সেলিনার সাইকেল : সাঈম চৌধুরীর নতুন গল্প

সেলিনাকে কেনো সাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিলো ?

পুরোটা পীরবাজার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে। খোকনের টি-স্টলে গরম ডালপুরি আর চায়ের আড্ডায় সেলিনার সাইকেল নিয়ে জবরদস্ত আলাপ হয়। আড্ডাবাজেরা বলে, এটা নেহায়েত বোকামী। বোকা না হলে কি কেউ তার মেয়েকে সাইকেল কিনে দেয়। ওঠা তো চুলের ফিতা, হাতের চুড়ি কিংবা পায়ের নূপুর নয়। ওঠা দুই চাকার সাইকেল। ভন ভন করে তার চাকা ঘুরে। যে মেয়ে সাইকেল পায় সে মেয়েকে আর পায় কে!

সেলিনার ভাগ্যে যা ঘটলো তার জন্য যদি কারো দোষ খোঁজা হয়, তবে প্রথম দোষী সাইকেল, রায় দেয় আড্ডাবাজেরা। বলে, সাইকেল কিনে দেবার উচিত শিক্ষা! এর আগে কখনো পীরবাজারের কোনো মেয়ের সাইকেল ছিলো না।

চায়ের দোকানের এইসব কথা সেলিনার বাবা রজব আলীর কানেও যায়। রজব আলী পীরবাজারে ‘সেলিনা সুপার স্টোর‘র মালিক। নামে সুপার স্টোর হলেও আসলে গ্রামের বাজারের ছোটখাটো ভূষিমালের দোকান। মেয়ে অন্তপ্রাণ বাবা। দোকানটাও মেয়ের নামে কেনা। মেয়ে যা চায় বাবা তাই দিতে এক পায়ে খাড়া।

সেলিনার মা জামিলা তাতে ত্যক্ত-বিরক্ত। ‘এতো সোহাগ ভালা না‘ কথাটা বারবার বলে সে। রজব আলী হাসে। নিজের সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে বসিয়ে মেয়েকে প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছে দেয়। স্কুল ছুটি হলে মেয়ে ছুটে আসে সেলিনা সুপার স্টোরে। বৈয়াম খুলে ইচ্ছেমতো কাঠি লজেন্স চুষে। যাবার বেলা ক্যাশ থেকে দুই টাকাও নিয়ে যায়। টাকাগুলো মাটির ব্যাংকে জমায়।

একদিন সেই ব্যাংক ভেঙে দুই টাকার দুইশ’ বিরাশিটা নোট বাবার হাতে দিয়ে বলে, ‘ও বাবা একখান সাইকেল কিন্যা দিবা নি?’

সাইকেলে মেয়েটার যেনো প্রাণ আটকে আছে। তার জীবনের একটাই স্বপ্ন, একমাত্র চাওয়া, একদিন নিজের সাইকেলে চেপে স্কুলে যাবে।

রজব আলী মেয়ের শখটা ধরতে পারে। জামিলাকে বলে, ‘ভাবতাছি সেলিনারে একখান সাইকেল কিন্যা দিমু’।
জামিলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, ‘কী আচানক কথা কন, সেলিনায় সাইকেল দিয়া কি করবো’?

‘সাইকেলে বইস্যা নদীত সাঁতার কাটবো’! হাসে রজব আলী। বউকে বলে, ‘হুনো জামিলা একখান মূল্যবান কথা কই। বাপ-মায়ে যদি তার মেয়ের শখ পূরণ করবার না পারে তাইলে জীবনেও সেই মেয়ের শখ পূরণ হয় না। পোলা বড় হইলে নিজের শখ নিজে পূরায়, আর মাইয়্যা বড় হইলে শখের দরজায় তালা দেয়। তার শখ পূরণের কেউ থাকে না‘।

রজব আলীর এমন তত্ত্বকথায়ও মন গলে না জামিলার। সেলিনাকে সাইকেল কিনে দেয়া হবে না এটাই তার শেষ কথা।

তারপরও একদিন রজব আলী সাড়ে ছয় হাজার টাকায় একটা হিরো সাইকেল কিনে। নয়া সাইকেলের টুং টাং বেল বাজিয়ে বাড়ির উঠোনে এসে সেলিনাকে ডাকে, ‘ও সেলিনা দেইখ্যা যা বাপে কি কিইন্যা আইনছি!’

