​ইতালি ভ্রমণ : পর্ব দুই

।। ইমরান আহমেদ চৌধুরী।।

ত্রিশ বছরের জমে থাকা কত কথা। ইজি জেটে দুই ঘণ্টার ফ্লাইট লুটন (ইংল্যান্ড) থেকে। ফাতিমা সব গুছিয়ে দিল ব্যাগে। ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঢুকলাম বিমানবন্দরে। বোর্ডিং কার্ড অনলাইনে চেক করে নিয়েছিলাম আগেই। সোজা সিকিউরিটি চেক করে ঢুকে পড়লাম স্টারবাকসে। সেখানে বসে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর লেখা একটা বই পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে ফ্লাইট প্রায় মিস করেই ফেলেছিলাম। বইটির ওপর একটি রিভিউ লিখব ভেবে পড়ছিলাম। আর গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো হাইলাইট করতে গিয়ে কখন যে ফ্লাইটের গেট বন্ধ করে দিয়েছিল, তা একেবারে খেয়াল করিনি। হঠাৎ দেখেই দিলাম দৌড়, আধা বন্ধ গেট টেনে ধরে ঢুকে পড়লাম।

 

দুই ঘণ্টা বই পড়তে পড়তে চলে গেল, মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বিশাল সাগর, আর একটা দ্বীপের মতো জায়গা। প্লেন অবতরণের পর ফ্রেডি ফোনে যে বাসের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল, সেটি স্ক্যান করেই বাসে উঠে বসলাম। মার্কো পলো এয়ারপোর্ট থেকে ভেনিস শহরের প্রধান বাস স্টপে যেতে হবে, সেখানে ফ্রেডি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। নীল আকাশ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। ঘড়ির কাটায় কাটায় বাস ছাড়ল, বাসের এসিতেও গরম উপলব্ধি করলাম। ইংল্যান্ডে সকালে ডিগ্রি। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বের হয়েছি। এখানে ৩২৩৪ ডিগ্রি গরম, প্রচণ্ড রোদ। ঘামতে শুরু করেছি অনেক দিন পর। ২০ মিনিটেই ভেনিসে পৌঁছে গেলাম, রাস্তার দুই পাশের অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপহ্রদ (লেগুন) আর স্পিড বোট, প্রমোদ তরী আর পাল তোলা ডিঙিতে এমেচার নৌকাচালকেরা সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। ওই গভীর সমুদ্রে একা একা মেয়েরে শালতি (ডোঙা) এক কাঠের দুই পাশে বইঠাটা দিয়ে বামে ডানে বইঠা চালিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই দিগন্তের দিকে। নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি সাগরের পানিতে পড়েছে এমনভাবে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন, এই মাত্র কোনো শিল্পী আপন মনে বসে বসে মোটা তুলি দিয়ে নীল রং দিয়ে জলরাশিকে পেন্ট করে চলে গেছে। সূর্যের কিরণের বিচ্ছুরণ ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলোর প্রতিফলিত রশ্মি বিকিরণ করছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো রমণী তার আঁচলটি বিছিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে অপেক্ষা করছে তার পরদেশি নাবিক প্রেমিকের জন্য।

https://britbangla24.com/news/93323/

বাসের জানালা দিয়ে বামে আর ডানে তাকিয়ে অপরূপ উপহ্রদের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে চলে আসলাম ভেনিসে বুঝতেই পারিনি। বাসটা থামল। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজলাম ফ্রেডিকে, অনেক দুরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে হাফ পেন্ট পরা মাঝ বয়সী এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপের উপরে সান গ্লাসটা রাখা। ৩০ বছর পর একটু থমকে গিয়ে ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে নামলাম আর দেখলাম, ফ্রেডি আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে আসছে, মুখে ৩২টি দন্ত বিকশিত সেই পুরোনো হাসি। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলামবুকে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। ৩০ বছরে প্রচুর বদলে গেছি আমরা দুজনই। ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়েই হাঁটতে থাকলাম ভেনিসে বাসস্টপের পাশেই অদূরে ভেনিস রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে কথা, কুশল বিনিময় হলো। পরিবার নিয়ে কথা হল। স্টেশনে এসে দুটি টিকিট কিনল তার শহর পরডেনোনে যাওয়ার জন্য। রাত ১২টার ট্রেনে যাব আমরা; প্রায় ঘণ্টার জার্নি।

কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার আগেই হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখতে চাই ভেনিস শহরটাকে। স্বপ্নের শহর ভেনিস। ইতালিতে এর আগে চার চার বার গিয়েছি। কিন্তু উত্তর ইতালিতে আসা হয়নি একবারও। ফাতেমা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অবতার সে কোথা থেকে যেন শুনছে যে, ভেনিসের খালগুলোর পানিতে নাকি খুবই দুর্গন্ধ তাই ওকে কোন ভাবেই ভেনিসে নিয়ে যেতে রাজী করাতে পারি নাই কিন্তু, ওদের সবাই কে এভাবে ফেলে রেখে একা একা ভেনিস এর মত এত প্রসিদ্ধ পর্যটন ডেসটিনেশন এসে সম্পূর্ণ আনন্দটা পাচ্ছিলাম না ; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ভেনিসে একা একা সবই করবো কিন্তু ওদের সবাই কে ফেলে স্বার্থপরের মত ভেনিস এর সবচে বড় আকর্ষণ গন্ডোলা তে চড়বোনা

স্টেশন এর লাগেজ রাখার বক্সে সাইড বাগ হোল্ডল টা রেখে লক করে দিয়ে বেরিয়ে পরলামওহ ভীষণ গরম রোঁদ টা অত্যন্ত প্রকট , হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চাশ গজ হাঁটতেই পেলাম একটা ছোট্ট বাংলাদেশি টং জাতীয় দোকানঅনেক রকমারি জিনিস বিক্রি করছেশুভ্যেনির, ব্যাগ, হেট, থেকে শুরু করে খেলনা, শ্যাল, সেলফী স্টিক সবই আছে দোকানে; দোকানদার ৩০৩৫ বয়সী এক যুবক; ফ্রেডী আর অনর্গল ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলল আর এই ফাঁকে আমি একটা স্ট্র্ব জাতীয় একটা হ্যাট পছন্দ করলামআমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল লোকটার নাম ঝন্টু  বাড়ি ফরিদপুরের শরিয়তপুরে, ১৮ বছর যাবত আছে এখানে রকম আরও পাঁচটা টং দোকান আছে তার ভেনিসে সপরিবারে বসবাস করছে এখানেবউ, ছেলে এবং মেয়েরা সবাই একেক টা দোকান চালায় বেশ ভালোই আছে ঝন্টু সাহেব  একটু অপ্রস্তুত মনে হচ্ছিল যদিও নিজেকে তবুও বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এই ভেনিসে আমার বাংলার এক বাঙালি কে দেখে বেশ গর্বই বোধ করলাম কুশলাদি বিনিময় শেষে কিছুতেই পয়সা নিতে চাইল না জোড় করে ইউরো দিয়ে আসলাম এবং ওর দেশপ্রেম আতিথেয়তা দেখে খুবই মুগ্ধ হলাম চলে আসার সময় বলল যাবার সময় যেন আবার দেখা করে যাইতেলের পিঠা পাটালী গুড় দিয়ে বানানো ওগুলো খেয়ে যেতে বললশুনে মনটা ভরে গেলো বাঙ্গালীর অতিথি পরায়নতা বিশ্ব বিখ্যাতএইজন্যই মনে হয় বাঙ্গালীদের রেস্তোরাঁ ব্যাবসা এত সফল সব খানেই

