বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বছরে দেড় হাজারের বেশী ডিভোর্স !

বাংলাদেশ থেকে আমরা একটি চাকচিক্যময় সুখের বিলেত আমরা দেখে থাকি। নিয়ন আলোর ঝলমলে বিলেতের সুখের মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে কতো যন্ত্রনা, বাস্তবতা। সেই কঠিন বাস্তবতার গুমড়ে উঠা কান্না কেউ শুনেনা। সাংবাদিক আ স ম মাসুম এক সময়ের চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের মতো নিজের মেধা মননের যোগ সূত্রের মধ্য দিয়ে নিজেকে মানুষের নিকট গ্রহনযোগ্য করে তুলেছেন ৷ বাস্তবতা, জীবন বোধ এবং সমসাময়িক বিষয় সৃজনশীল উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে সমাজের দৰ্পন হিসাবে  উঠে আসে আ স ম মাসুমের লেখনীতে ৷ ব্রিটবাংলার পাঠকদের জন্য বিলেতের যাপিত জীবনের সত্য ও বাস্তব চিত্র নিয়ে নিয়মিত আয়োজন  ” বাস্তবতার বিলেত———————————————

দ্বিতীয় পর্ব –

বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বছরে দেড় হাজারের বেশী ডিভোর্স ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুারো’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে ব্রিটেনে অফিসিয়াল বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে ১ লক্ষ ৬ হাজার ৯শত ৫৯টি! ব্রিটেনের বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন আইনী সহায়তা প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে জানা গেছে বাংলাদেশী কমিউনিতে বছরে ১৫০০ থেকে ১৮০০ বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে থাকে যা জাতীয় গড়ের ১.৫ শতাংশের উপরে! মাত্র ১২-১৩ লাখের মানুষের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এ সংখ্যা নিসন্দেহে অনেক বেশি।

 

এতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক বিবাহ বিচ্ছেদের কারন হিসাবে কিংডম সলিসিটর এর প্রিন্সিপাল তারেক চৌধুরী বলেন,ডিভোর্সের ব্যাপারে আসলে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে।মূলত যৌথ পরিবারে ডিভোর্সের ঘটনা বেশি ঘটে।সেই সাথে স্বামী-স্ত্রী’র ব্যক্তিত্বের দ্বন্ধ, কর্তৃত্বের সমস্যাও আছে। তবে এখনও স্বামী বা স্ত্রী একে অপরের যোগ্য নয়, পারিবারিক চাপে বিয়ে করে মনের অমিল ইত্যাদিই বড় একটি কারন ব্রিটেনে ডিভোর্স হওয়ার জন্য।

আফিয়া’র ( ছদ্মনাম ) বয়স যখন ১৮ তখনই একদিন শুনেন লন্ডনে থাকা খালাতো ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরিবারের আফিয়ার খাতির বেড়ে যায়, আফিয়া মনে স্বপ্ন আকে একটি সুন্দর ভবিষতের। দুরু দুরু বুকে বিয়ের পিড়িতে সে বসে।

একদিন চলে আসে লন্ডনে। শুরু হয় স্বপ্ন ভঙ্গের দিন! স্বামী ড্রাগ এডিক্ট। আফিয়া এক সময় সে নিজেকে আবিস্কার করে শ্বশুর-শাশুড়ীসহ ১১ জনের পরিবারের দাসী হিসাবে। সকাল থেকে রাত অবিদ অমানুষিক পরিশ্রম সেই সাথে স্বামীর সাথে অমিল, এক পর্যায়ে নিয়মিত নির্যাতনের ঘটনা ঘটতেই থাকে। ৪ বছর নির্যাতন সহ্য করে আফিয়া এখন সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থার অধীনে রয়েছেন। আবেদন করেছেন ডিভোর্সের জন্য।
সুমাইয়া বেগম (ছদ্মনাম ) ব্রিটেনে জন্ম ও বেড়ে উঠা। লেখাপড়া করেছেন নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিবারের চাপে ২০০৫ সালে বাংলাদেশের গ্রামে গিয়ে বিয়ে করেন আপন চাচাতো ভাই জিয়াউল আহমেদকে (ছদ্মনাম ) । জিয়াউল ব্রিটেনে আসেন ২০০৬ সালে। আসার পরই শুরু হয় অশান্তি। জিয়াউলের লেখাপড়া কম, ইংরেজি ভাষাজ্ঞান নেই বললেই চলে। একসময় দুজনের মধ্যে এইসব নিয়ে শুরু হয় দ্বন্ধ।

