জেলেনস্কি কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে?

Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA
যে ইউক্রেন বছরের পর পর বছর ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্যে প্রাণপনে চেষ্টা করছিল, যে ইউক্রেন ন্যাটোর সন্তুষ্টির জন্যে বসনিয়া হারজেগোভিনা, ইরাক ও আফগানিস্তানে ন্যাটোর আক্রমণকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে আসছিল,
সেই ইউক্রেন কেন ন্যাটোর সদস্য পদ পাওয়ার শেষ আশাটুকু ছেড়ে দিল? যুদ্ধ শুরু হওয়ার পনেরো দিন পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদমির জেলেনস্কি যেন একটি ঘোর থেকে বের হয়ে এসে রূঢ় বাস্তবতার স্বাদ পেতে লাগলেন !
কেউ কথা রাখেনি…
জেলেনস্কি প্রথম ভুল হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর আশ্বাসের উপর ভরসা করা। ২০০৮ সালে ন্যাটো নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তারা জর্জিয়া ও ইউক্রেনের ইউরো-আটলান্টিয় মনোভাবকে স্বাগত জানান এবং জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস‌ পদ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ১৪ বছর পরে ন্যাটো তাদের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করেছে। ইইউ-এর ফরেন পলিসি প্রধান এখন বলছেন, ন্যাটোর ঐ প্রতিজ্ঞা করাটাই ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কত সহজেই তারা বলে দিতে পারল যে ঐ সিদ্ধান্ত আসলে ঠিক ছিল না।
এই তথাকথিত ভুলের জন্যে পশ্চিমা দেশগুলোকে কি কোনো দন্ড দিতে হয়েছে? এদিকে ইউক্রেন হারিয়েছে ক্রাইমিয়া, ইউক্রেন হারিয়েছে ডনবাসের অনেকটা অংশ, আর আজ তারা যুদ্ধ কবলিত প্রায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি দেশ।
পশ্চিমা দেশগুলো কখনোই ইউক্রেনকে সত্যিকার অর্থে গুরুত্ব দেয়নি – তারা ইউক্রেনকে ব্যবহার করেছে রাশিয়াকে একটু পেরেশানিতে রাখার জন্যে।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, রাশিয়ার আগ্রাসনে ইউক্রেনকে কখনোই একা হয়ে যেতে হবে না। ইউক্রেন যুদ্ধের গোড়াতেই ন্যাটো অস্ত্র পাঠাতে শুরু করে আর ইউক্রেন ভেবেছিল পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এই তো অবারিত সাহায্য আসার কেবল শুরু, এরপর মাঠে সৈন্য পাঠাবে, আকাশে বিমান পাঠাবে, নো ফ্লাই জোন করা হবে।  কিন্তু জেলেনস্কি বুঝতে ভুল করেছেন। জেলেনস্কি ভেবেছিলেন অস্ত্র পাঠানো ন্যাটোর সাহায্যের প্রথম ধাপ, কিন্তু এটিই যে শেষ ধাপ বা সর্বোচ্চ সাহায্য তা জেলনস্কি বুঝতে পারেননি। পশ্চিমা দেশগুলোর সাহায্য পাবে সেই ভরসায় জেলেনস্কি দেশের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবে সে কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন।
নিষেধাজ্ঞার কথাই ধরা যাক। রাশিয়ার আক্রমণের পনেরো দিন পরেও ইউরোপ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। এতে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে এবং প্রকারান্তরে রাশিয়াকে যুদ্ধের জন্যে অর্থের জোগান দেওয়া হচ্ছে।
আশির দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুজাহেদীনদের অর্থ সাহায্য দিয়েছিল রাশিয়ার সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে। আফগানিস্তান কি কৌশলগতভাবে পশ্চিমাদের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ ছিল? না, আফগানিস্তানকে দিয়ে রাশিয়াকে একটু ভোগান্তির মধ্যে ফেলাই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আফগানিস্তান ছিল রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্যে একটি হাতিয়ার মাত্র! একই ঘটনা ঘটেছিল জর্জিয়ার ক্ষেত্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০০ সালে জর্জিয়াকে অস্ত্র দিয়েছিল, সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, জর্জিয়াকে ন্যাটোভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু যখন রাশিয়া জর্জিয়াকে আক্রমণ করল তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জর্জিয়াকে পরিত্যাগ করলো। চোখের সামনে এত বড় উদাহরণ থাকার পরও জেলেনস্কি  কেন শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলেন?