হাঁটতে থাকলাম দুজনা ভেনিসের ক্যানালের পাড় দিয়ে প্রধান সেন্টমার্ক স্কয়ার এর দিকে কিন্তু প্রত্যেক কদমে কদমেই থেমে থেমে আই ফোন অথবা আমার প্রিয় সনি সাইবার শট ক্যামেরা দিয়ে তুলতে লাগলাম ছবি। ছবি তোলা আমার অন্যতম প্রধান সখ এই বিল্ডিং এর ছবি নেই, নয়ত খালের ছবি, অথবা স্পিড বোটে করে ছুটে যাচ্ছে একদল পর্যটকদেড় ছবি, কিংবা গন্ডোলা তে বসে আছে এক রোমান্টিক যুগল এবং নিপুণ হাঁতে লগি দিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে নৌকার মাঝির চাতুরীদুইটা দালানের মধ্যে খানে সরু খালের ভিতর দিয়ে কি সুন্দর ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বা বয়ে যাচ্ছে তার প্রমোদ নৌকাভেনিসের অন্যতম প্রদান বৈচিত্র্যময় এই নৌকা ( ওদের দেশে এটা কে বলে গন্ডোলা ) – একটু খারাপ লাগল আমি নিজে চরলাম না বলেআমি দেখতে চাচ্ছিলাম নৌকায় বসলে নৌকা থেকে শহর টা কেমন দেখায় কিছুক্ষণ পর পর একেকটা ছোট্ট সাঁকো জাতীয় পুল এই খাল থেকে  খালে, এই দালান থেকে দালানে যাবার জন্য প্রায় ১৬০০ বছর যাবত এই নগরী টা দাঁড়িয়ে আছে পানির উপড়েসেই ৪২১ খ্রিস্টাব্দে ২৫সে   মার্চ  শুক্রবার উচ্চদ্বিপ্রহরের সময়   গোড়াপত্তন হয়ে ছিল এই শহরের ১১৮ টা  ছোট ছোটদ্বীপ জেগে উঠেছিল হয়তোবা কোন আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে এই অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের শেষ পাড়ের কিনারে সেই কয়েক লক্ষ বছর আগেসমতল  ভূমি থেকে   সাগরের পানি দ্বারা বিছিন্ন ; কেউ কি চায় এইরকম বিছিন্ন জায়গায় বসবাস করতে ? কিন্তু, জীবন মানেই সারভাইভাল ফর দি ফিটেস্ট ( শক্তিবান কেবল বেঁচে থাকতে পারে ) বর্বরদের আক্রমণ এবং আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য এর এই দ্বীপমালায় বসতি গড়ে তুলে কিন্তু সমস্যা দেখা দিল জায়গার স্বল্পতা এবং পানির এত নিকটে কিভাবে টেকসই আবাস গড়ে তোলা যায় বর্বররা পদাতিক আগ্রাসনে পটু ছিল ওদের সেই আমলে নৌ কেদ্রিক চলাচল পারদর্শী হয়ে উঠে তখনো তাই এই দ্বীপমালায় যারা বসতি গড়ে তুলেছিল তারা বর্বরদের তীক্ষ্ণ তরবারির কোপ থেকে রক্ষা পায় সে যাত্রা তারপর তারপরই সেই জনগণ আসতে আসতে গড়ে তুলে এই বিশাল নগরী , যেখানে এখন প্রতি বছর আড়াই কোটি পর্যটক পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে বেড়াতে আসে জাহাজ ভড়ে ভড়ে, প্রমোদ তরী নিয়ে, প্লেন ভড়ে বছরের বারো মাসই  এখানে লোকে লোকারণ্য জলাশয়ের মধ্যে কাঠের স্তম্ভ পুতে পুতে সেই কাঠের স্তম্ভের উপর দালানের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনকরে ভিত্তি প্রস্তরের উপর নির্মাণ করে সব দালান এবং রাজ প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা গুলোথরে থরে সাজানো দালানগুলো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়েসেই সব কাঠের স্তম্ভগুলো সেই মধ্য যুগের মিস্ত্রিরা এতই সুনিপুন ভাবে একটা স্তম্ভের গাঁ লাগিয়ে আরেকটা স্তম্ভ মাটিতে পুঁতেছে যা নাকি যাতে কাঠ ভেদ করে পানি দালানের পাদদেশে প্রবেশ করতে না পারে কাঠ সচরাচর পানিতে পচে না তাই এখন অনেক দালানের ভিত্তির কাঠ এর বয়েস এক হাজার বছরের অধিক প্রথম আগত পলাতক লোকজন জলবন্দী এলাকায় মৎস্যজীবীদের সাথে বসবাস করতে থাকে ক্রমান্বয়ে আরও মানুষরা আসতে থাকে বর্বর আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য –  তখন দেখা দেয় জায়গার সংকুলতাসবাই মিলে সমুদ্রের উপহ্রদ কাটে অনেকগুলো সংযোগ খাল আর আস্তে আস্তে গড়ে তুলে কাদায় পরিপূর্ণ জলাভূমিতে গড়ে তুলে একবিশাল জনপদ। ভরা জোয়ার এর সময় এক্যুয়া আলটা কারণে প্রায়শই এই নগরী প্লাবিত হয়  আজ অনেকেই ভেনিস কে নিম্মজিত শহর বলে ডাকে কিন্তু দালানের ভাঁড়ে কাদা এবং ময়লাগুলোকে সংকোচিত হয়ে একেবারে শক্ত ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে কাজ করছে এবং  যার ফলে দালানগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায় যদিও গত ১০০ বছরে এই শহর প্রায় ইঞ্চির সম পরিমাণ মাটিতে দেবে  গেছে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করছে ২০২১ সালে হয়ত  এড্রীয়াটিক সাগরের এই উপহ্রদ টা প্রায় নিম্মজিত হয়ে যেতেও পারে এই শহর দেখে রাশিয়ান নাম করা এক লেখক আলেক্সজান্ডার হেরযেন একদা বলেছিলেন, ‘’ যেখানে শহর বানানো সম্ভব নয় সেখানে শহর বানানো পাগলামি , আর জায়গায় সবচেমার্জিত এবং এই রকম মহীয়ান  নগরী বানানো একটা প্রতিভাবান পাগলামির কাজ ‘’

লেখক : বাংলাদেশের সাবেক সেনা সদস্য ও ইতিহাসবিদ, ব্যবসায়ী এবং কমিউনিটি এক্টিভিস্ট। নর্থাম্পনশায়ার।

Advertisement