স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ (প্রথম খন্ড) : আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া

।। ফারুক আহমদ ।।
লেখক: পিনাকী ভট্টাচার্য
প্রকাশনায়: আহমদ ময়েজ, হরপ্পা ইউকে
মূল্য: বিশ পাউন্ড (যুক্তরাজ্য)
প্রকাশকাল: নেই
গত ফেব্রুয়ারি মাসে (২০২১), সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক সম্পাদক কবিবন্ধু আহমদ ময়েজ হাতে এই বই ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা ইতিহাস। আপনার সাবজেক্ট। দাম খুব বেশি নয়, মাত্র বিশ পাউন্ড। কিন্তু আপনার জন্য পনেরো পাউন্ড। নেন, বইটি পড়ে দেখুন, ভালো লাগবে। প্রথম প্রকাশনার প্রায় সব ক’টি বই বিক্রি হয়ে গেছে, কয়েকখানা রয়েছে মাত্র।” 
জানালেন বইটি তিনি তার হরপ্পা থেকে প্রকাশ করেছেন। লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য। ভালো লেখক। তার মাত্র তিনটি কথা আমার মনে ধরেছিলো: ক. বইটি ইতিহাস খ. লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য এবং গ. প্রকাশক তিনি নিজে। 
বইটি তার হরপ্পা থেকে প্রকাশিত হয়েছে জেনে আমি পনেরো পাউন্ড নয় উল্লসিত হয়ে চল্লিশ পাউন্ড হাদিয়া দিয়েই কিনে নিয়ে আসি। কারণ, আহমদ ময়েজ আমার বন্ধু। তিনি প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন সেজন্য এভাবেই তাকে অভিবাদন জানাই। ঘরে ফিরে বইটি পড়তে বসি। পিনাকী এই নামটি শুনে আমার ধারণা হয়েছিলো যে, তিনি হয়তো ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাকী হবেন। তাই আগ্রহ ছিল স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ সম্পর্কে কী লিখেছেন? তা জানা। কিন্তু ব্যাক কাভারে লেখকের ছবি দেখে নিশ্চিত হলাম এই পিনাকী সেই পিনাকী নন। এই পিনাকীর কোনো লেখা এর আগে আমার পড়া হয়নি।
পিনাকী ভট্টাচার্য যে প্রচুর লেখাপড়া করেন তা বইটি হাতে নিলেই বুঝা গেল। বাইশটি অধ্যায়ে বিভক্ত ঝর ঝরে গদ্যে গল্পের মতো করেই লেখা বইটি পড়া শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। লেখায় প্রকাশভঙ্গিও চমৎকার। প্রত্যেকটি তথ্যের সূত্রেরও উল্লেখ আছে এবং আপাত দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য করেই প্রত্যেকটি বিষয় উপস্থাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আমার প্রিয় বিষয়। সেজন্য এই বইয়ের প্রায় প্রত্যেকটি তথ্যই ছিল আমার জানা। কিন্তু তিনি যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন সে ভাবে নয়। তা হলে প্রশ্ন থেকে যায় কীভাবে তিনি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন? সে সম্পর্কে বইটির ভেতরের প্রথম ফ্লাপে পাঠকের উদ্দেশ্যে পিনাকী ভট্টাচার্য’র লেখা থেকেই উদ্বৃতি দেয়া যাক। তিনি লিখেছেন, “মুছে দেয়া আর ভুলিয়ে দেয়া মুজিব আমলের ইতিহাসের জগতে আপনাকে স্বাগত জানাই। গল্পের মতো করে লেখা এই ইতিহাস আপনাকে কখনো বিস্মিত করবে, কখনো আতঙ্কিত করবে, কখনো-বা কাঁদাবে। আর নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারবেন, এত রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে যেই স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার সামর্থ্য হয়েছিল, আমাদের কোন আদি পাপে সেই রাষ্ট্রটা প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।” 
আসলে বইটি ঠিকই আমাকে তা’ই করেছে। কীভাবে? এ বিষয়ে পরে আসছি। এই কথাগুলোর মাধ্যমে লেখক দাবি করেছেন এটি গল্পের মতো করে লেখা ইতিহাস! পাঠককে স্মরণ রাখতে হবে শুধুমাত্র ‘ইতিহাস’ শব্দটি। কারণ আমরা জানি ইতিহাসে পূর্ব নির্দিষ্টতা বলে কিছু নেই, থাকতেও পারে না। সে জন্য কোনো ঐতিহাসিক তার কথাই চূড়ান্ত সেই দাবিও করতে পারে না। তা হলে লেখক এই বইটি ইতিহাস এই দাবি করলেন কোন যুক্তিতে? নাকি তিনি যা লিখবেন তা’ই আমাদেরকে ইতিহাস মানতে হবে? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো বা না। 
