সু চির ভূমিকাও রোহিঙ্গা সংকট গভীর করছে

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ মানবাধিকার দূত ইয়াংহি লি গত সপ্তাহে অং সান সু চিকে বিশেষ আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনার দু’চোখ খুলুন, শুনুন, হৃদয় দিয়ে অনুভব করুন এবং দয়া করে অনেক বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আপনার নৈতিক কর্তৃত্ব ব্যবহার করুন।’ এখনও মিয়ানমারে থেকে যাওয়া লাখো রোহিঙ্গার ঝুঁকির ওপর জাতিসংঘের প্রকাশিত নতুন একটি প্রতিবেদনে বলা হয় ওই রোহিঙ্গারা ‘গণহত্যার মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে’ রয়েছেন। প্রতিবেদনটির দিকে ইঙ্গিত করে সু চির কাছে আবেদনটি জানিয়েছেন অধ্যাপক লি।

এ পর্যায়ে এসে সু চি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবেন এবং ভিন্ন ধরনের আচরণ করবেন- সত্যিকারার্থে জাতিসংঘ কি সেটি প্রত্যাশা করছে? বিশেষত ২০১৬ সালে যখন সামরিক বাহিনী বর্বর ও গণহত্যামূলক অভিযান চালিয়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে বিতাড়িত করতে ব্যস্ত ছিল, তখন কেবল নীরব থেকেই নয়, একইসঙ্গে সামরিক বাহিনীকে ছায়া দিয়েও সমর্থন করেছিলেন সু চি।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সু চির বর্ণবাদের দীর্ঘ ইতিহাস নথিবদ্ধ আছে এবং সেটি আরও নিশ্চিত হওয়া গেছে অতিসম্প্রতি প্রকাশিত ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের আত্মজীবনী থেকে, যেখানে ২০১৩ সালে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ ও হত্যার সময়ে সু চির সঙ্গে লন্ডনে একটি সাক্ষাতের বিষয় স্মরণ করেছেন ক্যামেরন। যখন ক্যামেরন সু চিকে বলেন, ‘বিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে’, তখন সু চির একমাত্র জবাব ছিল- ‘তারা প্রকৃতপক্ষে বার্মিজ নয়। তারা বাংলাদেশি।’ এতে করে সেই বর্ণবাদী অভিযোগটিরই পুনরাবৃত্তি করা হল যে, ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।’

জাতিসংঘের নতুন প্রতিবেদনে সু চিকে পরিচিত করা হয়েছে দমন-পীড়নের মতো নির্যাতনের দুষ্কর্মে সহায়তাকারী হিসেবে। যদিও তার বেসামরিক সরকারের ক্ষমতা নেই নিরাপত্তার বিষয়াবলিতে এবং সামরিক বাহিনীকে তার সরকার অভিযান বন্ধ করা বা তারা যেভাবে পরিচালনা করছে তার গতিপথ পরিবর্তন করতে আদেশ দিতে পারবে না, তথাপিও তাদের ক্ষমতা রয়েছে দেশটির রাজনীতির গতিপথ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট বিষয়াবলির ওপর।

কিন্তু সু চিসহ তার সহযোগীরা প্রতিনিয়ত নিজেদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করছেন সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান সমর্থন করা, জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থার পূর্বের প্রচেষ্টাসহ তদন্তের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা এবং মাঠপর্যায়ে ঘটনাবলির তথ্য সংগ্রহ আটকে দেয়ার পেছনে। এছাড়া নিজেদের জন্মভূমি থেকে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার বিষয়টিকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী উপাখ্যান ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সু চির সরকার।

মিয়ানমারের ঘটনাবলি উন্মোচনে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া চেপে রাখা হয়েছে এই ভয়ে যে, মাত্রাতিরিক্ত কঠোর সমালোচনা দেশটিতে সু চির অবস্থান দুর্বল করে তুলতে পারে এবং তেমনটি করা হলে আগেকার সামরিক জান্তাকে ক্ষমতায় ফিরে আসার কর্তৃত্ব হাতে তুলে দেয়া হবে।

পশ্চিমারা ধৈর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে এই প্রত্যাশায় যে, শেষ পর্যন্ত সু চি নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করবেন। অতীতে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে জয়ী করেছেন এমন কিছু পশ্চিমা নেতা এখনও একই অবস্থানে আছেন। যেমন- মার্কিন সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা মিচ ম্যাককনেল তাদের একজন।

মনে রাখতে হবে, গণহত্যার মুখে এমন ধৈর্যশীল থাকার সমস্যা হল, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী সু চি রোহিঙ্গাদের পক্ষ নেয়ার ক্ষেত্রে গভীর সমস্যায় রয়েছেন- এমন ধারণাকে শক্ত ভিত্তি দেয়া। প্রাকৃতিকভাবে বৌদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে যাকে সু চি বিবেচনা করেন, সেখানে কখনও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য তেমন কোনো উদ্বেগ তিনি লালন করেছেন- এমন সামান্যতম প্রমাণও নেই। নিজের মানুষের জন্য যেমন, তেমনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টির জন্য তিনি যদি কিছুটা উদ্বেগ কখনও পোষণ করে থাকেন, তবে এখন সময় এসেছে সেটি প্রমাণের।

সু চিকে একটি সুযোগ দেয়া দরকার নিজের ও তার দেশের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এবং নোবেলজয়ী হিসেবে তিনি যেভাবে বৈশ্বিক মানবাধিকার আইকন হয়ে উঠেছিলেন সে আদর্শ লালন করে জেগে ওঠার জন্য। দোষত্রুটি মোচন ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তার সঠিকভাবে কোনটি করা দরকার, তার একটি মানদণ্ড এরই মধ্যে উপস্থিত আছে। বিষয়টি এরই মধ্যে জাতিসংঘ অ্যাডভাইজরি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ঘোষণা করা হয়েছে, যেটি প্রকাশ করা হয়েছে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নির্দেশনায় বর্তমান সংকট শুরু হওয়ার আগে।

রোহিঙ্গাদের জন্য যা প্রয়োজন তা হল তাদের নাগরিকত্ব দেয়াসহ কফি আনানের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো সু চি কর্তৃক পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা। যে কোনো প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারে পরিপূর্ণ প্রবেশাধিকার দিতে হবে। এছাড়া সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যেসব সামরিক কর্মকর্তার নাম এসেছে, তাদের সবাইকে অবশ্যই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কারণ তারা সবাই নিজেদের কর্মের জন্য আন্তর্জাতিক একটি ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখে রয়েছে।

গণহত্যার রায় এরই মধ্যে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার- কেউই বিষয়টিকে বিভ্রান্ত করতে বা দীর্ঘসময় পাশে সরিয়ে রাখতে পারবে না। বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষদের সুরক্ষা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং যারা তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ঘটিয়েছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার এখনই সময়।

সু চিকে এখন অবশ্যই সামরিক বাহিনীর পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে হবে গণহত্যার অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য অথবা তাকে নিজেকে গণহত্যা সংঘটনকারী এবং গণহত্যার অনুচর হিসেবে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।

Advertisement