ঘরের ভেতর থেকে দৌড়ে বের হয় সেলিনা। অবাক চোখে নতুন সাইকেলের দিকে তাকায়। সেলিনা যেনো তখন ইচ্ছেপূরণ রাজকুমারী। সাইকেলের চাকায় তার সাম্রাজ্যের বিস্তার, সাইকেলের সিটে তার সিংহাসন রাখা! বারো বছরের মেয়ে এমন আনন্দে আর চোখে জল ধরে রাখতে পারে না।

মেয়ের বাঁধছাড়া খুশি দেখে রজব আলীও তখন ইচ্ছেপূরণ রাজা। তার অনেক দুঃখ জল হয়ে যায় এমন চোখের জলে।

টানা তিনদিনের চেষ্টায় সাইকেলকে পোষ মানায় সেলিনা। তবে এখনই সাইকেলে চেপে স্কুলে যাবার অনুমতি মিলে না। বেঁকে বসে জামিলা। জানায়, বাড়ির উঠোন থেকে বাস্তু মিয়ার মাঠ, এই হচ্ছে সীমানা, সাইকেল নিয়ে এর বাইরে গেলে মেয়ে ঘরে ঠাঁই পাবে না।

আপাতত তাতেই রাজী সেলিনা। বাড়ি থেকে বাস্তু মিয়ার মাঠ, মাত্র আধ মাইল। দিনে চৌদ্দ চক্কর। এখন স্কুল ছুটির পর বাবার দোকানে না গিয়ে সোজা বাড়িতে ফিরে সে। সাইকেল নিয়ে ছুটে বাস্তু মিয়ার মাঠে।

মাত্র আধ মাইলের দূরত্ব পাড়ি দেয়া সেলিনার সাইকেল গোটা পীরবাজারে আলোড়ন তুলে। বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখার মতো ভালো মানুষের সংখ্যা পীরবাজারে বড় কম। মেয়েকে সাইকেল কিনে দেয়া যে গুরুতর অন্যায় হয়েছে এই নিয়ে কথা বাড়ার আগে ঘটে যায় ভয়ঙ্কর সেই ঘটনাটি।

বাস্তু মিয়ার মাঠ পেরুলে পীর বাড়ির বিশাল সীমানা। সেই সীমানার শেষ মাথায় নূরুল গাজীর পুরান বাড়ি। ও বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। চারদিকে জঙ্গল বাসা বেঁধেছে। সাপ-বিচ্ছুর আস্তানা। মানুষজন খুব একটা ওদিকে যায় না।

নূরুল গাজীর বাড়ির পরিত্যক্ত উঠোনে সেলিনার সাইকেল পরিত্যক্ত পড়ে থাকে আর সেলিনাকে পাওয়া যায় বাড়ির পেছনের জংলামতো জায়গাটিতে। জ্ঞানহীন। নিথর-রক্তাক্ত শরীর। দমটা কোনোরকমে টিকে আছে। তাও থাকতো না, যদি না পাগলের মতো, উদভ্রান্তের মতো ‘সেলিনা, সেলিনা‘ বলে ওদিকে ছুটে না আসতো রজব আলী।

অসময়েই বাড়িতে ফিরেছিলো সে। কেনো জানি অস্থির অস্থির লাগছিলো। ঘরে ফিরে দেখে জামিলা আরো বেশি অস্থির। তিন ঘণ্টা হয়, সেলিনার ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। কই গেলো মেয়ে?

নিজের সাইকেলে চেপে বাস্তু মিয়ার মাঠের দিকে যায় রজব আলী। মেয়ের নাম ধরে ডাকে। কোনো উত্তর আসে না। এদিক-ওদিক তাকায়। হঠাৎ পুরান বাড়ির দিক থেকে তিন-চারটা মানুষকে যেনো দৌড়ে যেতে দেখে সে। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে ভয়ঙ্কর আশঙ্কায়। সাইকেল ফেলে পুরান বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করে রজব আলী।

খবর রটে যায় সর্বত্র। গ্রাম ভেঙে মানুষজন পুরান বাড়ির দিকে আসে। আবুল মিয়ার বেবিটেক্সিতে তোলা হয় সেলিনাকে। কাঁদতে কাঁদতে সেই টেক্সিতে বসে জামিলা। কেউ একজন টেনে রজব আলীকেও বসিয়ে দেয়। রজব আলী কথা বলে না। রজব আলী কাঁদে না। রজব আলী ফ্যালফ্যাল চোখে কেবল এদিক-ওদিক তাকায়।