আগেই বলেছি বইটির প্রায় প্রত্যেকটি তথ্য আমার জানা এবং বইটিতে প্রচুর তথ্যের যোগান আছে। এই তথ্যগুলো ব্যবহার করে লেখক একটি ভালো ইতিহাস জাতিকে উপহার দিতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করতে যান নি। অন্তত বইটি পড়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তা’ই মনে হয়েছে। আমার জানা মতে, এই বইটির দুর্বল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর চাইতে বড় আরও অন্তত দুটি বই হয়ে যাবে। ভাষাগত ত্রুতি-বিচ্যুতির কথা বাদ দিয়ে, আমি শুধু বিলাতের পাঠকের জন্য, তাদের অতি পরিচিত ঘটনাবলীর মধ্য থেকে মাত্র চারটি পৃষ্ঠায় কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেই আমার লেখাটি শেষ করবো। পৃষ্ঠাগুলো হচ্ছে ৭৩, ৭৪, ৭৫ ও ৭৬। ৭৩ পৃষ্ঠায় পিনাকী ভট্টাচার্য লিখেছেন, “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ৮ জানুয়ারি ভোররাত তিনটায় রাওয়ালপিন্ডি বিমান বন্দরে শেখ মুজিবকে বিদায় জানান। সেদিন স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় তিনি লন্ডনে পৌঁছেছেন। তার জন্য রেডক্রসের একটি বিমান ভাড়া করেছিল ভারত সরকার (?)। কিন্তু সেই বিমানে তিনি পাকিস্তান ত্যাগ না করে প্রথমে লন্ডনে যেতে চান। নয় মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী না জানা পর্যন্ত তিনি ভারত প্রসঙ্গে একটা নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে চেয়েছিলেন (৭৩)।” 
এই কথাগুলো কি আদৌ কোনো অর্থ বহন করে? ধরে নিলাম তিনি লিখতে চেয়েছিলেন রেডক্রসের একটি বিমান ভাড়া করেছিলো পাকিস্তান সরকার। কিন্তু বাকি বাক্যগুলো কি আদৌ কোনো অর্থ বহন করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, রাওয়ালপিন্ডি থেকে হিথরোতে আসতে কি মাত্র তিন ঘন্টা সময় লাগে? প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ভুট্টো শেখ মুজিবকে বিদায় জানান মধ্যরাতের পরপরই। অর্থাৎ রাত বারোটার একটু পরেই। তারপর রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড়োজাহাজটি করাচিতে গিয়ে ড. কামাল হোসেনের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা দেয় লন্ডনের উদ্দেশ্য। করাচি থেকে হিথরোর দূরত্ব হচ্ছে ৩,৩৭১ মাইল। শীতকালে সময়ের ব্যবধান পাঁচ ঘন্টা। এই পথ পাড়ি দিতে সাধারণত আট ঘন্টার কম সময়ে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ডাইরেক্ট ফ্লাইট ছিলো তাই সাড়ে ছয়টার সময় এসে লন্ডনে পৌছান। এখানেও লেখক অনেকটা মাছিমারা কেরানীর ভূমিকা পালন করেছেন।
এর পরে লিখেছেন, “হিথরো বিমান বন্দরে বিমান থেকে নামার পর প্রথম কথা হয় ‘বিবিসি-ওয়ার্ল্ড সার্ভিস’-এর পূর্ব পাকিস্তান বিভাগের সিরাজুর রহমানের সঙ্গে (!)। তিনি বিবিসি’তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদসমূহের আন্তর্জাতিক পরিবেশনার সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করতেন (৭৩)।”
আরেকটি ভুল তথ্য। আসল তথ্য হচ্ছে, সিরাজুর রহমান তখন ছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের অন্যতম সহকারী প্রযোজক। তিনি সেদিন হিথরো এয়ারপোর্টে যান নি, বঙ্গবন্ধু ক্লারিজেস হোটেলে যাবার পরে সেখানে গিয়েই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সিরাজুর রহমান একাধিকবার আমার সঙ্গে দেয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে এই কথাটিই বলেছেন। তার বইগুলোতে এই তথ্যটি আছে। এবার সিরাজুর রহমানের নিজের লেখা থেকেই ভাষ্যটি হুবহু তুলে ধরছি, তিনি লিখেছেন “তারিখ ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি, শনিবার। বাইরে আলো ফোটার ঠিক আগে আগেই বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্তা বিভাগের প্রধান টেলিফোনে বল্লেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পিআইএ’র একখানি বিমান এইমাত্র লন্ডন বিমান বন্দরে এসে নেমেছে। ব্যাপারটা এতোই অপ্রত্যাশিত ছিলো যে, খবরটা হজম করতে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিলো। আমি যখন ক্লারিজেস হোটেলে পৌঁছলাম ততোক্ষণে তিনিও পৌঁছে গেছেন। মুজিব ভাই বসেছিলেন সোফার ওপর, দু’হাতের চেটোর ওপর চিবুক রেখে যেন মাথার ভার রক্ষা করছেন। দৃষ্টি উদ্ভান্ত, যেন কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না। রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে চিনতে পারলেন, বল্লেন – কে, সিরাজ? আয় (প্রীতি নিন সকলে)।” তা হলে তার কোন কথাটি সত্য? পিনাকীর বাবুর নাকি সিরাজুর রহমানের?
এর পরেও যদি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সিরাজুর রহমান দাবি করে থাকেন যে, তিনি হিথরো এয়ারপোর্টে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তা হলে বুঝতে হবে এই কথাটি বলার পেছনে অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। এবার সেটি অনুসন্ধান করা যাক পিনাকী বাবুর বই থেকে। এর পরে পিনাকী লিখেছেন, “তিনি (সিরাজুর রহমান) উচ্চসিতভাবে শেখ মুজিবকে বলে উঠলেন, “আপনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন”। উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, “আমি আবার কিসের প্রেসিডেন্ট হলাম?” তখন সিরাজুর রহমান বলেন, “আপনি তো দেশে ছিলেন না মুজিব ভাই, আপনার নামে আমরা গোটা দেশকে একত্র করে ফেলেছি। আমরা দেশ স্বাধীন করে ফেলেছি …।” 
তারপর বঙ্গবন্ধু সিরাজুর রহমানের কাছে জানতে চান কত লোক মারা গেছে? উত্তরে তিনি বলেন, “কত লোক মারা গেছে কেউ তো হিসাব করেনি। তবে বিভিন্ন মিডিয়া থেকে বিদেশী সংবাদপত্রের যে সাংবাদিকরা যাচ্ছেন, ভারতীয় সাংবাদিকরা খবর দিচ্ছেন – সব মিলিয়ে আবু সাঈদ চৌধুরীকেও আমরা বলেছি, সাংবাদিকদেরও বলেছি, এ পর্যন্ত তিন লাখ বাংলাদেশি মারা গেছে’ (পৃ.৭৫)।”
এবার সিরাজুর রহমানের প্রীতি নিন সকলে বইয়ের ভাষ্যটি জানা যাক। এই বইটিতে সিরাজুর রহমান লিখেছেন, “তখনকার প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে তিন লাখ বাংলাদেশী মারা গিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকেও আমরা সেটাই বলেছিলাম। হয়তো তিনি অন্য কোনো সূত্রে ভিন্ন হিসেব পেয়েছিলেন, কেননা ক্লারিজেস হোটেলে জনাকীর্ন এক সংবাদ সম্মেলনে মৃতের সংখ্যা তিনি তিন মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ লাখ বলে উল্লেখ করেন।” 
পিনাকী ভট্টাচার্য ও সিরাজুর রহমানের এই দুটি ভাষ্যের মধ্যে যেমন মৌলিক প্রার্থক্য আছে, তেমনি আরোপিত তথ্যও আছে। কারণ, ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মৃতের কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলেননি। তবে দেশে গিয়ে বলেছেন। ঢাকায় ডেভিড ফ্রস্টকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাতে শেখ মুজিব ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছেন (ক) শেখ মুজিব: “আপনি জানেন, আমার বাংলাদেশে কী ঘটেছে? শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। অন্ততপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘর-বাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তার সব কিছুকে ওরা লুঠ করেছে। খাদ্যের গুদামগুলিকে ওরা ধ্বংস করেছে।” 
ফ্রস্ট: “নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ, এ কথা আপনি সঠিকভাবে জানেন?” 
