অধিকার হরণের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: মানবাধিকার পরিষদের ৩৪/২২ প্রস্তাব অনুযায়ী মিয়ানমার বিষয়ে বর্তমান আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধানী মিশনটি গঠন করা হয়। মারজুকি দারুসমানকে (ইন্দোনেশিয়া) চেয়ারপারসন এবং রাধিকা কুমারাস্বামী (শ্রীলঙ্কা) ও ক্রিস্টোফার সিডোটিকে (অস্ট্রেলিয়া) সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন পরিষদের সভাপতি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) এ বিষয়ে একটি সচিবালয়ও প্রতিষ্ঠা করে।

পরিষদের ৩৬তম অধিবেশনে মৌখিকভাবে মিশনের কাজের অগ্রগতি অবহিত করা হয় এবং ৩৭তম অধিবেশনে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর বিশেষ অধিবেশনে একটি ভিডিও বিবৃতিও উপস্থাপন করা হয়। ৩৯তম অধিবেশনে মিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের অনুরোধ করে পরিষদের ৩৬/১১৫ সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহিত করতে ওই বিবৃতি দেওয়া হয়। এরপর অনুসন্ধানে পাওয়া প্রধান প্রধান তথ্য ও সুপারিশগুলো দাখিল করা হয়। এ/এইচআরসি/৩৯/সিআরপি.২ নথিতে তা বিশদভাবে আছে।

পরিষদ ও মিশনের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকারের দিক থেকে সহযোগিতা না পেয়ে মিশন হতাশা প্রকাশ করে। মিয়ানমারে ঢোকার অনুমতি চেয়ে ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ও ১৭ নভেম্বর এবং ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি দেশটিকে মিশনের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিশনের অনানুষ্ঠানিক কিছু যোগাযোগ ছিল, কিন্তু তারপরও ওই চিঠিগুলোর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এই প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ করার আগে মিয়ানমার সরকারকে দেওয়া হয়েছে। তাতেও কোনো সাড়া মেলেনি।

দুই. এখতিয়ার ও পদ্ধতি

ক. এখতিয়ার

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে—বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে—দেশটির সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়া নিশ্চিত করতে ৩৪/২২ প্রস্তাবে প্রমাণাদি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের এখতিয়ার দেওয়া হয়।

২০১১ সাল থেকে কাচিন, রাখাইন ও শান রাজ্যের পরিস্থিতির ওপর মিশন আলোকপাত করে। সে অনুযায়ী, ২০১১ সালে কাচিনে বৈরী অবস্থার সূচনা ও শানে পরিস্থিতির আরও অবনতি এবং ২০১২ সালে রাখাইনে বড় ধরনের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ওপর নজর দেওয়া। এ ঘটনাগুলোই পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই সময় থেকেই বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নতুন করে আসতে থাকে। বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য কমিশন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নির্বাচন করে, যাতে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনার পাশাপাশি অধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। অন্য কোনো ক্ষেত্রে বড় ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে সেখানে আরও তদন্ত করা হয়।

খ. পদ্ধতি

বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ভিত্তি ‘যুক্তিসংগত’ মান অনুযায়ী তথ্যপ্রমাণ। পর্যাপ্ত ও বিশ্বাসযোগ্য প্রাথমিক তথ্যের সঙ্গে যখন অন্য তথ্য মিলে যায়, তখন একজন বিবেচক মানুষ যুক্তিসংগতভাবে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারে, কোনো একটি ঘটনা বা ঘটনাধারা সংঘটিত হয়েছে।

মিশন বিপুল পরিমাণে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে। ৮৭৫ জন ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিস্তারিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। তাদের নির্বাচন করা হয় দৈবচয়নের ভিত্তিতে। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য এবং অনেক নথি, ছবি ও ভিডিও চিত্রও হাতে আসে। এসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা দ্বিতীয় পর্যায়ে যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন সংস্থার প্রাথমিক তথ্য, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার, প্রতিবেদন ও অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। যৌন সহিংসতা, শিশু মনস্তত্ত্ব, সামরিক বিষয় বা ফরেনসিকের মতো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামতও নেওয়া হয়েছে। যাচাইকৃত ও গ্রহণযোগ্য তথ্যের ওপরই আস্থা রাখা হয়েছে।

তথ্য সংগ্রহের জন্য মিশনের সদস্যরা বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। মিশন সচিবালয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত অনেকগুলো অতিরিক্ত ফিল্ড মিশনের ব্যবস্থা করে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্তা, গবেষক ও কূটনীতিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ২৫০টি পরামর্শের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে কারও কারও সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে এবং কারও কারও সঙ্গে দূর থেকে যোগাযোগ করা হয়। অনেকের কাছ থেকে লিখিত পরামর্শও নেওয়া হয়েছে।

