স্মৃতি থেকে : আমার দেখা মুক্তি সংগ্রাম

মো: রেজাউল করিম মৃধা॥ আমি তখন খুবই ছোট, ৬/৭ বছর বয়স হবে আমার। তারপরও অনেক কিছু মনে পড়ে আজ। স্মৃতিতে ফিরে যেতে চাই । তখন সবে মাত্র পাঠশালায় যাই আর আসি। আমরা ছয় ভাইবোন, আমি সংসারে ৫ নাম্বার সন্তান। আমার বড় দুই ভাই আর বড় দুই বোন আর আমার ছোট্ট আদরের বোনের জন্ম স্বাধীনতার পর। আমি ছিলাম সবার আদরের । শুধু ছিলাম না এখনো আছি। শুধু ভাইবোন নয় আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশী সবাই আমাকে অনেক আদর করেন। আমার পিঠাপিঠি দুইবোন অর্থাৎ বড় ভাই, মেঝ ভাই, বড় বুজি, মেঝ বুজি।বড় ভাইকে আমরা সবাই মিয়া ভাই বলে ডাকি। দুই বোনের সাথেই পাঠশালায় যেতাম। বড় বোন হাই স্কুলে আর মেঝ বোন পড়তো আমারই এক ক্লাস উপরে পাঠশালায় । হাই স্কুল ও পাঠশালা পাশাপাশি । হাত ধরে, অনেক সময় কোলে করেই আমাকে পাঠশালায় নিয়ে যেতো দুইবোন। বড় বোন থাকলে ছোট ভাই এর যে কি আদর তা আমি ছাড়া কেউ জানেনা।

স্কুলে যাচ্ছি আর আসছি। হঠাৎ শুনলাম দেশে গন্ডগোল লেগে গেছে তাই থমথমে ভাব বিরাজ করছে। স্কুল, পাঠশালা তখনও চলছে তবে তেমন প্রাণ চন্চলতা নেই। ভয় ভয় একটি ভাব। গোন্ডগোল তখনও ঢাকা কেন্দ্রীক । এলাকায় তখনও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে নাই।

এদিকে মিয়া ভাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অর্থাৎ আর্মিতে আছে পাকিস্তানের লাহোরের সেনানিবাসে । বাবা মা দুশ্চিন্তায় । তাদের খাওয়া দাওয়া নাই। শুধু বড় ভাই এর নাম যিনি সাধারন সৈনিক থেকে কর্ম দক্ষতায় আজ অনারেবল ক্যাপ্টেন হয়েছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে তাকে সম্মাননা দিয়েছেন। মিয়া ভাইর কোন খোঁজ খবর নাই বাড়ীতে অনেকটা হতাশা ভাব। বাবা মা মিয়া ভাইর খোঁজ নেওয়ার চেস্টা করেন ঢাকা থেকে কেউ গ্রামে আসলে বাবা ছুটে চলে যেতেন তার কাছে। মিয়া ভাইয়ের কোন খবর পাওয়া যায় কি না ?

হঠাৎ করে একদিন মিয়া ভাই বাড়ীতে চলে এলেন। সেদিনের স্মৃতি কোনদিনও ভুলতে পারবো না। গন্ডগোলের বেশ কয়েকদিন পরেই হবে। মিয়া ভাই বাড়ীতে এসেছে এখবর এলাকার মধ্যে এক আলোড়ন সৃস্টি করে ফেললো। শত শত লোক আমাদের বাড়ীতে ভীড় করতে লাগলো। এলাকা থেকে অন্য এলাকার লোকজন ও ছুটে এসে দেখা করতে এবং মিয়া ভাইর কথা শুনতে। আগেই বলেছি আমাদের বড় ভাইকে মিয়া ভাই বলে ডাকি। মিয়া ভাইর নাম মোহাম্মদ ইরফান আলি মৃধা। তবে সবাই তাকে ইরফান মৃধা বলে ডাকে। বাবা মা অনেক খুশি। শুধু বাবা মা নয় আমরা ভাইবোন সবাই অনেক অনেক খুশি । মিয়া ভাই এসেছেন।ভাবী রান্না নিয়ে বেশী ব্যাস্ত। সাথে কাজের লোকতো আছেই।