হাসপাতালে যাবার পর পুলিশ আসে। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে সাংবাদিক আসে। সন্ধ্যার দিকে জ্ঞান ফিরে সেলিনার। ডাক্তার কাছে যায়। ডাক্তারকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে সেলিনা। পুলিশ কাছে যায়। ভয়ে চিৎকার করে সেলিনা।

রজব আলী কাছে যায় না। সে হাসপাতালের বারান্দা ধরে হাঁটে আর হাঁটে। জামিলা ছুটে আসে, ‘কই গেলা সেলিনার বাপ মাইয়াটা কেমন জানি করে!’
হাত ধরে টেনে রজব আলীকে মেয়ের কাছে নিয়ে যায় জামিলা। একমাত্র বাবাকে দেখে চিৎকার করে না সেলিনা। পাখির বাচ্চার মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরে আড়ালে মুখ ডাকে।

তারপর একদিন সেলিনা হাসপাতাল থেকে ফিরে। সে আর স্কুলে যায় না। ঘরের বাইরে বের হয় না। পুরুষ দেখলে ভয়ে জবুথবু হয়ে যায়।

সেলিনা কাণ্ডে কত কথা হয় পীর বাজারে। চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। একসময় কথাগুলো অন্য গল্প পায়। থানা পুলিশও অন্য মামলায় ব্যস্ত হয়। তারপরও হঠাৎ কখনো অন্য গল্পের ফাঁকে সেলিনার কথা ওঠে। লোকজন তখন সাইকেলে দোষ চাপিয়ে গ্রামের দোষ ঢাকে।

পীরবাজারের এই চিন্তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেবল একজন বলে, না সাইকেলের কোনো দোষ ছিলো না। সে ফাতেমা বেগম। পীর বাড়ির মেয়ে। কঠিন পর্দাপ্রথা। বোরকা না পরে ঘরের বাইরে যাবার হুকুম নেই। কোথাও উঁচু স্বরে কথা বলার সুযোগ নেই। জোরে হাসা যায় না। এমন কঠিন কঠিন সব নিয়মের মধ্যেও পড়ালেখার সুযোগ ছিলো। জামেয়াতুল উলুম মহিলা মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেছে ফাতেমা। এখন তার বিয়ের কথা হচ্ছে। বর আমেরিকার কোনো এক মসজিদের ইমাম। কথা মোটামুটি পাকা। বর দেশে ফিরলেই কবুল বলার অপেক্ষা।

ফাতেমার জীবনে বাড়তি কিছু চাওয়ার নেই। তবুও একদিন জানলার ফাঁক দিয়ে যখন দেখে একটি মেয়ে বাস্তু মিয়ার মাঠে সাইকেল দৌড়ায়, মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে নিজেও তখন সাইকেল দৌড়ায় । মনের সাইকেলে চেপে পৌঁছে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ফাতেমার মনে হয়, ইশ আমার যদি একটা সাইকেল থাকতো! জীবনের প্রথম অবাধ্য স্বপ্ন!

সেলিনার ঘটনার পর ফাতেমা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে। ফুলবানুর মায়ের কাছ থেকে খবর জানতে চায়, থানা পুলিশ কি করে, কেউ ধরা পড়লো নাকি? এইসব প্রশ্নে ফুলবানুর মাকে নাস্তানাবুদ করে। গ্রামবাসীর রায়ে সাইকেল যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এই খবরও জানতে পারে সে। তখন ভেতর থেকে কেউ একজন যেনো জেগে উঠে । ভেতরের মানুষটা ফাতেমাকে বলে, যা হচ্ছে অন্যায় হচ্ছে।