 জেলেনস্কি হয়তো ভেবেছিলেন অন্যান্য দেশের সাথে ইউক্রেনের তুলনা হয় না, কারণ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে হয়তো ন্যাটোর কাছে ইউক্রেনের একটি বিশেষ গুরুত্ব থাকবে এবং ইউক্রেন হচ্ছে পশ্চিমাদের জন্যে একটি কৌশলগত সম্পদ। সে কারণেই তাঁর ধারণা হয়েছিল যে জর্জিয়া বা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে যা হয়েছে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তা হবে না। তাই তাঁকে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে শুনেছি যে ইউক্রেন হচ্ছে ইউরোপের বর্ম এবং ইউক্রেনই প্রায় এক দশক ধরে রাশিয়ার মত সমর শক্তিতে শক্তিমান একটি দেশের পাশে থেকে বাকী ইউরোপকে রক্ষা করে আসছে। সে কারণেই আর যাই হোক ইউক্রেনের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় ন্যাটো তার কথা রাখবে। কিন্তু  পশ্চিমাদের কাছে  ইউক্রেনও যে হবে আরেকটি হাতিয়ার, ইউক্রেনও যে হবে দাবার গুটির সামনের সারির  ছোট আকারের সৈন্য (pawn) যা দিয়ে সামনে হাতি ঘোড়া যা-ই পড়ে যায় কোণাকুণি খেয়ে ফেলা যায় — সেটি জেলেনস্কি ধারণা করতে পারেননি। আসলে ইউক্রেন কখনোই পশ্চিমা দেশগুলোর জন্যে একটি রাজনৈতিক experiment এর বেশী কিছুই ছিল না।
ইউক্রেনের দ্বার প্রান্তে রাশিয়ার ট্যাঙ্ক ও সেনা মোতায়েন দেখেও জেলেনস্কি বলেছিলেন, মিডিয়া যেভাবে যুদ্ধের কথা বলছে তেমনটি তিনি মনে করেন না । তিনি হয়তো মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন যুদ্ধ বেঁধে গেলেও বিশ্বের সব চাইতে শক্তিধর দেশ যার সঙ্গে রয়েছে তার বীরত্বের সাথে যুদ্ধ না করার কি কারণ থাকতে পারে!
এত যে জেলেনস্কির বীরত্বের প্রশংসা আমরা শুনছি পশ্চিমা মিডিয়াতে, এত যে বিশ্বের নেতাদের দাঁড়িয়ে জেলেনস্কি সন্মান দেওয়া আমরা দেখছি – ইতিহাস কি তার কিছুই মনে রাখবে? ইতিহাস শুধু মনে রাখবে ইউক্রেন রাশিয়ার প্রথম যে দাবী ছিল, ন্যাটোতে যোগ না দেওয়া সেটি মেনে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে রাশিয়া এখন বাড়তি যা আদায় করে নেবে তা হচ্ছে ডনবাস ও ক্রাইমিয়কে ইউক্রেনের স্বীকৃতি — মাঝখান থেকে প্রাণ হারাতে হল নারী ও শিশু সহ হাজার হাজার নিরপরাধ ইউক্রেনীয়কে, উদ্বাস্তু হতে হল লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয়কে।।
লেখক: Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক ও বিশ্লেষক এবং কলামিস্ট।
Advertisement