মিয়া ভাই যখন ই ছুটিতে বাড়ী আসতেন। আসার সময় ঝুড়িঁ ভর্তি আংগুর অন্যান্য ফল বিস্কুট সেই সাথে আমার জন্য কেরলিন কাপড়ের শার্ট । সবার জন্য আনতেন কিন্তু আমার জন্য স্পেশাল কেননা আমাকে বেশী আদর করতেন বেশী ভালো বাসতেন ।

মনে আছে মিয়া ভাইর সাথে খেতে বসতাম । মা মিয়া ভাইরে মাছ তুলে দিলে মিয়া ভাই কিছুটা খেয়ে বাকীটা বা অনেক সময় না খেয়ে আমাকে তুলে দিতেন বেশী মাছ বা মাংস খাবার আশায় মিয়া ভাইর সাথে খেতে বসতাম এমনকি মিয়া ভাইও যে কতদিন বাড়ীতে থাকতেন আমাকে নিয়েই খেতে বসতেন। এমনকি শ্বশুড় বাড়ী বেড়াতে গেলেও আমাকে সাথে করে করে নিয়ে যেতেন ।

এবার দেখলাম মিয়া ভাই খালি হাতে এসেছেন। কিছুই আনেন নাই। কোন কাপড় নেই সাথে কোন ব্যাগও নেই। মিয়া ভাই আসছে খবর শুনে আমি দৌড় দিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম । মিয়া ভাই আসছে সবার আগে আমি যাবো মিয়াভাই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে আদর করবে। দেখলাম একটি ঘোড়ায় চড়ে মিয়া ভাই আসতেছেন। পিছনে পিছনে অনেক লোক। মিয়া ভাই ঘোড়া থেকে নেমে আমার মাথায় হাত বুলিয় আদর করে একটু সামনে যেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাই করে সে কি কান্না! মাও কান্না শুরু করলো বাড়ীতে কান্নার রোল পড়ে গেল। সে কান্না কিন্তু বেদনার নয় আনন্দের । হারানো সন্তানকে ফিরে পাওয়া অবশ্য এর আগে অনেকেই বলাবলি করতো এ বাড়ীর ছেলে আর ফিরে আসবে না । যুদ্ধ লেগেছে ওকে হয়তো পারিস্তানীরা আটকে রেখেছে অথবা মেরে ফেলেছে। মিয়া ভাইও বাবাকে উপস্থিত সকলে সান্তনা দিচ্ছেন।

ভাবী দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। সেদিকে অবশ্য কারও নজর নেই। সবাই শুধু মিয়া ভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দুইবোন এ অপেক্ষায় আছে মিয়া ভাই কখন কি চায়? কি লাগবে? সে দিকে কিছুক্ষন পর আমাদের বড় চাচী এসে বললেন ইরফান যাও ঘরে যেয়ে কাপড় পাল্টে আসো । ঘরে যে বাবার লুংগি পরে বাইরে আসলো । এদিকে গোসলের জন্য বালতিতে টিউব ওয়েলের পানি তোলা হয়েছে মিয়া ভাই গোসল করবেন। গোসলে গেলে গোসলের প্রথম মা মিয়া ভাইর মাথায় দুধ ঢেলে দিলেন । মিয়া ভাইকে দুধ দিয়ে গোসল করানো হলো । দুধ দিয়ে গোসল করানো এদৃশ্য এখন চোখে ভাসে। এসময় তার চারপাশে বহু লোক জড়ো হয়ে আছেন। এর মাঝেও মিয়া ভাই অনেকের কথার জবাব দিচ্ছেন।