মিশনের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার নীতি জোরালোভাবে বজায় রাখা হয়। তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে তথ্যদাতার অনুমতি যেমন নেওয়া হয়েছে, তেমনই প্রয়োজনমাফিক তাদের পরিচয়ও গোপন রাখা হয়েছে। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, কেউ যাতে প্রতিশোধের শিকার না হন। মিয়ানমারের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মানবাধিকার পরিষদকে সহযোগিতা করার কারণে যেসব ব্যক্তিকে ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে, তাদের ব্যাপারে মিশন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

গ. আইনি কাঠামো

মিয়ানমারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মানবাধিকার বিষয়ক এমন আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক দাতব্য আইন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ভিত্তিতেই তথ্যগুলো যাচাই করা হয়েছে। কাচিন ও শান রাজ্যের স্থানীয় সশস্ত্র সংঘাত ছাড়াও রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা, বিশেষ করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের সহিংসতাকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) এবং মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর স্থানীয় সশস্ত্র সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

তিন. প্রেক্ষাপট

সেনাবাহিনী ১৯৬২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে মিয়ানমার শাসন করে আসছে। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর তৈরি নতুন একটি সংবিধান গৃহীত হয়। তাতে দেশের রাজনীতি ও শাসনক্ষমতায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব যথারীতি বজায় থাকে। নতুন সংবিধান অনুযায়ী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের মিশ্রণে একটি সরকারব্যবস্থা চালু হয়। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই সেনাবাহিনীর (তাতমাদো নামে পরিচিত) জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রয়েছে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় (প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্র) এবং দুজন উপরাষ্ট্রপতির অন্তত একটি পদ তাদের জন্য সংরক্ষিত। জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এবং সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা রুখে দিতে এগুলোই যথেষ্ট। বেসামরিক প্রশাসন নজরদারি ছাড়াই নিজেদের বিষয়ে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং তা বাস্তবায়নের অধিকার সেনাবাহিনীর আছে। সরকারের সব বিভাগ, সিভিল সার্ভিস ও বিচার বিভাগ এবং সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদেরই কর্তৃত্ব। থেইন সেইন সরকার সংবিধান সংশোধন না করেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয় অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। ২০১৬ সালের মার্চে এ দলের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়। এরপর দেশটির ওপরে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করা হয়।

মিয়ানমারে বামার ছাড়াও নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। মোট জনসংখ্যার এরা ৩২ শতাংশ। স্বাধীনতার পর থেকেই নিজেদের কর্তৃত্ব জায়েজ করতে এবং দেশের ঐক্যের রক্ষক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে সেনাবাহিনী জাতিভিত্তিক সশস্ত্র সহিংসতা কাজে লাগিয়ে আসছে। এর মধ্যে অনেকগুলো জাতি ব্যাপক দুর্দশার মধ্যে আছে। বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যায্য অংশের দাবিতে তারা সংগ্রাম করছে। সরকার শান্তিচুক্তির প্রস্তাব দিলেও বৈরী অবস্থা অব্যাহত রয়েছে। চলমান এই সংঘাত থেকে প্রমাণিত হয়, সেনাবাহিনীর জাতিগঠনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। ‘মিয়ানমার’ জাতীয় পরিচিতির জন্য কোনো ঐক্যপ্রক্রিয়া নেই এবং বামার-বৌদ্ধ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ শুধু বেড়েই চলেছে। সামরিক শাসনের অধীনে রাজনৈতিক বলয়ের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে ‘জাতীয় গোষ্ঠীর’ বিষয়টিই দিনে দিনে প্রধান বিবেচ্য হয়ে উঠছে এবং এতে করে সৃষ্টি হচ্ছে ‘অন্যান্য’ শ্রেণি। জান্তা সরকার ৮টি বৃহত্তর গোষ্ঠীকে ভেঙে ১৩৫টি ‘জাতীয় গোষ্ঠী’ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছে। এই তালিকা অনুযায়ীই নির্ধারিত হয় কে মিয়ানমারের মানুষ, কে নয়। যারা এর বাইরে, যত প্রজন্ম ধরেই মিয়ানমারে বসবাস করুক না কেন, তারা বহিরাগত বা অভিবাসী হিসেবে বিবেচিত হয়। রোহিঙ্গারাও এর মধ্যে পড়ে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভাষ্য, ‘কাক ময়ূরের ঝাঁকের মধ্যে থাকলেও কখনো ময়ূর হতে পারে না।’

