হায়রে লন্ডন শান্তি নাই !

বাংলাদেশ থেকে আমরা একটি চাকচিক্যময় সুখের বিলেত আমরা দেখে থাকি। নিয়ন আলোর ঝলমলে বিলেতের সুখের মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে কতো যন্ত্রনা, বাস্তবতা। সেই কঠিন বাস্তবতার গুমড়ে উঠা কান্না কেউ শুনেনা। সাংবাদিক আ স ম মাসুম এক সময়ের চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের মতো নিজের মেধা মননের যোগ সূত্রের মধ্য দিয়ে নিজেকে মানুষের নিকট গ্রহনযোগ্য করে তুলেছেন ৷ বাস্তবতা, জীবন বোধ এবং সমসাময়িক বিষয় সৃজনশীল উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে সমাজের দৰ্পন হিসাবে  উঠে আসে আ স ম মাসুমের লেখনীতে ৷ ব্রিটবাংলার পাঠকদের জন্য বিলেতের যাপিত জীবনের সত্য ও বাস্তব চিত্র নিয়ে নিয়মিত আয়োজন  ” বাস্তবতার বিলেত”

————————————————————————

প্রথম পর্ব : হায়রে লন্ডন শান্তি নাই

অনেক স্বপ্ন নিয়ে জব্বার মিয়া এসেছিলেন বিলেতে! দীর্ঘ জীবনের কষ্টে রুজি-রোজগারের পর ছেলে হয়ে যায় সন্ত্রাসী, ড্রাগ ডিলার, ছিনতাইকারী! এমন গল্প নিয়ে আজ থেকে ১৫ বছর আগে ব্রিটেনের বাংলা কমিউনিটিতে নির্মিত হয় নাটক হায়রে লন্ডন শান্তি নাই! আলোড়ন তোলা এই নাটকটিই আসলে ব্রিটেনের বাংলা কমিউনিটির একটা অংশের বাস্তব চিত্র।

ব্রিটেনের বাংলা কমিউনিটিতে যেমন রয়েছে ব্যাপক সাফল্যগাথা তেমনি মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে বোবা কান্না আর অশান্তির দীর্ঘশ্বাস। বাংলাদেশ থেকে যেভাবে ব্রিটেনের চাকচিক্যময় সুখের এক ছবি আমরা দেখে থাকি সেটার বাইরেও এক চিত্র রয়েছে যেটি আসলে রয়ে যায় অজানা।

ইষ্ট লন্ডনের রফিক আলী, বয়স ৭০। ৫০ বছরের বিলেতের জীবনে যা করেছেন সবই দেশে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুরে ভাইয়ের কাছে বিনিয়োগ করেছেন। ফ্যাক্টরীতে দিনে-রাতে পরিশ্রম করে, নিজের বিলেতে থাকা পরিবার , সন্তানদের ঠিকমতো লালন-পালন না করে শুধু বাংলাদেশে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। নিজের সন্তান বড় হয়েছে অবহেলায়, অনাদরে কিন্তু দেশ থেকে ভাইয়ের চিঠি আসা মাত্রই পাগলের মতো টাকা পাঠিয়েছেন। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে দেখেন সবই গেছে। ভাই মারা যাওয়ার পরই, ভাতিজা-ভাতিজি সেই সব জমি-জমা দখল করেছে। সেই সাথে সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন মারা গেলে কবর হবে বাবা-মা-ভাইয়ের পাশে, দেশের মাটিতে সেই স্বপ্নেও গুড়েবালি। ভাতিজারা হুমকী দিয়েছে যদি রফিক মিয়া দেশে যায় তাহলে জানে মেরে ফেলবে। এদিকে রফিক আলী যেহেতু সারা জীবন সন্তান-পরিবারকে কষ্ট দিয়েছেন এখন সেই পরিবারে তিনি লাঞ্চনা – গঞ্জনার শিকার! দুই ছেলের একটি হয়েছে সন্ত্রাসী আর একটি ড্রাগ এডিক্ট। পালা করে জেল খাটে দুই ভাই!

সিলেট জেলার বালাগঞ্জের আরেক প্রবাসী সোনা মিয়া কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন।

জীবনের বড় অংশের রোজগারের টাকা চলে গেছে বাড়ী নির্মানে। বিলাসবহুল বাড়ীতে থাকার সুযোগ হয়েছে শুধুমাত্র ১ সপ্তাহ। আর নিজের যে পরিবারকে কষ্ট দিয়ে তিনি এই অট্রালিকা করেছেন সেই পরিবারতো সেই বাড়ীর শুধু ছবি দেখেছে! থাকারই সুযোগ হয়নি।

সোনা মিয়ার বাড়ী দখল করেছেন আপন মায়ের পেটের ভাই।

ইটালী থেকে ইউরোপিয়ান নাগরিক হিসাবে ব্রিটেনে এসে বছর দুয়েক হয় স্থায়ী হয়েছেন সুফিয়ান মালিক। চাদপুরের নিজের আপন ছোট বোন জামাইয়ের মাধ্যমে সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচ করে মার্কেট করেছেন। সেই মার্কেট দখল করেছে ছোট বোন জামাই। সুফিয়ান বলেন, ইটালী জীবনের ২৭ বছরের সকল ইনকাম দিয়েছি এই মার্কেট করার পেছনে। আজ আমি নি:স্ব হয়ে লন্ডনে ট্যাক্সি চালাই আর সরকারের সামাজিক ভাতা নিয়ে চলি।

মূলত ব্রিটেনে আসা প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের একটি বড় অংশ দেশের মায়ায়, আত্নীয় স্বজনের টানে, অনেকে নিজ এলাকায় প্রভাব- প্রতিপত্তি দেখানোর নেশায় এভাবে নিজেদের কষ্টার্জিত টাকার বড় একটি অংশ বিনিয়োগ করেছেন দেশে। এরা প্রতারনার শিকার হয়েছেন নিজের ভাই-ভাতিজা- আত্নীয়-স্বজনের হাতে । এদের ব্রিটেনের পরিবারে রয়েছে অশান্তি!

তরুন ক্যাব চালক রফি হক বলেন, আমার বাবা সারা জীবন দেশের আত্নীয় স্বজনকে দেখভাল করতে গিয়ে আমাদের ঠিকমতো লেখাপড়াই করাননি। তাই জিসিইসি’র পরই লেগে যাই রেস্টুরেন্টে কাজে। এখন ক্যাব চালাই। বাবা যা সম্পদ করেছেন দেশে তা আমরা ভোগ করাতো দূরের কথা, এই সম্পদই আমাদের জন্য কাটা হয়েছে। জানের মায়ায় এখন দেশেই যাই না।

সোনা মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, দেশেতো আসলে জমির দলিল কিনি নাই, মনে হয় আমার পরিবারের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা কিনেছি। দেশে আইনের আশ্রয় নিলেও হয়রানীর শেষ নাই। মেম্বার, চেয়ারম্যান, থানা, পুলিশ সবাই তাদের পক্ষে কথা বলে।

রফিক আলী, সোনা মিয়া বা সুফিয়ান মালিকের মতো ঘটনা ব্রিটেনে হাজার হাজার পরিবারে রয়েছে। শত শত পরিবারের দীর্ঘশ্বাসে হায়রে লন্ডন শান্তি নাই মাতম লুটোপুটি খায় চাকচিক্যময় ব্রিটেনের নিয়ন আলোয়!

আ স মাসুম :  ম্যানেজিং এডিটর, ব্রিটবাংলাটুয়েন্টিফোর।

Advertisement