মেঝ ভাই সোহরাব মৃধা বর্তমানে স্বপরিবারে প্যারিসে থাকেন। তখন আমাদের হাই স্কুল পড়তেন। আমাদের বলছি এজন্য যে আমরা ভাইবোন সবাই একই স্কুলের ছাত্র।নাম ইব্রাহিমপুর ঈশ্বর চন্দ্র বহুমুখি উচ্চ বি্দ্যালয় । শুধু আমাদের এলাকাতেই নয়, আমাদের জেলায় নয় সারা বাংলাদেশের মধ্যে নাম করা। প্রতি বছরই মেট্রিক এ ভাল ফলাফল করে থাকে ছাত্র ছাত্রীরা। আমাদের স্কুলের ছাত্র বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন । এমপি ছিলেন। সচিব আছেন। বড় বড় ডাক্তার, ইন্জিনিয়র উকিল মুক্তার সহ বড় বড় ব্যাবসায়ীও আছেন। মেঝ ভাই তখন হাইস্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র, মেট্রিক পরিক্ষা দিবেন। তার ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব তার উপর মিয়া ভাই এসেছেন। মিয়া ভাইকে দেখার জন্য হাজার হাজার লোক এসে উপস্থিত হচ্ছেন। লোকদের আপ্যায়নের দায়িত্বটাও তার। পাশের দোকান থেকে প্যাকেট বা বড় বক্স কিম্বা জেয়ার ধরে ধরে নিয়ে আসছে। কেউ কেউ ভাত বা মুড়ি খাচ্ছেন।

আশেপাশের লোকরা তো আসছেনই এ ছাড়া দূরদূরান্ত থেকেও অনেক এসেছেন। চেয়ারম্যান, মেম্বার, মিয়া, ভুঁইয়া, চৌধুরী, ছোট থেকে বড় সবাই এসেছেন। মিয়া ভাইর সাথে কথা বলার জন্য, ভিতর বাড়ী, বাইর বাড়ী, বাংলা ঘর দুয়ার কোথাও লোকের অভাব নেই। নারী পুরুষ, ছেলে বৃদ্ধ সবাই।

মিয়া ভাইকে কেউ খাবারের সময়ও দিচ্ছেন না।
অবশেষে মা বললেন, ইরফান তুমি আগে খাও পরে কথা বলবে। মিয়া ভাই খেতে বসলেও কথা চলছে। আজ আর মিয়া ভাইর সাথে খাওয়া হলো না। অনেক লোক,  এর মধ্যে বেশ কয়েক জন নামি দামী লোক মিয়া ভাইর সাথে খেতে বসলেন। খাওয়ার পর আবারও যুদ্ধের গল্প এ যেন শেষ হবার নয়। কিভাবে পালিয়ে এলেন পাকিস্তান থেকে এই যুদ্ধের সময় কিভাবে আসা সম্ভব? মিয়া ভাই সেই সব গল্প বলে যাচ্ছেন আর সবাই মনোযোগ সহকারে শুনে যাচ্ছেন। কোন সাঁড়া শব্দ নেই । বলে যাচ্ছেন সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা। কতদিন কতরাত মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। না খেয়ে থেকেছেন। রাস্তার ধারের টমেটো খেয়েছেন।

বাড়ী থেকে ১০/১২ মাইল দূর থেকে ক্লান্ত দেহ নিয়ে একটি ঘোড়ায় উঠেন। তখন আমাদের গ্রামে গাড়ি, বাস , রিক্সা কিছুই চলতো না । দূরে গেলে ঘোড়া আর মহিলাদের জন্য ছিল পালকি। তাও আবার ধনীদের জন্য যাদের পয়সা ছিল। না হলে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই । আর বর্ষার দিনে নৌকা। যাইহোক ঘোড়া ওয়ালাকে বলছেন, আমাদের বাড়ীর কথা গ্রামের কথা। ঘোড়া ওয়ালা ঠিকই নিয়ে এসেছেন। তাকে খাওয়া দাওয়া করিয়ে ভাড়ার সাথে আরো বকশিস দিলেন বাবা। মা আরো কিছু খাবার দিয়ে দিলেন রাস্তায় খাওয়ার জন্য।