২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, মিয়ানমারের জনসংখ্যার ৮৭ দশমিক ৯ শতাংশ বৌদ্ধ, ৬ দশমিক ২ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ৪ দশমিক ৩ শতাংশ মুসলমান। বামারদের অধিকাংশই বৌদ্ধ। তবে অন্যান্য অনেক জাতিসত্তার একটি বড় অংশ বৌদ্ধ নয়। ১৯৬০-এর দশকে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে সমাজে বিভেদের সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সালের সংবিধানে অন্যান্য ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বৌদ্ধধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। এরপর ২০১১ সালে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটিতে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের জোয়ার লক্ষ করা যায় এবং মুসলমান-বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘাত। বৌদ্ধদের জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন (মাবাথা)। এরা নিজেদের বৌদ্ধ মতাদর্শের রক্ষক বলে দাবি করে। এই সংগঠনটি ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হলেও এর সদস্যরা অন্য সংগঠন গঠন করে। তাদের জনসমর্থন ব্যাপক।

বামার-বৌদ্ধ সংখ্যাগুরুদের মধ্যে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা এখন ব্যাপক। সংঘাত, বিশেষত ‘রোহিঙ্গা সংকট’ কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনী ঝুঁকির সময়ে জাতির রক্ষক হিসেবে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে, নিজেদের রাজনৈতিক ভূমিকা আরও শক্তিশালী করেছে। মানবাধিকার বিষয়ে সেনাবাহিনীর আতঙ্কজনক রেকর্ড এবং তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘের কাছে ৩০ বছর ধরে মিয়ানমার একটি উদ্বেগের দেশ। ১৯৯১ সাল থেকেই দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ। তিন দশক ধরে একের পর এক মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার এমন প্রতিবেদন দিয়ে গেছেন যে দেশটিতে ব্যাপক ও পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে রাষ্ট্র ও সামরিক নীতি। মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন ঘটেছে ২০১১ সাল থেকেই। এ প্রতিবেদনে সেদিকেই দৃষ্টি দেওয়া হবে।

চার. বিশেষ পরিস্থিতি

তিনটি বিশেষ পরিস্থিতির দিকে বর্তমান মিশন নজর দিয়েছে: রাখাইন রাজ্যের সংকট, কাচিন ও শান রাজ্যের সংঘাত এবং ঘৃণামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মৌলিক স্বাধীনতা চর্চার লঙ্ঘন।

ক. রাখাইন রাজ্য

রাখাইন রাজ্যে দারিদ্র্যের হার জাতীয় হারের দ্বিগুণ। সেখানে বসবাসরত প্রতিটি সম্প্রদায়ই নিম্ন সামাজিক সুবিধা এবং জীবনযাপনের সুবিধাগুলোর ঘাটতির শিকার। রাজ্যটির বড় দুটি সম্প্রদায় হলো রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমান। রাখাইনরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অবশ্য রোহিঙ্গারাই। সেখানে সংখ্যালঘু অন্য জাতিগোষ্ঠীও আছে। যেমন কামান মুসলিম। রাজ্যের সমস্যা হিসেবে প্রায়শই সামনে আনা হয় রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সম্পর্ককে। এর শিকড় প্রোথিত দীর্ঘ বঞ্চনা ও পক্ষপাতে। রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের বেশির ভাগের সাক্ষাৎকার থেকে অবশ্য এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ২০১২ সালের আগে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এতটা খারাপ ছিল না। এর উদাহরণ হিসেবে তারা পরস্পরের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বন্ধুত্বের কথা বলেছে।

১. রাখাইনদের অধিকার লঙ্ঘন

‘দুনিয়ার সবাইকে আমি আমার কাহিনি শোনাতে চাই। কারণ, মানুষ জানে না আমাদের এখানে কী ঘটছে।’

এই মিশনের পক্ষ থেকে রাখাইনদের অনেকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তারাও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ করেছেন। দেশটির অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যে ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার, তাদের ক্ষেত্রে লঙ্ঘনের ধরনও তেমনই।

সেনাবাহিনী রাখাইন পুরুষ, নারী ও শিশুদের জোর করে বাধ্যতামূলক শ্রমিকের কাজে ব্যবহার করে, বিশেষ করে কুলির কাজে। এ ছাড়া ভূমি বাজেয়াপ্ত করে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, উদ্দেশ্যমূলক গ্রেপ্তার ও বন্দী করার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ করা হয়েছে। জোর করে কাজ করানোর নামে রাখাইন নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাও চালান সেনাসদস্যরা। উদাহরণ হিসেবে এক নারী বলেন, ২০১৭ সালে তাঁকে তুলে নিয়ে একটি সেনাঘাঁটিতে নেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন সেখানে তাঁকে মারধর ও ধর্ষণ করেন।

