প্রায় দেড় বছর আগে। শিলং তীরের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েও সেটি বন্ধ করা যায়নি। সিলেটের কাজিরবাজারের কাটোয়া হাটা এলাকায় এখনো বসছে শিলং তীর নাম জুয়ার আড্ডা। পার্শ্ববর্তী মোগলটুলা, লালাদীঘিরপাড়, মেডিকেল এলাকা, শাপলা, পিছের মুখ, ঘাষিটুলা, বাগবাড়ি, মদিনা মার্কেট, কালিবাড়ি, পাঠানটুলা, চৌকিদেখি, খাসদবির, গোয়াইটুলা, চাশনীপীরের মাজার রোড, শিবগঞ্জ, উপশহর, সুবহানীঘাট ও টিলাগড় এলাকায় বসছে শিলং তীরের আসর। স্থানীয় ফাঁড়ি পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব আস্তানা চলারও অভিযোগ উঠেছে। সিলেটের র‌্যাব-৯ এর পক্ষ থেকে জুয়ার বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই অভিযান চলছে।

শনিবার সন্ধ্যা সিলেট মহানগরীর এয়ারপোর্ট থানাধীন বড়শলা নতুন বাজার এলাকায় একটি জুয়ার আসনে অভিযান চালিয়ে ৬ জুয়াড়িকে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলেন- গোলাপগঞ্জের বসন্তপুর এলাকার ইসাব্ব আলীর ছেলে জানু মিয়া, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার আয়নার টুক এলাকার বাসিন্দা মৃত আসাদ আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম, সিলেট এয়ারপোর্ট এলাকার বাসিন্দা মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে মো. জাফর ইসলাম, একই এলাকার বাসিন্দা মৃত ফারুক আহম্মেদের ছেলে মো. জমির আহম্মেদ, মো. নাজিম উদ্দিন ও মৃত লেবু মিয়ার ছেলে মো. আসাদ আহম্মেদ। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব-৯ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. মনিরুজ্জামান জানান, আটকদের বড়শলা নতুন বাজার নজরুল মিয়ার চায়ের দোকানের ভেতরে জুয়া খেলারত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পরে তাদের কাছ থেকে জুয়ার সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার নগরীর কুয়ারপাড় পয়েন্ট এলাকা থেকে ৮ জুয়াড়িকে আটক করেছে র?্যাব। এসময় তাদের কাছ থেকে জুয়া খেলার সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। আটককৃতরা হলো- কোতোয়ালি থানাধীন কুয়ারপাড়-৫৩ নং বাসার হাজী মনির মিয়ার ছেলে রুমন আহমেদ, নগরীর কদর আলীর ছেলে রাশেদ আলী, লালাদীঘির পশ্চিমপাড় এলাকার মৃত আব্দুল আলিমের ছেলে নজরুল ইসলাম, বালাগঞ্জ উপজেলার দোয়ালিয়া গ্রামের কদর আলীর ছেলে রাশেদ আলী, তাহিরপুর উপজেলাধীন লাউড়েড় ঘড় গ্রামের মৃত ইব্রাহিম মিয়ার ছেলে কামাল মিয়া, হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার মৌজপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কাদিরের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক, দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত ডা. হারুনুর রশিদের ছেলে মনিজুল হোসেন, বি-বাড়িয়ার আশুগঞ্জ বাজার এলাকার যোগেশের ছেলে জীবন ও তাহিরপুরের টাকাটুকিয়া গ্রামের মৃত শীতল সরকারের ছেলে শিশির সরকার।

Advertisement