খুশি মনে চলে গেলেন । আজ তো খুশির দিন । আমাদের পরিবারে সব চেয়ে খুশির দিন । পৃথিবীর কোন খুশিই কোন সুখ শান্তি এর চেয়ে বড় নয়। ঐদিন আমাদের মত সুখি পরিবার পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আমার কাছে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সেরা সুখি আমরা। আজ আমরা সবাই এক সাথে।

বিকেলে লোকের ভীর অনেকটা কমছে। মিয়া ভাইর যুদ্ধের গল্প শুনে শুনে চোখ ভিজিয়ে চলে গেছেন অনেকেই। কেউ ভাত খেয়ে, কেউ বিস্কুট মুড়ি খেয়ে । বিকেলে এলেন আমাদের হাই স্কুলের হেড মাস্টার মো: আব্দুল মজিদ। মজিদ স্যার আমাদের সবার প্রিয়, সবার শ্রদ্ধা ভাজন। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার ব্যাবহার । এ যুগে এমন স্যার মেলা ভার । স্যারের সাথে সব সময় ২/৪ জন লোক থাকেই এটাই যেন তার ভাগ্য। মিয়া ভাই স্যারকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। আজ আর স্যার শুধু মাথায় হাত বুলিয়েই দোওয়া করেননি । মিয়া ভাইকে বুকে তুলে নিলেন। মিয়া ভাইর চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পরতে লাগলো । উপস্থিত সকলের চোখেই আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পরতে লাগলো । স্যারের একটি কথা আমার স্পস্ট মনে আছে। স্যার বললেন” দূর বোকা তুই কাঁদছিস কেন? তুইতো সৈনিক, বীর সৈনিক, তুই আমার গর্ব, আমাদের গর্ব, তোর বাবা মায়ের গর্ব, দেশের গর্ব। তুই আমার সব চেয়ে সাহসী ছাত্র”। কান্না থেমে গেলেও ভেজা চোখ লাল হয়ে আছে। এর মধ্যে স্যারের জন্য চা নাস্তা নিয়ে এলেন মেঝ ভাই। এরই মাঝে সন্ধা ঘনিয়ে এলে বাড়ীর লোক জন কমে গেল। বাবা মেঝ ভাইকে বললেন “ হারিক্যান দিয়ে স্যার কে এগিয়ে দিয়ে আসো”। বাবা নামাজ পড়তে গেলেন ।

মিয়া ভাই বাড়ীতে এসেছেন আমরা সবাই খুশি হলেও পাঠশালার মাস্টার আ: করিম মোল্লা খুশি হতে পারেননি। কারন তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সদস্য। তিনি বলতেন “বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হবেনা পাকিস্তানই ভালো”। আমাদের বাড়ীতে এতো লোকের আসা যাওয়া সে কিছুই সহ্য করতে পারছে না। এলাকার সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর মাত্র এই একটি পরিবার বিপক্ষে। পাকিস্তানের দালাল হিসেবে পাক হানাদারদের সাথে কাজ করতো। মুক্তি বাহিনীর খোঁজ খবর পাকিস্তানীদের কাছে দিতেন। হিন্দুদের বাড়ী ছিনিয়ে দিতেন। এমনকি লুটতরাজও করতেন।

এলাকায় করিম মাস্টার বলতে শুরু করলো “এত দিন আমরা ভালোই ছিলাম, এখন ইরফান দেশে এসেছে এ খবর পাকিস্তানিরা জানতে পারলে আমাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দিবে”।

এদিকে মিয়া ভাইর আসার খবর পেয়ে ছুটে এলেন মানিকগঞ্জ মুক্তিযাদ্ধা জেলা কমান্ডার আব্দুল মতিন চৌধুরী। সাথে আরো বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা । বাড়ীতে রান্নাবান্না চলছে। কমান্ডারের সাথে মিয়া ভাই আস্তে আস্তে কথা বলেন পরামর্শ করেন। অনেক সময় অন্য কেউ নয় শুধু তাঁরাই আর কাউকে সেখানে যেতে দেন না মিটিং চলার সময় ঘরের বাইরে ২/১ বাইরে পাহাড়ায় থাকেন । আমি পাঠশালায় যাই আসি এই আর কি।