একদিন ঝগড়ার পর সুমাইয়া পুলিশে অভিযোগ করেন জিয়াউল (ছদ্মনাম ) তাকে মানসিক এবং শারিরীক নির্যাতন করছেন। পুলিশ নিয়ে যায় জিয়াউলকে। বিষয়টি এক পর্যায়ে ডিভোর্সে গড়ায়।
জিয়াউল আহমেদ দু:খ করে বলেন, আমি পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। ঝগড়া-ঝাটি পর্যন্তই ছিলো বিষয়টি। কিন্তু মারামারির বিষয়টি আমাকে হেনস্থা করার জন্য সে পুলিশে বলেছিলো।
এই ঘটনার বিপরীত চিত্রও আছে। ব্রিটেনে বেড়ে উঠা ছেলে মুস্তাক মিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশে আপন খালাতো বোন শিরিন বেগমের সাথে বিয়ে দেয়া হয়।

ব্রিটেনে আসার পর মুস্তাক আর শিরিনের মধ্যে প্রতিদিনই সমস্যা হতে থাকে। ইতিমধ্যে মুস্তাক এবং শিরিনের ঘরে দুই সন্তান। শিরিনের অভিযোগ, মুস্তাকের সংসারের প্রতি কোন টান নেই। আর মুস্তাকের অভিযোগ, শিরিনের সাথে তিনি মানিয়ে নিতে পারছেন না। ফলশ্রুতিতে রেজাল্ট শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স।
ব্রিটেনের বাংলা কমিউনিটিতে তৃতীয় প্রজন্মের একটা বড় অংশ এইরকম পারিবারিক অশান্তির শিকার। মূলত নব্বই দশকের শুরু থেকে শুরু হওয়া এইসব ঘটনা এখনও কমিউনিটিতে ঘটছে।

বাংলাদেশী মালিকানাধীন আইনী প্রতিষ্টানগুলো সারা বছরে যেসব কেইস পরিচালনা করেন তার বড় একটি বড় অংশ হচ্ছে পারিবারিক এইসব ঝামেলা সংক্রান্ত। যার ৯০ শতাংশের পরিনতি হয় ডিভোর্স।
কিংডম সলিসিটর এর প্রিন্সিপাল ব্যারিষ্টার তারেক চৌধুরী জানান, উনার প্রতিষ্ঠান থেকেই বছরে ৩৫ এর অধিক ডিভোর্স কেস পরিচালনা করতে হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে ১০০ এর উপর বাংলাদেশী আইনী প্রতিষ্টান রয়েছে। সেই হিসাবে বছরে দেড় হাজারের বেশি ডিভোর্স হয় বাংলাদেশী কমিউনিটিতে।
পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী সাবিনা আখতার বলেন, সারা বছরে যেসব অভিযোগ আমাদের কাছে আসে তার একটি বড় অংশ হচ্ছে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারনে সংসারে অশান্তি।

বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এখন বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করার প্রবনতা কমেছে এর বড় কারন হচ্ছে গত এক দশকে হাজার হাজার ডিভোর্স হয়েছে শুধুমাত্র কালচারাল ব্যবধানের কারনে।

আ স মাসুম:ম্যানেজিংএডিটর,ব্রিটবাংলা টুয়েন্টি ফোর।

Advertisement