পীর বাড়ি হচ্ছে এই অঞ্চলের সবচে‘ সম্ভ্রান্ত পরিবার। গ্রামের বাজারও তাদের পরিবারের নামে। ফাতেমার পরদাদাকে সবাই বড় হুজুর বলে ডাকতো। ব্রিটিশ আমলে দেশজোড়া সুনাম ছিলো তার। দলবেঁধে মানুষ বড় হুজুরের দোয়া নিয়ে যেতো। পরদাদার পর দাদা। আর এখন ফাতেমার বাবা আরশাদ আলীকে সবাই ছোট হুজুর বলে ডাকে। সম্মান করে। ফাতেমার চাচাতো বোনের স্বামী এই জেলার এমপি। ফুপুতো ভাই আর্মির কর্ণেল। গ্রামের মানুষের বুকে ভয় ধরিয়ে দেবার মতো বড় বড় চেয়ার দখল করে আছে এই বাড়ির ছেলেরা। আর পীর বাড়ির মেয়েদের সুনাম হচ্ছে বোরকায়। এই বাড়ির মেয়েরা নাকি দুধের মতো সাদা। গ্রামের মানুষের বহু দিনের আফসোস, কোনো দিন দুধ সাদা এইসব নারীর মুখ দেখা হয়নি!

বাড়ির বৈঠকখানায় যখন গ্রামের মানুষেরা আসে, বাবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে যায়, তখন ভেতর রুম থেকে তাদের কথাবার্তা শুনে ফাতেমা। বাবা যতক্ষণ বৈঠকখানায় থাকেন তারা কেবল বাবার কথা শুনে। বাবা বেরিয়ে এলে তারা বহু বিষয় নিয়ে কথা বলে। এসব কথায় মাঝে মাঝে সেলিনার কথাও আসে। সেইসব কথায় সব দায় যথারীতি সাইকেলের জন্য বরাদ্দ থাকে। তখন ভেতর থেকে কেউ একজন যেনো জেগে উঠে । ভেতরের মানুষটা ফাতেমাকে বলে, যা হচ্ছে অন্যায় হচ্ছে।

ফাতেমা থানা চেনে না। ফাতেমা পুলিশ চেনে না। ফাতেমা কেবল জামেয়াতুল উলুম মহিলা মাদ্রাসায় যাবার পথটুকু চেনে। এখন তো মাদ্রাসায়ও যেতে হয় না। ঘরে বসে সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে ফুঁসে। একটা কিছু করতে হবে, ভেতরের মানুষটা তাগিদ দেয়।

ঘর থেকে বের হওয়া বড় কঠিন কাজ। একা কোথাও যাবার অনুমতি নেই। তবুও একদিন ফাতেমা ঘর থেকে বের হয়। কিছু দূর হেঁটে বড় রাস্তায় আসে। একটা রিকশায় চাপে। বলে, থানায় নিবেন?

কিভাবে এই অসম্ভব, অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটছে বুঝতে পারে না ফাতেমা। শুধু বুঝে ভেতর থেকে কেউ একজন তাকে তাকে সঙ্গ দিচ্ছে, সাহস দিচ্ছে।

থানার দারোগা আবুল বাশার। ঠিক তার সামনেই এসে দাঁড়ায় ফাতেমা। ভর দুপরে থানায় আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা নারীকে দেখে তিনি অবাক হন। আরো বেশি অবাক হন যখন জানেন, বোরকাওয়ালি পীর বাড়ির মেয়ে। তাকে তৃতীয় দফায় অবাক করে দিয়ে সেলিনার মামলার খবর জানতে চায় ফাতেমা।

হয়তো মেয়েটা কিছু জানে, হয়তো সে কিছু দেখেছে, ধারণা করেন আবুল বাশার। সেলিনার ফাইল উল্টেপাল্টে দেখেন। বলেন, এই মামলার কোনো ভবিষ্যত নেই। ভিক্টিমের জবানবন্দি নেয়া যাচ্ছে না, মানুষ দেখলেই ভয় পায়। আপনি কি বিশেষ কিছু জানেন? ফাতেমাকে প্রশ্ন করেন আবুল বাশার।

ফাতেমা মাথা নাড়ে। সে কিছু জানে না। ফাতেমা বলে, সবাই সাইকেলের দোষ দিচ্ছে, দশ বারো বছরের একটি মেয়ে নিজের অজান্তেই বদলে যাবার গল্প শুনিয়েছিলো। ও যখন সাইকেল দৌড়াতো, বাস্তু মিয়ার মাঠের আশেপাশে তখন অন্য মেয়েরা এসে দাঁড়াতো। আমি জানলা দিয়ে দেখতাম।

কথা বলে ফাতেমা। মুগ্ধ হয়ে শুনেন দারোগা আবুল বাশার। গ্রামের মেয়ে, তবু কথার মধ্যে নেই গ্রাম্য টান। বোরকায় চোখ-মুখ ঢাকা তবু যেনো সবার চেয়ে বেশি দেখছে সে।