একদিন দেখি মিয়া ভাই আর কমান্ডা হাই স্কলে হেড স্যারের সাথে মিটিং করে বেড়িয়ে এলেন। কমান্ডারের অনুরোধে হেড মাস্টারের অনুমতি নিয়ে স্কুলের বড় বড় সব ছাত্রদের ট্রেনিং এর দায়িত্ব মিয়া ভাইর। প্রতিদিন স্কুলে এসে ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন। মিয়া ভাইর এখন সব চেয়ে বড় দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধা তৈরী করা। প্রতিদিন ট্রনিং দিতেন আর বাড়ীতে যেয়ে গল্প করতেন । আমরা সবাই মিয়া ভাইর গল্প শুনতাম।

মেঝ ভাই ও মুক্তিযাদ্ধার ট্রেনিং নিতেন “আমি আবার ঠাট্টা করে বলতাম “মেঝ ভাইর যে সাহস সে করবে মুক্তিযুদ্ধ” সবাই হো হো করে হেসে উঠতে,”।
মিয়া ভাই চোখ পরতেই মাথা নিচু করে গল্প শুনতে লাগলাম। মিয়া ভাইর সামনে আমরা কেউই বেশী কথা বলতাম না এখনও না । সব সময় শ্রদ্ধা করতাম ভয় পেতাম। বাবাকে যতটা না ভয় পেতাম তার চেয়ে বেশী ভয় পেতাম মিয়া ভাইকে। এখনো অনেক বেশী শ্রদ্ধা করি ভালোবাসি মিয়া ভাইকে।

মিয়া ভাই স্কুলে ছাত্রদের ট্রনিং দিয়ে একটি বিরাট মুক্তি বাহিনী গড়ে চলছেন। অপারেশনের দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিয়া ভাইর দায়িত্ব শুধু ট্টেনিং দেওয়া। আমিও অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেনিং দেখতাম কিন্তু বড় বুজি হাত ধরে নিয়ে আসতো।

হঠাৎ দেখি একদিন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেশ কয়েক জন লোক আমাদের বাড়ীতে হাজির। আমরা তো সবাই ভয়ে অস্থির। মিয়া ভাই তাদের সাথে ফিস ফিস করে কথা বললেন। পরে আমাদের বললেন, কোন ভয় নেই। তবে এরা যে আমাদের বাড়ী এসেছে সে কথা কেউ যেন না জানে। আমাদের বাড়ীতে তখনো বেশ কয়েকটি ঘর মিয়া ভাইর ঘর পাটাতন করা চতুর দিকে টিনের বেড়া অন্য আরো তিনটি বড় বড় ঘর। বাংলা ঘর । আমি আর মেঝ ভাই থাকতাম পূর্ব পাশের লম্বা ঘরে এক পাশে কাঁঠের চৌকি। টেবিল চেয়ার আর পাশে মাচা দিয়ে জিনিস পত্র রাখা। আমার বাবা ছিলেন একজন কৃষক । সবাই বলতেন আদর্শ কৃষক। কেননা তিনি নিজ হাতে হাল চাষ করলেও আমাদেরকে লেখাপড়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমাদেরকে নিয়ে তিনি অনেক স্বপ্ন দেখতেন। হয়তো তার সে স্বপ্ন সম্পূর্ন না হলেও কিছুটা পূর্ন হয়েছে।

আমাদের ঘরেই মুক্তি থাকার ব্যবস্থা হলো। আমরা সবাই জানি যত ঝামেলা সব যেন মেঝ ভাইর উপর।
মিয়া ভাই অতিথি সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন “ইনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন আ: হালিম চৌধুরী। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হয়ে ছিলেন। আর ইনি হচ্ছেন, মন্ত্রী হাবিবুর রহমান (হাবু মিয়া) চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন সহ আরো কয়েক জন বরেন্য ব্যাক্তি প্রায় এক মাস আমাদের বাড়ীতে থেকেছেন। দিনের বেলা বেশী বের হতেন না রাতে হয়তো বের হতেন। এর মধ্যে সুনীল নাপিত এসে তাদের চুল দাড়ি কেটে দিতেন কিন্তু কারো কাছে বলা নিষেধ ছিলো।

