সড়কে রক্ত এবং বিপন্ন মানবসম্পদ

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: মনে পড়ে স্কুলজীবনে প্রায় প্রতিটি শ্রেণিতেই জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কুফল নিয়ে পাঠ্যবইয়ে কোনো না কোনো বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত থাকত। তখন সৃজনশীল পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিবছর আমাদের মুখস্থ করতে হতো জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ, প্রভাব আর তা প্রতিকারের নানা উপায়। সে ছিল এক কষ্টকর ও বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। তখন টেলিভিশন চ্যানেল ছিল মাত্র একটি; নাম তার বিটিভি। সেখানে নিয়মিত প্রচারিত হতো জনসংখ্যার বৃদ্ধি রোধে সচেতনতামূলক নানা রকম গান, নাটিকা ইত্যাদি।

অধিক জনসংখ্যাকে অভিশাপ হিসেবে জেনেই বড় হয়েছি আমরা। সময় এখন বদলেছে। দেশের নীতিনির্ধারকেরা এখন জনসংখ্যাকে আগের মতো অভিশাপ বলেন না; বলেন মানবসম্পদ। তবে এ কি বিশ্বাসের বলা নাকি শুধু সময়ের প্রয়োজনে, সে বিতর্কে আজ না যাই।

সম্প্রতি আমরা উন্নয়নশীল দেশের মহাসড়কে উঠেছি। তীব্রগতিতে বিরতিহীন আমরা এগিয়ে চলেছি সামনে। লক্ষ্য আমাদের অনেক বড়। উন্নত দেশের বন্দরে পৌঁছে তবেই থামবে এ যাত্রা।

চালকের আসনে বসে ২০ কোটি মানবসম্পদ নিয়ে যাঁরা উন্নত দেশের গন্তব্যের দিকে অবিরাম ছুটে চলেছেন, তাঁরা আদৌ জনসংখ্যাকে মানবসম্পদ হিসেবে অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন কি না, সন্দেহ জাগে মনে! যদি সত্যিই তাঁরা তা বিশ্বাস করতেন, তবে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী, পুরুষ কিংবা শিশু গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে অকালে প্রাণ হারাত না। সম্পদ অঢেল হলে বুঝি এমনই হয়! কিছু সম্পদ বিলিয়ে দিলে কিংবা হারিয়ে গেলে হয়তো কিছুই আসে যায় না!

বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভের (বিএইচআইএস-২০১৬) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২৩ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেই হিসাবে ৬৪ জন মানুষ গড়ে প্রতিদিন প্রাণ হারায় সড়ক দুর্ঘটনায়। আর দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা এর থেকে অনেক গুণ বেশি। দুর্ঘটনায় ক্ষতি শুধু আহত কিংবা নিহত হওয়ার মধ্যে যে সীমাবদ্ধ থাকে, তা কিন্তু নয়। একেকটি আহত কিংবা নিহত মানুষের পেছনে থাকে এক একটি পরিবার। থাকে সেই পরিবারের নির্ভরতা, নিরাপত্তা, স্বপ্ন আর সম্ভাবনা। তাই এক একটি প্রাণের মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্বের অর্থ হলো সে পরিবারের অসহায়ত্ব, নিরাপত্তাহীনতা কিংবা এক একটি স্বপ্নের সমাধি। যিনি জীবনে এই পরিণতি দেখেছেন, শুধু তিনিই জানেন কী এর দুঃসহ যন্ত্রণা!

হতভাগা আকিফার বাবাই শুধু জানেন কী ভীষণ ভারী ছিল তঁার আট মাস বয়সী ছোট্ট শিশুকন্যাটির মৃতদেহ! শিশু আকিফার মায়ের কান্না কি কখনো থামবে? কদিন আগে স্বামী-সন্তান হারানো শামীমা আক্তারই শুধু জানবেন কী দুঃস্বপ্ন নিয়ে পার করতে হবে তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলো। এভাবে প্রতিদিন প্রকাশ্যে গণপরিবহনের নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে এ দেশের মানুষকে। তাই মনে হয় যে দেশের মানুষের জীবন এতটাই মূল্যহীন, সে দেশের জনগণকে আসলেই মানবসম্পদ বলা যায় কি? মূল্যহীন জীবন তো বোঝারই শামিল। বোঝা বললেও হয়তো কম বলা হয়; এ এক অভিশাপ।

এ অভিশাপ থেকে কি কোনো মুক্তি নেই? গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া গতির বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে নেমে এসেছিল রাস্তায়। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, তাঁরা মেনে নিয়েছেন শিক্ষার্থীদের সব দাবি। এরপর প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দাবিসমূহের বাস্তবায়ন সেভাবে চোখে পড়েনি। থামেনি সড়কে মৃত্যুর মিছিল। এবারও নিজ এলাকায় ঈদ উদ্‌যাপনের জন্য যাত্রা শুরু করে কিংবা ফিরতি পথে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে শত শত হতভাগা মানুষ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী শুধু ১৬ থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে মোট ২৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ২৫৯ জন মানুষ মারা গেছে এবং আহত হয়েছে ৯৬০ জন।

প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের স্বজনের আহাজারির দৃশ্য মানুষের অনুভূতিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন চোখে পড়েনি বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায়। আজও প্রবল পরাক্রমে ফিটনেসবিহীন গাড়ি অবাধে চলাচল করছে, লাইসেন্সবিহীন চালকেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রাজপথ, প্রতিমুহূর্তে ভাঙা হচ্ছে ট্রাফিক আইন, ট্রাফিক পুলিশরাও ফিরে গেছে তাদের আগের ভূমিকায়।

কদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নাকি আজকাল প্রতি ৪২ সেকেন্ডে একটি করে যানবাহনকে ফিটনেস সনদ দিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেখানে একটি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করতেই কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় লাগার কথা, সেখানে অস্বাভাবিক গতিসম্পন্ন ফিটনেস প্রদানের এ বিষয়টি সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে।

আমরা এই পরিস্থিতির অবসান চাই। আমরা চাই নিরাপদ সড়ক আর সুস্থ জীবনের নিরাপত্তা। ছাত্ররা আজ ঘরে ফিরে গেছে ঠিকই। কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতে থাকলে তারা বেশি দিন সেটা মেনে নেবে না। একবার যারা বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তারা প্রয়োজনে বারবার বেরিয়ে আসবে। শুধু ছাত্ররা নয়, রোজ সড়কে এবং গণপরিবহনে অরাজকতার শিকার হওয়া ভুক্তভোগী মানুষগুলোও বসে থাকবে না।

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার শত শত মানুষের রক্তে রঞ্জিত মহাসড়কের পথ বেয়ে কখনো আসতে পারে না উন্নয়ন। প্রতিটি মানুষের জীবন মূল্যবান। মানুষের অমূল্য জীবন পরিবহনের চাকার নিচে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। তাই বন্ধ করতে হবে সড়ক দুর্ঘটনা, বাঁচাতে হবে 
মানবসম্পদ।

Advertisement