রাখাইন-সত্তার বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের ঘটনাও মিশনের নজরে এসেছে। যেমন ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মারুক-উতে রাখাইনদের বার্ষিক অনুষ্ঠান বন্ধ করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে। এতে সাত বিক্ষোভকারী নিহত হয়।

২. পদ্ধতিগত পীড়ন ও রোহিঙ্গাদের দুর্দশা

রোহিঙ্গাদের ‘ভিন্ন’ হিসেবে উপস্থাপন করা এবং তাদের প্রতি বঞ্চনামূলক ব্যবহারের শুরু ২০১২ সালেরও বহু আগে থেকে। দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্রীয় বৈষম্যমূলক নীতির মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের চরম অসহায় এবং প্রান্তিক এক গোষ্ঠীতে পর্যবসিত করা হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তারা চরম, পদ্ধতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পীড়নের শিকার।

এসব পীড়নপদ্ধতির অন্যতম ভিত্তি হলো তাদের আইনি স্বীকৃতির ঘাটতি। একের পর এক আইন ও নীতির মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এতে অধিকাংশ রোহিঙ্গাই কার্যত রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছে। জাতীয়তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে এর সমাধান হয়নি—সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে আছে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের প্রস্তাব। আর তার মূলে আছে ‘জাতীয় গোষ্ঠীর’ ধারণার প্রাধান্য এবং এর বিভেদমূলক ভাষ্য, যার শুরু ১৯৬০-এর দশকে জান্তা শাসক নে উইনের আমলে। ‘জাতীয় গোষ্ঠীর’ সঙ্গে নাগরিকত্বের এই সম্পর্ক রোহিঙ্গাদের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে এনেছে।

জান্তা শাসনামলে বর্জনের নীতি বাস্তবায়নের প্রারম্ভ ছিল ১৯৭০ ও ১৯৯০-এর দশকে রোহিঙ্গা-বিতাড়ন। এর ফলে যে একটি মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসহ পর্যবেক্ষকেরা কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করে আসছিলেন।

বৈষম্যমূলক ভ্রমণ অনুমোদন পদ্ধতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম বা শহরতলির মধ্যে চলাচল এবং রাখাইন রাজ্যের বাইরে যাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সীমাবদ্ধ ছিল। এর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকারের ওপর। রাখাইন রাজ্যে অপুষ্টির হার শঙ্কাজনকভাবে অনেক বেশি। বৈষম্যমূলক অন্যান্য বাধা-নিষেধের মধ্যে আছে বিয়ের অনুমোদন পদ্ধতি, সন্তান গ্রহণ ও দুই সন্তানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান নিয়ন্ত্রণ এবং রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব। দশকের পর দশক ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর লুট ও ভয়ভীতির শিকার রোহিঙ্গারা। উদ্দেশ্যমূলক গ্রেপ্তার, বাধ্যতামূলক শ্রম, নিপীড়ন ও যৌন সহিংসতা সর্বত্র।

৩. ২০১২ সালের সহিংসতা

এমন এক প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালের জুন ও অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে দুটি বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটে, আক্রান্ত হয় ১২টি এলাকা। রাখাইন এক নারীকে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগ এবং ১০ রোহিঙ্গা মুসল্লিকে হত্যার ঘটনা থেকে সূত্রপাত হয় ওই সহিংসতার। সরকারি তদন্ত কমিশনের হিসাবমতে, তাতে ১৯২ জন নিহত, ২৬৫ জন আহত ও ৮,৬১৪টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। হতাহতের সঠিক সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি। এরপর ২০১৩ সালে থান্ডতেও সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