হঠাৎ করে একদিন সবাই চলে গেছেন। সাথে করে নিয়ে গেছেন মেঝ ভাইকে। তখন থেকে আমাদের বাড়ীতে আনন্দ কমে গেছে। মেঝ ভাই নেই বাড়িটি ফাঁকা ফাঁকা লাগে আর আমার বেশী খারাপ লাগে কারন মেঝ ভাই আর আমি এক খাটে ঘুমাতাম। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ মেঝ ভাইর খবর দিয়ে যেতো তিনি ভালো আছেন তারপরও স্বস্থি নেই। করিম মোল্লার জন্য অনেক কাজ, অনেক কথাও চুপি চুপি করতে হয়। কারন তাকে কেউ বিশ্বাস করতে না।

মনে পরে তখন বর্ষাকাল, মাস দিন ঠিক মনে নেই। তবে বর্ষাকাল এটা ঠিক মনে আছে। রাজাকারের অত্যাচারে মিয়া ভাইকেও অন্যত্র চলে যেতে হলো। ভাবী গেলেন তার বাবার বাড়ি। আর রাজাকার করিম মোল্লা শুধু বলতে থাকে ইরফানের জন্য আমাদের এলাকা পুড়িয়ে দিবে, লোকজনকে হত্যা করবে। এদিকে বাড়ীর পাশেই পদ্মার পাড়, লন্চ স্টিমার যা যায় দেখা যায়। অনেক সময় লন্চে করে মিলিটারী যাওয়ার সময় গুলি করে। তখন আমরা শংকিত হই। বাড়ি থেকে বেশী কোথাও যাই না । সবাই ভয়ে আতংকিত। বেঁচে থাকাই বড় কথা আমাদের পাশের গ্রামই হঠাৎ করে একদিন মিলিটারী প্রবেশ করে বাড়ী ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হত্যা করে গনহারে। আর অনেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে গন্তব্য হীন পথে।

আমাদের বাড়ী এমনিতেই সবার টার্গেট। মিলিটারী আমাদের বাড়ী আসবে এতে কোন সন্দেহ নাই। তাছাড়া এলাকায় রেডিও তেমন ছিল না। আমাদের রেডিও তে খবর শোনার জন্য অনেক লোক ছুটে আসতো। হিন্দুদের সংখ্যাই বেশী হবে। রাতের খবর চুপ করে সবাই বসে থাকতো। বাচ্চা কেউ কেঁদে উঠলে মুখ চেপে ধরতো। আর একটি ভয় এই বুঝি মিলিটারী আসছে। এ খবর শোনার সাথে সাথে কান্না থেমে যেতো।
হায়রে ভয়, ভয়ে ভয়ে সবার জীবন হা হা কার। আজ ভয় থেকে দূরে বহু দূরে কিন্তু সেই দিনের সেই স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।

এক দিন বাবা স্থির করলেন আর এখানে নয় সবাইকে যেতে হবে অন্যত্র। আমাদের দূরের সম্পর্কের এক আত্বীয় বাড়িতে। আমাদের বাড়ি থেকে ৬/৭ মাইল দূরে কুসুম হাঁটি গ্রামে। আমাদের বাড়ি মানিকগন্জ জেলার শেষ প্রান্তরে আর কুসুম হাঁটি গ্রাম হচ্ছে ঢাকা জেলার দোহার থানার শেষ প্রান্তে।