শেখ মুজিব: “আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। এখনো আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসি নি। সংখ্যা হয়ত একেও ছাড়িয়ে যাবে। ত্রিশ লাখের কম তো নয়ই।”
শেখ মুজিবুর রহমান: “আমার জীবনের সবচেয়ে শোচনীয় সময় ছিল যখন আমি শুনলাম যে, ওরা আমার প্রায় তিরিশ লাখকে হত্যা করেছে।”
এখানে পরিষ্কার যে, বঙ্গবন্ধু তিরিশ লাখ বলেছিলেন। তিন লাখ একবারও বলেন নি। তার ভাষায় কোনো দ্বিধাও ছিল না।  তিনি কিছুই ঘুলিয়ে ফেলেন নি। অবধারিত ভাবে তিনি এই সংখ্যাটি তার সরকারি সূত্রে পেয়েছিলেন। সিরাজুর রহমান জাহির করেন যে, তিনি ক্লারিজেস হোটেলে দেখা হবার সময়, বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “তখনকার প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে তিন লাখ বাংলাদেশী মারা গিয়েছিলেন”। সেটা সত্য হতেও পারে, তবে কোনো দেশের রাষ্ট্র প্রধান একটি জাতীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে নিজ সরকারের পরামর্শ তুচ্ছ করে, একটি বিদেশি বেতারের কর্মচারীর ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান গ্রহণ করতে যাবেন কোন যুক্তিতে? জাতিসংঘের গণহত্যা সন্ধি অনুসরণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে সংঘটিত গণহত্যার একটি তালিকা উইকিপিডিয়ায় আছে। এতে নিহতদের সকল সংখ্যাই ‘অনুমিত’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৩,০০,০০০-৩০,০০,০০০ (৩ থেকে ৩০ লাখ) বলে বিবৃত আছে। তা হলে প্রশ্ন থেকে যায় তিন ‘মিলিয়নে’র উৎসটা কী? অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদ হবার কথাটি এসেছিলো কীভাবে? 
