ভোট অফ নো কনফিডেন্স, নির্বাচনের হুমকি ও বৃটিশ গণতন্ত্র

        Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA
এই প্রথম শুনলাম বৃটেনের ক্ষমতাসীন সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য (জ্যাকব রিস-মগ) দাবী করছেন যে যদি তাদের পার্টি নতুন নেতা নির্বাচিত করে তাহলে সাধারণ নির্বাচন হতে হবে। গত কয়েক দশক পেছনে তাকালে দেখতে পাই প্রধানমন্ত্রীর উত্তরসূরী হিসেবে বেশ কয়েকজন পার্টি নেতা নির্বাচন না পেরিয়েই ১০ নম্বর ডাউনিং ষ্ট্রীটের চাবি পেয়েছিলেন। সময়ে সময়ে তাঁরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন – বিরোধী দলের এমন মন্তব্যের মুখে পড়লেও তাঁরা দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে গিয়েছেন নির্বিঘ্নে। পরে অবশ্য তাঁরা এক পর্যায়ে সাধারণ নির্বাচন ডেকেছিলেন। মার্গারেট থেচারের পর জন মেজর, টনি ব্লেয়ারের পর গর্ডন ব্রাউন, ডেভিড ক্যামেরোনের পরে টেরিসা মে -এঁরা প্রত্যেকেই দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর সাধারণ নির্বাচন ডেকেছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন একমাত্র গর্ডন ব্রাউন ছাড়া। বিশ্বযুদ্ধের পর গর্ডন ব্রাউন হচ্ছেন ষষ্ঠ জনগণের রায় বিহীন প্রধানমন্ত্রী।
রিস-মগের নির্বাচনের এই হুমকির অর্থ হচ্ছে রেড ওয়াল এমপি এবং অল্প ভোটে জেতা ব্যাক বেন্চার বিদ্রোহী এমপিদের একটা বার্তা দেওয়া যে, যদি তারা ভোট অফ নো কনফিডেন্স থেকে বিরত না থাকে তাহলে তাদের শিগগিরই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এবং তাদের নিশ্চিতভাবে আসন হারাতে হবে। বর্তমান জনমত জরীপের দিকে তাকালে বলা যায় যে এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে শুধু বিদ্রোহী টোরী এমপিরাই যে আসন হারাবে তা নয়, গোটা বৃটেনেই টোরী এমপিদের ভরাডুবি হবে আর ১০ নম্বরের চাবি চলে যাবে স্যার কিয়ার ষ্টার্মারের হাতে। এ কথা শুনে বৃটেনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের ব্রেক্সিটিয়ারদের মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা। কারণ তাঁরা মনে করে বরিস জনসন ছাড়া টোরী দলের আর কারো দ্বারা ব্রেক্সিট সম্পন্ন করা সম্ভব না এবং বরিস জনসনই পারে সাধারণ নির্বাচনে টোরীর জন্যে বিজয় আনতে। শোনা যায় অনেক ব্র্যাক্সিটিয়ার চান লকডাউনে পার্টি করার জন্যে বরিস জনসনকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করার পরে যেন বরিসই থেকে যান ব্র্যাক্সিটের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে। তাদের শঙ্কা বরিস নেই তো ব্র্যাক্সিটও নেই। কাজেই বিদ্রোহী এমপিদের এলাকার ব্র্যাক্সিটিয়ারদের থেকে তাদের এমপিদের উপর চাপ আসতেই পারে ভোট অফ নো কনফিডেন্সের মাধ্যমে বরিস জনসনকে উৎখাত না করার ব্যাপারে।
কিন্তু কথা হচ্ছে নির্বাচন চাইলেই তো এক্ষুণি নির্বাচন দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা কিন্তু এখনো ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্টের অধীনেই আছি। এই ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট ২০১১ সালে করেছিল টৌরী এবং লিবডেম কোয়ালিশন সরকার লিবডেমকে সরকারে রাখার জন্যে। তবু কেন রিস-মগ এ মুহূর্তে নির্বাচনের কথা তুলতে পারছেন? তার কারণ নতুন একটি বিল পার্লামেন্টে রয়েছে যেটি আইন হওয়ার খুব কাছাকাছি পর্যায়ে‌ রয়েছে, তা হচ্ছে ডিসোলিউশন‌ এন্ড কলিং অফ পার্লামেন্ট এক্ট। বরিস সরকার ক্ষমতায় আসায় পর থেকেই ধাপে ধাপে ক্ষমতাসীনদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছিল। শুরু হল মেয়রাল ইলেকশন দিয়ে, এছাড়া ২০১৯ সালে নির্বাচনের প্রয়োজন পড়লে এই ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্টের অধীনে নির্বাচন দেওয়া জটিল হয়ে পড়েছিল – এই অজুহাতে ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট আইন বাতিলের চেষ্টা চলতে লাগল। এমপিদের দ্বার পার হয়ে এখন এই বিলটি হাউস অফ লর্ডসে আছে। তারপর রাণীর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেলেই তা পরিণত হবে আইনে। এই ফাঁকে বরিস যদি কোনোভাবে ভোট অফ নো কনফিডেন্স সামাল দিয়ে ফেলতে পারে তাহলে বরিসের জন্যে সরাসরি জনগণের কাছে গিয়ে ভোট চাইতে আর কোনো বাধা থাকবেনা।
ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট উঠিয়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে তাঁর দলের সুবিধে মত যে কোনো সময়ে নির্বাচন ডাকার একচ্ছত্র ক্ষমতা তুলে দেওয়া যেখানে নির্বাচনী মাঠটি সব দলের জন্যে একই সমতলে থাকে না – এটি বৃটেনের গণতন্ত্রকে এক ধাপ নীচে নামিয়ে দেয়। এ ধরনের নিয়ম পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই নেই, জাপান, ইসরেইল ও ডেনমার্কের মত কয়েকটি দেশ ছাড়া। তবে সব সময়ে যে সুবিধেজনক সময়ে নির্বাচন করলেই ক্ষমতাসীন দলের বিজয় হয় এমন নয়। ১৯৭০ সালে হ্যারল্ড উইলসনের ডাকা নির্বাচন তার ব্যতিক্রম। তবে সঠিকভাবে হিসেব করে সুবিধেজনক সময়ে নির্বাচন ডাকতে পারার ক্ষমতা ক্ষমতাসীন সরকারকে দেওয়া পক্ষপাতদুষ্ট একটি প্রক্রিয়া।
সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্যে প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে জনগণের রায়‌ নেওয়া এবং তার মাঝে কাজ করতে পারার জন্যে সরকারকে মোটামুটিভাবে যথেষ্ট সময় দেওয়া — এই দু’টি বিষয়ের মধ্য একটি সঠিক ব্যালেন্স আনা। ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্টের কিছু সংশোধন যেমন পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর করলেই হতো, এর জন্যে আইনটি পুরোপুরি তুলে দেওয়ার চেষ্টার অর্থ বৃটেনে গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
………………………………………………..
লেখক একজন চিকিৎসক, সংবাদ পাঠক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
Advertisement