আমাদেরই নৌকা। মাঝি নেই । থাকলেও কেউ যেতে চায় না অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। বড় চাচার মেয়ের জামাই আমাদের এক মাত্র বড় দুলা ভাই। কারন তখনো আমার আপন বোনের কারো বিয়ে হয় নাই। এ দুলা ভাই আমাদের ভীষন আদর করতো। বিশেষ করে আমাকে অনেক আদর করতেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। নৌকায় সবাই উঠেছে। ছোট চাচীর ভাত তখনো রান্না শেষ হয় নাই। সেই ভাতের হাড়ী নিয়ে এলেন। মা দুই বোন ও ছোট কাকার ছেলে হারুন মৃধা কে সাথে করে নৌকায় উঠলেন। কিন্তু আমার মেঝ বোন নৌকায় উঠে আবার যেন কি আনার জন্য বাড়িতে গেছে। ওকে রেখেই তাড়াহুড়া করে নৌকা চালাতে শুরু করলেন দুলা ভাই। ওর ডাক কেউ শুনেনা । দুলা ভাই বললেন, নৌকা পিছনে ফেরানো ভালো লক্ষন নয়। আমি চিৎকার করে বললাম সাঁতার দে , সাঁতার দে আমি ওঁকে রেখে যেতে চাই নাই আমিতো ছোট মানুষ তারপরও চিৎকার করে বললাম সাঁতার দে । আমরা ভাইবোন সবাই সাঁতার জানি মেঝ বোন সাহানারা অবশেষে সাঁতারকেটে আমাদের নৌকায় উঠলো । আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। ও আর আমি পিটাপিটি অনেক সময় খাওয়া নিয়ে , আম পারা নিয়ে ঝগডাঝাটি করেছি, খেলাধুলাও এক সাথে করেছি। তাই আমার প্রতি আবদারও বেশী ।

দাদী আর বাবা শুধু বাড়ীতে। তিনটি সংসার আমাদের বড় কাকার আর ছোট কাকার, ছোট কাকাও আসতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু অনেকগুলি গরু । রাখালরা সবাই চলে গেছে যার যার বাড়ি। বিরাট সংসার মানুষ মাত্র তিন জন তাছাড়া দাদী অনেক বয়স্ক মানুষ। বাবা মোটামুটি রান্না জানেন। এছাড়া হিন্দু দুএক জন আমাদের বাড়ীতে সবসময় থাকতো। বাবার ঘাড়ে এখন অনেক দায়িত্ব । বাবা আমাদের সবাইকে বিদায় দিলেন মার হাতে টাকা দিয়ে বলেছিলেন । ওদের খেয়াল রেখ! বেঁচে থাকলে হয়তো আবার দেখা হবে। হয়তো হবে না এক মাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। বাবা মার ছোট ছেলে আমি তাই আমার প্রতি সবার আলাদা টান। বড় দুই ভাই এখন কে কোথায় আছেন কেউ জানে না।সেই বিদায়ের সময় বাবার চোখের পানি আজও আমার চোখে ভেসে উঠে। এখন বাবা নেই । তবে তার স্মৃতি চোখের সামনেই আছে।

চলে গেলাম কুসুম হাঁটি গ্রামে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। দূর সম্পর্কীয় আত্বীয়র বাড়ি । ঘর বাড়ীর যে অবস্থা তাতে তাদেরই বসবাস করা কস্ট এর মধ্যে আমরা সেখানে ১০/১২ জন অতিরিক্ত লোক যেয়ে উঠলাম । ছনের কুঁড়ে ঘর, বাড়ীর অবস্থাও মোটেই ভালো নয়। তবে আমাদের খাওয়ার জন্য তাদের অতিরিক্ত খরচ করতে হবেনা। এমনকি বালিশ কাঁথাও দিতে হবে না। যে যা নিয়ে এসেছে তাতেই চলবে। থাকাটাই হচ্ছে বড় অসুবিধা। অবশেষে আমাদের জন্য একটি ছোট্ট ঘর থাকার জন্য দেওয়া হল অর্থাৎ মা দুই বোন আর আমি । অন্যদেরও অন্য ঘরের বারান্দায় জায়গা করে দিল। আমাকে তেমন কস্টই করতে হয় নাই মা আর দু বোন সব সময় চোখে চোখে রাখতেন । আমরা ঘুমিয়ে গেলে মা নামাজ পড়ে বড় দুই ভাইয়ের জন্য দোয়া  করতেন। এভাবেই কেঁটে গেলো অনেক দিন।