এই সংখ্যাটি প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। উচ্চারণ করেন জনপ্রিয় লেখক এম আর আখতার মুকুল, তার সুবিখ্যাত কথিকা চরমপত্রে’র সর্বশেষ পর্বে। পরে এই সংখ্যাটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশ (২১ ডিসেম্বর ১৯৭১), দৈনিক আজাদ (৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) এবং তারও পরে ‘এনা’ পরিবেশিত সংবাদের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রচার করে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা। তারপর, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দ্য ডেইলি অবজারভার (৫ জানুয়ারি), মর্নিং নিউজ (৫ জানুয়ারি) দৈনিক বাংলাসহ প্রায় সব ক’টি কাগজ। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু লন্ডনে আসার আগেই এই তথ্যটি এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়েছিল। অথচ সিরাজুর রহমান তার বিভিন্ন লেখা ও সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে নানা ভাবে হেয় করার চেষ্টা করেছেন এবং তা ছিল তিনি একটি চাকরি চেয়েছিলেন, সেই চাকরিটি পাওয়া তার পেক্ষ সম্ভব হয়নি। এর বিবরণও তার উল্লিখিত বইতে আছে। 
পিকানী ভট্টাচার্য এর পরে তার ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ (প্রথম খন্ড)’ বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনের ছবির নিচে “চিত্র-কখন” শিরোনামে লিখেছেন, “লন্ডনে পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকেই অভিজাত ক্লারিজেস হোটেলে পৌঁছেন শেখ মুজিব। হোটেলে ঢুকবার মুহূর্তে তোলা ছবিটাই বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। শেখ মুজিবের সাথে পাকিস্তান থেকেই আঠার মতো লেগে থাকা ড. কামাল হোসেনকে ভুল করে বাংলাদেশ মিশন প্রধান মি. কামাল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য ঢাকায় পৌঁছে বিক্ষুব্ধ জনগণের সামনে ড. কামাল হোসেনকে আরেক পরিচয়ে পরিচিত করতে হয়েছিল।” 
এই বিভ্রান্তিকর কথাগুলো দ্বারা লেখক কী বুঝাতে চেয়েছেন তা পরিষ্কার নয়। কে বা কারা ড. কামাল হোসেনকে ভুল করে বাংলাদেশ মিশন প্রধান মি. কামাল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাও লেখক খোলাসা করেননি। এ ছাড়া ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকবেন কেন? তাকেতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডি থেকেই উড়োজাহাজে তুলে দেয়া হয়েছিল সে কথাটি স্বয়ং এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী নিজেই বলেছেন। নাকি জাফর চৌধুরী ড. কামাল হোসেনের আত্মীয় হন যে, তিনি তার পক্ষে সাফাই গাইবেন? সিরাজুর রহমান যেমন একটি বিশেষ প্রাপ্তিযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে বঙ্গবন্ধু-বিরোধী ভূমিকায় নেমেছিলেন, একই কারণে ড. কামাল হোসেনের বিরোধিতা করেছিলেন খোদ আওয়ামী লীগের কিছু মানুষ।
এভাবে পুরো বইটি ভুল এবং আরোপিত তথ্যে ভর্তি। লেখক যেখানেই বঙ্গবন্ধু-বিরোধী কোনো তথ্য পেয়েছেন সেটাকে যাচাই-বাচাই না করেই এই বইটিতে নিয়ে এসে জুড়ে দিয়েছেন। আমি এই বইয়ে ইতিহাস বিকৃতি দেখে বিস্মিত হয়েছি, আতঙ্কিত হয়েছি। মুজিব আমলে দেশে দুর্নীতি, খুন-খারাবী, হাইজ্যাক, লুটপাঠ সবই হয়েছে। এটি দেশ-বিদেশের মানুষ যেমন জানতো, বঙ্গবন্ধু নিজেও তা জানতেন এবং তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও এর অকপট স্বীকারোক্তি আছে। সেজন্য তিনি এই সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সব ব্যবস্থা নিয়েছেন। আরও স্পষ্ট কথা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু নিজে তার দলের সদস্য, আপনার-আমার ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে যে সকল ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে যে ভাবে ভৎর্সণা করেছেন, চুর-ডাকাত বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। আজও