ফাতেমা বলে, যদি কেউ ধরা না পরে, যদি কারো শাস্তি না হয়, তবে আর কোনোদিন আমাদের গ্রামে কোনো মেয়ে সাইকেল নেবে না। কোনো মেয়ে নতুন কিছু করার সাহস পাবে না।

ফাতেমাকে থামিয়ে দারোগা আবুল বাশার অপ্রাসঙ্গিকভাবে জানতে চান, কিছু মনে করবেন না আপনার বয়স কতো?
একটু কি হাসে মেয়ে, কে জানে! বোরকায় মুখ ঢাকা থাকায় কিছু বুঝার উপায় নেই। ‘একুশ‘, বলে ফাতেমা।
‘আমার বড় মেয়ে ঠিক তোমার বয়সি। কিছু মনে করো না, তুমি করে বললাম’।
ফাতেমা বলে, একটা সাইকেলে দোষ চাপিয়ে নষ্ট পুরুষগুলো বেঁচে যাবে, এটা হয় না। এটা হওয়া উচিত নয়।
‘তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো’, নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন দারোগা আবুল বাশার। পীর বাড়ির মেয়েরা বুঝি এমন!

আমি বই পড়ি। গল্পের বই নয়, ইতিহাসের বই। আমার চাচাতো ভাই, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। সে আমার জন্য বই নিয়ে আসে। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে আমি বই পড়ি। হাজার বছরের পুরনো দিন বিছানায় আমার সঙ্গ দেয়, বলে ফাতেমা। তারপর কথা ঘোরায়। বলে, আমি কাউকে দেখি নি। তবে বাস্তু মিয়ার মাঠ কিংবা তার আশপাশে যে ছেলেগুলো আড্ডা দেয় তাদের নাম নিয়ে এসেছি।
এতক্ষণ হাতের মুঠোয় একটা কাগজ ছিলো ফাতেমার। সেটা সে দারোগা আবুল বাশারের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বলে, ওদের ধরলে হয়তো খবর পাওয়া যাবে।

কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলান দারোগা আবুল বাশার। তুমি যে এখানে এসেছো, এই যে নামগুলো দিচ্ছো কেউ কি জানে এই খবর? জানতে চান আবুল বাশার।
মাথা নাড়ে ফাতেমা, না কেউ জানে না।

ঘটনা হজম করতে বেশ সময় লাগে দারোগা আবুল বাশারের। ফাতেমা যে নয়টি ছেলের নাম দিয়েছে, তাতে পীর বাড়ির দু‘টো ছেলেও আছে। ফাতেমা বলে, ওরা আমার ভাই। নুরুল গাজীর ভাঙা বাড়িতে বসে তারাও বিড়ি-সিগারেট খায়।

দারোগা বলেন, জানো ফাতেমা সবচে’ কঠিন হচ্ছে এসব মামলায় আসামীকে চেনা। চোর চেনা যায়, খুনি চেনা যায়, ওদের চেনা যায় না। ওরা যে কেউ হতে পারে। জানো, এ ধরণের কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা মেয়েটির বাবা, মামা, চাচা, ভাই কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখি না। বুঝলে মেয়ে, পুরুষ বড় ভয়ংকর!
ফাতেমা জানতে চায়, সেলিনার মামলার কি তবে কোনো গতি হবে না?
হবে, দৃঢ় কণ্ঠে বলেন দারোগা আবুল বাশার। আজ এই মুহূর্ত থেকে এই মামলার মীমাংসা আমার জন্যেও খুব জরুরি।
ফাতেমার বুকের ভার হালকা হয়। ভেতরের মানুষটা বলে, দেখো তুমি পেরেছো! শান্তির অনুভব নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরে সে।

ফাতেমা যে থানায় গেছে পুরো পীরবাজার তা জেনে গেছে। রিকশাওয়ালা রাষ্ট্র করে সেই খবর। বলে, আমি নিজে তারে থানায় নামাইয়া দিছি! পীর বাড়ির মেয়েরা ঘর আর মাদ্রাসার বাইরে কোথাও যায় না। আর সেই বাড়ির মেয়ে একা একা থানা ঘুরে আসে। এদিন সন্ধ্যার পুরোটা সময় খোকনের চায়ের স্টল মগ্ন থাকে এই গল্পে। রহস্য জানার জন্য উদগ্রীব হয় মানুষ।