সরকার এসব সহিংসতাকে দেখায় রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে ‘আন্তসাম্প্রদায়িক’ সংঘাত হিসেবে। এক অর্থে তা ঠিক, তবে যথার্থ নয়। রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে, এতে প্রাণহানি ও সম্পদও ধ্বংস হচ্ছে; কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের বৈরিতার জের ধরে এটা যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটছে, তা বলা যাবে না। পরিকল্পিতভাবে সংঘাত বাধানোর এবং উত্তেজনা উসকে দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এবং তাদের হেয় করার একটি প্রচারণা কয়েক মাস ধরেই চলছিল। ২০১২ সালের ৮ জুনের পর তা হঠাৎ করে চাঙা হয়ে ওঠে। এসবে নেতৃত্ব দেয় রাখাইন ন্যাশনালিস্ট পার্টি (আরএনডিপি), রাখাইনদের বিভিন্ন সংগঠন, কট্টর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কিছু সংগঠন, কয়েকজন কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। রোহিঙ্গা বা মুসলিমবিদ্বেষী প্রকাশনা, প্রচারপত্র, সভা-সমাবেশ ও মুসলমানদের দোকান বর্জনের মাধ্যমে এসব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবে রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ অভিবাসী’, ‘সন্ত্রাসী’ এবং অতিরিক্ত জন্মহারের মাধ্যমে তারা ‘অন্যান্য জাতিসত্তাকে গ্রাস’ করে ফেলতে পারে এমন একটি হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়। আরএনডিপি ২০১২ সালের নভেম্বরে হিটলারকে উদ্ধৃত করে দাবি করে ‘জাতিরক্ষা’য় কোনো কোনো সময় ‘মানবতাবিরোধী কাজ’ও করা যায়।

মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী দুষ্কর্মের সহায়ক। তারা কখনো সহিংসতা বন্ধে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে, কখনো সক্রিয়ভাবে সহিংসতায় অংশ নিয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের খুন, জখম এবং তাদের সম্পদ ধ্বংস করেছে। সিত্তে এবং কিয়াউকপিউর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাখাইনরা রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিমদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর নেভাতে গেলে নিরাপত্তা বাহিনী বাধা দেয়। আর মংডুর প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে; তাদের ও রোহিঙ্গা এনজিও কর্মীদের গণগ্রেপ্তার করেছে। এদের বড় একটি অংশকে বুচিডং কারাগারে নেওয়া হয়। সেখানে তারা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। কারারক্ষী ও রাখাইন বন্দীরা তাদের মারধর করে। এতে কেউ কেউ হতাহত হয়।

রাখাইনের ২০১২ সালের এই সহিংসতাই ছিল মোড় বদলের ঘটনা। রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। বেড়ে যায় ভীতি ও অবিশ্বাস। কামান মুসলিমরা স্বীকৃত একটি জাতিগোষ্ঠী হলেও রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি তারাও হামলার শিকার হয় এবং আরও বেশি বৈষম্যের মুখে পড়ে।

এসব সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি আরও বাড়িয়ে দেয় এবং সম্প্রদায়গুলোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ২০১২ সালের ১০ জুন যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয় চার বছর পর, ২০১৬ সালের মার্চে। রাখাইনের বিভিন্ন শহরতলিতে কারফিউ জারি করে কর্তৃপক্ষ। পাঁচজনের বেশি মানুষের একত্র হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। মংডু ও বুচিডংয়ে এখনো এই নিষেধাজ্ঞা বহাল এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এর যথেচ্ছ প্রয়োগ হয়ে থাকে। এতে ধর্মীয় স্বাধীনতাও সংকুচিত হয়। কারণ, মসজিদে সবাই মিলে জামাতে নামাজ পড়তে পারে না।

সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয় ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। যে সামান্য কয়েক হাজার রাখাইন বাস্তুচ্যুত হয়েছিল, তারা আবার বাড়িঘরে ফিরতে সক্ষম হয়েছে বা সরকার তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। সহিংসতার পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তুচ্যুত ১ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিম এখনো সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। ক্যাম্পে তাদের দিন কাটছে বন্দিদশায়। তাদের ইচ্ছামতো চলাচলের অধিকার নেই। তারা পর্যাপ্ত খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বাস্তুচ্যুতরা নিজেদের এলাকায়ও ফিরতে পারছে না। রাখাইনের মধ্যাঞ্চলের অন্য রোহিঙ্গারাও ভয়ংকর বাধা-নিষেধের মুখোমুখি হয়। চলাচলের ওপর বিদ্যমান বাধা-নিষেধও তাদের প্রাত্যহিক জীবন চরমভাবে বিঘ্নিত করছে।

২০১২ সালের এই সহিংসতা রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়নের পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। রাখাইনের বাইরে যাওয়া তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়ে। ২০১২ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা সিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। এটা শিক্ষার অধিকারের লঙ্ঘন এবং একটি প্রজন্মকে প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দেওয়ার শক্তিশালী হাতিয়ার। ২০১২ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারলেও ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে তাদের সে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। দমন-পীড়নের এই পরিবেশ পরের বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের আরও বেশি মাত্রায় নৌকাযোগে রাখাইন ছাড়তে বাধ্য করে।

Advertisement