তার সেই বক্তৃতাগুলো ইউটিউভ আর ফেইস বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। সার্চ করলেই বেরিয়ে আসে। তাকে হত্যার পর থেকে আজ পর্যন্ত, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে, চুরাচালানীর বিরুদ্ধে, নিজ দলের সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে সে ভাবে কথা বলার মতো বুকের পাঠা কি কোনো সমিরক শাসক অথবা কোনো জননেতা-জননেত্রী অথবা দেশনেতা-দেশনেত্রীর হয়েছে? নাকি হবে? পিনাকী ভট্টাচার্য- শেখ মুজিবকে একজন দুর্বল শাসক হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন। হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি ছিলেন দুর্বল শাসক। ঢাল নাই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো। দক্ষ শাসক হতে হলে দক্ষ প্রশাসন লাগে, দক্ষ জনশক্তি লাগে। কী দিয়ে তিনি দক্ষতা দেখাতেন? নিঃশ, রিক্ত-উজাড় একটি ভূখন্ডে ক্ষুধার্ত কিছু মানুষ ছাড়া আর কী পেয়েছিলেন তিনি? সেই পাকিস্তান আমলেই প্রশিক্ষিত বাঙালি আমলা ছিলেন আঙুল দিয়ে গোণে বলার মতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই আমলাদের বেশির ভাগই ছিলেন আবার পাকিস্তানের অনুগত। বাধ্য হয়ে সেই সকল আমলাদের দিয়ে তাকে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের হয়ে দেশে ফেরার সময় তিনি লন্ডন বা ভারত থেকে এমন কোনো মেশিন সঙ্গে করে দেশে নিয়ে যাননি, যে মেশিনের একদিকে ঢুকালে অন্য দিকে দক্ষ আমলা বের হয়ে আসবে। তা হলে কি অন্য কোনো দেশ থেকে প্রশাসন চালানোর জন্য মানুষ আমদানী করা তাঁর উচিত ছিল? নাকি সম্ভব ছিল? তখন ভুটান, ভারত এ ধরনের হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়নি। দেশে সমস্যার পাহাড়। মানুষের পেঠে ভাত নাই, কার কাছে ভিক্ষা চাইবেন তিনি? কোন সমস্যা সমাধান করবেন তিনি? আমার এই কথাগুলো দলীয় অন্ধ কোনো কর্মীর মতো শোনালেও এটাই ছিল বাস্তবতা। আরোপিত কথামালা দিয়ে আর যাই হোক সঠিক ইতিহাস হয় না। আগেই বলেছি, এই বইটি লিখতে গিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্য প্রচুর লেখাপড়া করেছেন। বঙ্গবন্ধু ফেরেস্তা বা অতি মানব ছিলেন না, ছিলেন দুষেগুণে একজন মানুষ। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, তার সরকার, এমনকি তার নিজের দুর্বলতা তুলে ধরে পিনাকী বাবু সঠিক তথ্যভিত্তিক ভালো একটি বই পাঠককে উপহার দিতে পারতেন। জাতি তা থেকে উপকৃত হতে পারতো। দিক নির্দেশনা পেতো। কিন্তু তা বইটিতে অনুপস্থিত। 
বইটিতে সম্পাদনার কোনো ছাপও আমি খুঁজে পাইনি। ডিজাইনটাও শিশুতোষ বইয়ের মতো। মূল্যটাও আকাশচুম্ভী। এই দামের চাইতে সামান্য বেশি মূল্য দিয়ে আমি রমেশচন্দ্র মজুমদারের তিন খন্ডে প্রকাশিত ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ বইটি কলকাতা থেকে আনিয়েছি। বইয়ের নামকরণটা ‘স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশ’ অথবা ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ’ দিলেই সঠিক হতো। এটির ইউরোপ প্রকাশনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন – আসিফ আরমানী, আরিফ শাম্র, ড. মামুন রহমান ও এমাদুর রহমান। প্রকাশক (আরও সঠিকভাবে বললে মুদ্রক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নাম গেছে) হিসেবে নাম ব্যবহার করা হয়েছে হরপ্পা ইউকে। ইউকে থেকে প্রকাশিত কোনো বইয়ে আইএসবিএন নাম্বার থাকবে না এটা সাধারণত ধারণাই করা যায় না। অথচ এই বইটিতে কোনো আইএসবিএন নাম্বারও নেই। নেই প্রকাশকালও। এর পরে বানান বা বাক্য গঠন, তথ্যসূত্রের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলে মনে করিনা। আরোপিত ইতিহাস কীভাবে লেখা হয় তা জানতে আগ্রহী পাঠকেরা বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
ফারুক আহমদ : যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক ও গবেষক।
Advertisement