ফাতেমা যখন ফিরে তখন গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার বাবা আরশাদ আলী। মানুষ অধিক শোকে পাথর হয়, আরশাদ আলী লোহা হয়ে আছেন! আগুন পেয়ে সেই লোহা লকলক করে। মেয়েকে কিছু বলেন না তিনি। এই এক ঘটনায় যেনো পীর বাড়ির আভিজাত্য আর মেয়েদের মর্যাদা খান খান করে ভেঙে পড়ে।

রাতেই পীর বাড়িতে পুলিশ আসে। বাড়ির দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। আরশাদ আলী কিছু বলেন না। নামগুলো যে ফাতেমা দিয়ে এসেছে তিনি জানেন।

দারোগা আবুল বাশারের কাছে ফোন করেন জেলার এমপি। বলেন, এই মেয়ে কিছুই জানে না, কিছুই দেখে নি, মামলার কোনো স্বাক্ষী নেই, কাউকে ধরার প্রয়োজন নেই।
দারোগা বলেন, স্যার যদি এই থানায় থাকি সেলিনার মামলার আসামী ধরা পড়বেই, আর যদি নাও থাকি যাতে আসামীদের শাস্তি হয় সেটা নিশ্চিত করে যাবো।

পীর বাজারে এতো উত্তেজনার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এক মেয়ের এক কথায় এক রাতে নয়টা ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পীর বাড়ির ইজ্জত কম দামি কাপড়ের রঙের মতো গলে গলে পড়ে। খোকনের চা-স্টলে ডালপুরি আর চায়ের আড্ডায় ফাতেমাকে ছি:ছি: দেয় সবাই। এতো মেয়ে নয়, দুধ-কলায় পোষা কালসাপ! নিজ বাড়ির ছেলেদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়। এমন মেয়ে যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়িতে ফেরেস্তাও যায় না! পীর বাড়ির কুদরতি ক্ষমতা এক ঘটনায় শেষ!

সবাই যখন ফাতেমার দোষ খুঁজে তখন রজব আলী তাকে এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়। ছুটে আসে পীর বাড়িতে। বৈঠকখানায় দেখা হয় আরশাদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তোমার তো সাহস কম না, পীর বাড়ির মাইয়্যার সঙ্গে দেখা করতে চাও! জানো, পরপুরুষ এই বাড়ির মাইয়াদের কোনোদিন দেখে নাই!’

রজব আলী বলে, ‘ছোট হুজুর, আপনের মাইয়া আমার লাইগ্যা আর দূরের কেউ থাকে না, আমি বাপের চউক্কে তারে দেখবার চাই!

বাপ! রেগে উঠেন আরশাদ আলী, তুমি ক্যামন বাপ? মাইয়ারে সাইকেল কিন্যা দেও! তোমার মাইয়ার সঙ্গে যা ঘটে পীর বাড়ির মাইয়া হইলে তারে গলায় ফাঁস দিতাম। এই বাড়ির মাইয়ার দিকে কারো চউখ তুইল্যা চাওনের সাহস নাই, কেন্ সাহস নাই? এই বাড়ির মাইয়ারা পর্দা মানে। পর্দা থাকলে এমন ঘটে না রজব আলী। যাও বাড়িত যাও। পারলে বউ আর মাইয়ারে পর্দা শেখাও!

রজব আলী ফিরে আসতে চায়, ঠিক এই সময়ে বৈঠকখানায় আসে ফাতেমা। বৈঠকখানায় এ বাড়ির মেয়েদের প্রবেশে অধিকার নেই। ফাতেমা একে একে সবকিছু ভাঙছে। এই যে রজব আলীর সামনে এসে দাঁড়ায় সে, মাথায় কাপড় আছে বটে কিন্তু চেহারা ঢাকা নেই। পীর বাড়ির নিয়মের পর্দা অবলীলায় উপেক্ষা করছে সে।

রজব আলী ফাতেমাকে দেখে অবাক হয়। মানুষ এতো সুন্দর হয়! পথ ভুলে যেনো এক পরী এসেছে। ফাতেমা বলে, কেমন আছে সেলিনা?
বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে সময় লাগে রজব আলীর। চোখে জল আসে। ছলছল চোখে বলে, মাগো আপনে যা করছেন, মনে লয় আপনারে মাথায় তুইল্যা রাখি!
ফাতেমা বলে, দারোগা সাহেব কথা দিছেন, অপরাধী ধরা পড়বোই। হুনেন, সমাজ সেলিনারে দূরে সরাইয়া রাখতে চাইবো, যাই ঘটুক, তারে স্কুলে দিয়েন, পড়ালেখা করাইয়েন, তহন সমাজের জবাব সে শিক্ষায় দিবো!