এ বাড়ি থেকে আমরা অন্য বাড়ি গেলাম। কেননা এখানেও মিলিটারী আসতে পারে এই ভয়ে। কিভাবে সময় কেটে যাচ্ছে জানিনা। এক একটা দিন অনেক বড় মনে হতে লাগলো তার চেয়ে বড় মনে হতো রাত। আর ভাবতাম কখন বাড়ি ফিরে যাবে?

এদিকে এক দিন আমাদের বাড়ি টার্গেট করে মিলিটারির এক বিশাল বহর আসছে। খবর শুনে দাদী জায়নামাজ নিয়ে দুয়ারের মাঝে মোনাজাতে বসে গেছেন, বাবাও আর একটি জায়নামাজ নিয়ে বসে গেলেন। আজ আর রক্ষা নেই। সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিবে। সোজাসুজি আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে ছোট কাকা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন। আর ছটফট করছেন। হেঁটেহেঁটে একে বারে বাড়ীর কাছে এদের সাথে আছে রাজাকার করিম মোল্লা। বাড়ির কাছাকাছি ছোট কাকা কাঁদবেন না চিৎকার করবেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না।

কথায় আছে “রাখে আল্লাহ মারে কে” আল্লাহ সহায় থাকলেই কোন না কোন উপায় বের করেন। বাড়ির সামনে ছিলো পুকুর তখন পুকুর পাড়ে এসে সামনে যেতে একজন পানিতে পরে গেলে ভাগ্য ভালো যে মিলিটারী সাঁতার জানেনা । পুকুর দেখে আমাদের বাড়ি না এসে বাম দিক দিয়ে চলে গেল। করিম মোল্লা অনেক চেস্টা করেও ক্ষতি করতে পারলো না।

ছোট কাকা দেখতেছেন কলা গাছের ফাঁক দিয়ে যাতে গুলি ছুড়লেও গায়ে না লাগে। এই বুঝি গুলি ছুরবে কিন্তু না যখন দেখলো অন্য দিকে চলে যাচ্ছে তখন ছোট কাকা আনন্দে লাফিয়ে উঠে দাদীকে বলতে লাগলো “মা মা মেলিটারী চলে গেছে”। তখন দাদী ও বাবা মোনাজাত শেষ করে। মিলিটারী চলে যাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন।

মিলিটারী পাশের গ্রামে যেয়ে আগুন দিতে দিতে চলে যাচ্ছে।আমরা এ সবের কিছুই জানিনা । বাবার মুখে পরে শুনেছি। লোক মুখে যখন শুনলাম ইব্রাহিম পুর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে।মনে মনে ভাবলাম আমাদের বাড়ি আর নেই। বাবাকে হয়তো দেখতে পাবো না। তখন বর্ষার পানি নেমে গেছে। মাকে বললাম “মা এখানে থাকবো না চলে বাড়ি চলো “। আমি মারে জোর করেই বললাম মা চলে বাবার কাছে যাবো । মরলে এক সাথেই মরবো। ঠুসঠাস গুলির আওয়াজ কানে আসে। আগুনে ঘরবাডি পুড়ানো মানুষের চিৎকার শুনতে পাই।

আমার জোরাজুরিতে বা আবদারে মা আসতে বাধ্য হলেন। আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম ।আনন্দে আমার দু চোখে অশ্রু এলো।

কিছুদিন পর রেডিও তে খবর পেলাম মিলিটারীরা পরাজিত হয়ে আত্ম সমর্পন করেছে । দেশ স্বাধীন হয়েছে। সে কি আনন্দ। সেই থেকে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।

রেজাউল করিম মৃধা : ক্যামরা পার্সন, চ্যানেল এস নিউজ এবং কমিউনিটি এডিটর, ব্রিটবাংলা২৪.কম

Advertisement