মাথা নাড়ে রজব আলী। বলে, বুকের মাঝে সাহস পাই!

ফাতেমা বলে, যহন অপরাধী ধরা পড়বো, সেলিনারে কইয়েন, হে য্যান সাইকেল দৌড়ায়।

মাথা নাড়ে রজব আলী। বলে, বুকের মাঝে সাহস পাই!

আরশাদ আলী কিছু বলেন না। কিছু বলার ভাষা তার নেই। রজব আলী বিদায় নেয়। ফাতেমা ভেতরের ঘরে যেতে চায়। পথ আটকে দাঁড়ান আরশাদ আলী। বলেন, এত্ত সাহস কই থাইক্যা আসে?
জানি না আব্বা, ভেতর থাইক্যা কেউ যেনো সাহস দেয়।
কি লাভ! রজব আলীর মাইয়্যা তোমার কি হয়, ক্যান তার লাইগ্যা পীর বাড়ির ইজ্জতরে ধূলায় মিশায়া দাও? জানতে চান আরশাদ আলী।
ফাতেমা বলে, মাইয়্যাটা স্বাধীনতা শিখায়।
কিয়ের স্বাধীনতা? পীর বাড়ির মাইয়াদের শিক্ষার এতোই কমতি রজব আলীর পুঁচকে কইন্যার কাছ থাইক্যা শিক্ষা নিতে হয়!
ফাতেমা বলে, মাইয়্যাটা প্রতিবাদও শিখায়। এই যে পুরুষ দেইখ্যা সে চিৎকার করে, ওইটা কোনো ভয় নয় আব্বা, এইটা প্রতিবাদ। দশ-বারো বছরের মাইয়ার বড়ই শক্ত প্রতিবাদ!
আরশাদ আলী বলেন, ক্যান জড়াও এইসবে? তোমার চাচা, ফুপু কেউ আর তোমারে এই বাড়িতে দেখবার চায় না। পীর বাড়ি তোমার লাহান মাইয়ারে চায় না। দুই দিন সময় আছে। সোমবারে তোমার মামায় আসবো। এহন থাইক্যা তুমি নানা বাড়িতে থাকবা। যে ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ার আলাপ হয়, হুনছি তার স্বজনরা আর রাজি না। তোমার কপাল পুড়ছে ফাতেমা। সোমবারের পরে তুমি আর কুনুদিন পীর বাড়িতে ফিরতা পারবা না। যা দেখার দুই দিনে দেইখ্যা নেও, যে নেওনের তার গোছগাছ করো!

দীর্ঘ কথা বলে থামেন আরশাদ আলী। চেয়ারে বসেন। বুকের কষ্টকে কোনো রকমে আড়াল করে বলেন, যদি হুনবার পারো, আমি মইর‌্যা গেছি, দোহাই লাগে, লাশ দেখনের লাইগ্যা আইসো না। পীর বাড়ির ইজ্জত ডুবানোয় এই হচ্ছে তোমার শাস্তি!
কিছু বলে না ফাতেমা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মা মারা যাবার পর বাবাই ছিলেন সব। আজ বিচারক হয়ে বাবা শুনিয়ে দিলেন যাবজ্জীবনের দণ্ড!
তুমি অহন যাইতে পারো, বলেন, আরশাদ আলী।

বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাতেমা বলে, আব্বা সাইকেল কন আর বোরকা কন, সবটাই সমান। ক্যান আমি এইসবে জড়াই, সেই কথাটা কোনোদিন, কাউরে কইবার পারুম না।

কথা শেষ করে এক রকম দৌড়ে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে যায় ফাতেমা। বাইরে তখন বেশ হট্টগোল। দারোগা আবুল বাশার তার ছোট মেয়েকে নিয়ে বাস্তু মিয়ার মাঠে এসেছেন। মেয়েটির জন্য সাইকেল কেনা হয়েছে। আজ সে এই মাঠে সাইকেল চালানো শিখবে।
১৩ এপ্রিল ২০১৮.

Advertisement