স্বপ্নের বাস্তবায়ন পদ্মা সেতু

।। হিমিকা আযাদ ।।

পদ্মা সেতু কনক্রীটে মোরানো কোনো স্থাপনা নয় এটি নিজেই একটি ইতিহাস। আর কিছুক্ষণ পর উন্মোচন হতে যাচ্ছে স্বপ্ন জয়ের ফলক । অজস্র বিতর্কে জোড়ানো এই সেতু কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে বাংলাদেশের মেরুদন্ড হয়ে । যা বিশ্ব দরবারে বাঙালী জাতির জাতীয় স্বত্তা কে আরো একধাপ এগিয়ে দিল ।শত মানুষের কষ্টের অবসানের অবতারনা হতে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণ বাদে ।এটি কোনো সাধারণ সেতু নয় এতে জড়িত সেই সব মানুষেগুলোর কষ্টের সমাপ্তি হওয়ার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । এই সেতুর ৪১ টি স্প্যানে গাঁথা আছে অজস্র গল্প -অপমান -বিজয়ের আনন্দ । এই সেতু সেই আবেগের নাম যারা আ্যম্বুলেন্সে আটকে পড়ে মা হারিয়েছেন। এই সেতু হচ্ছে সেই সব যন্ত্রনার দুঃখগাঁথা যারা কুয়াশার কারণে ফেরী আটকে ফ্লাইট মিস করে সর্বহারা হয়েছেন।যদি আরো বলি পদ্মা সেতু সেই মায়ের কাছে আশার আলো যে ট্রলার ডুবিতে হারিয়েছেন তার সন্তান । দুপারের সংযোগ বল্লে যথেষ্ট নয় । দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে এক করার জলজলে বাস্তবতা ।


পদ্মা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর একটি। এই নদীর যে জায়গায় সেতুটি নির্মিত হয়েছে সেখানে নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ছয় দশমিক পনের কিলোমিটার। আর এটি দক্ষিণ এশিয়ার কোন নদীর ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু।পদ্মা সেতু শুধু মাত্র সড়ক সেতু নয়। একই সঙ্গে এই সেতুর ওপর দিয়ে যাবে ট্রেন। এছাড়াও আছে গ্যাস পাইপ লাইন এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। দুই তলা ব্রীজের ওপর দিয়ে যাবে গাড়ী, আর সেতুর নীচের লেভেলে থাকছে ট্রেন লাইন। একদিকে গঙ্গা, আরেকদিকে ব্রহ্মপুত্র- দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদীর অববাহিকার পানি এই পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে নামছে। উজান থেকে নেমে আসা এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে হবে সেতুটিকে । সেই সঙ্গে নদীর দুই তীরে নদীশাসনে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়েছে । নদী শাসনের জন্য তৈরি করা হয়েছে কংক্রীটের ব্লক। পদ্মা সেতুর ভিত্তির জন্য পাইলিং এর কাজ করতে হয়েছে নদীর অনেক গভীরে। বিশ্বে কোন নদীর এতটা গভীরে গিয়ে সেতুর জন্য পাইলিং এর নজির খুব কম আছে প্রকৌশলীদের জন্য এটাও এক বড় চ্যালেন্জ ছিল ।এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প।বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এটি করেছে অত্যন্ত নিষ্ঠা আর সাহসিকতার সাথে । বিদেশি সাহায্য ছাড়া নিজের খরচে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নজির বাংলাদেশে আর নেই।এর নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা যার তিনগুণ অর্থাৎ ৯৩ হাজার কোটি টাকা মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপিতে যোগ করবে পদ্মা সেতু। এমনটি আমরা জানতে পেরেছি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) থেকে ।
সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের বিষয়। এটি শুধু সেতুই নয়। পদ্মা সেতু হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই সেতুর ফলে আমাদের জিডিপিতে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে।’
গত ৫০ বছরের উৎসবের রেকর্ড ভাঙবে পদ্মা সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, কূটনৈতিকদের মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টসহ আরো আছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিদেশি কূটনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকসহ আরো অনেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিদেশিদের জন্য ৭৫টির মতো কার্ড বরাদ্দ করা হয় ।রাজনৈতিক দলগুলোর আমন্ত্রণপত্র তাদের দলীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কে দোরাইস্বামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘কঠিন’ কিন্তু ‘সাহসী’ সিদ্ধান্তের ফলে দীর্ঘতম সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে বলেছেন, পদ্মা সেতু একই সাথে ঐতিহ্যবাহী বাংলার সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই বাঙালি সংস্কৃতির বিষয়ে এ কথা জানি ‘এইপাড় ও ওই পাড়’ (নদীর দুই পাড়), তাই পদ্মা বাংলা ভূমির দুটি ‘পাড়’ (দুই পাড়) থাকার অর্থই প্রকাশ করে। দোরাইস্বামী বলেন, একটি বড় প্রকল্প হওয়া সত্ত্বেও, পদ্মা সেতু শুধুমাত্র ইট ও স্টিলের নিরিখে একটি বিশাল কাঠামো নয় বরং এটি হচ্ছে প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপারের মানুষের সংস্কৃতি ও আবেগের প্রতীকী সংযোগকারী।
তিনি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভারতীয় হাইকমিশনে সাংবাদিকদের বলেন,‘সেতুটি ব্যবসার চেয়েও অনেক কিছুর সংযোগকারী; এটি মানুষের সংযোগকারী, এটি আবেগের সংযোগকারী এবং এটি বাংলার সংস্কৃতির সংযোগকারী।
স্বপ্নের বহুমুখী পদ্মা সেতুর উদ্বোধন সামনে রেখে ঢাকার বিদেশী কূটনীতিকরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও আস্থার প্রতীক এবং সত্যিকারের গেম চেঞ্জার হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা। সেই সঙ্গে সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানিয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত জাপান, ভারত, চীন সৌদি আরব ও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত পদ্মা সেতুর বিষয়ে গণমাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন।ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক। এটির ফলে বাংলাদেশে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরও বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। জাপানের রাষ্ট্রদূত আরও বলেছেন, এই সেতু শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারত উপমহাদেশে আঞ্চলিক যোগাযোগে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেছেন, পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করে জাইকা তবে শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পে জাইকা অংশীদার হতে পারেনি। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। তবে বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে, এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়।ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান – বিবিআইএন কানেক্টিভিটিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিতে এই সেতু যে ভূমিকা রাখবে, এতে ভারত খুশি। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ভারতীয় হাইকমিশনার আরও বলেছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এই আনন্দময় মুহূর্তে আমি বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের প্রতিটি বন্ধুকে আমি স্বাগত জানাই।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, পদ্মা সেতু সাহসের প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তের জন্যই এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ সিদ্ধান্তে প্রয়োজন ছিল সীমাহীন সাহস ও সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে সেটা ছিল বলেই এই সেতু এখন বাস্তব। পদ্মা সেতু নিয়ে আমি যখন ভাবি, তখন শুধুমাত্র তিনটি শব্দ আমার মনে আসে, সেটা হলো- সাহস, সঙ্কল্প ও সমৃদ্ধি। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনা কোম্পানি জড়িত রয়েছে। সেজন্য আমি গর্ববোধ করি। রাষ্ট্রদূত বলেন, পদ্মা সেতু শুধু দুপারের ভূখন্ডকেই যুক্ত করবে না, এটা মানুষের হৃদয়কেও যুক্ত করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছে রাশিয়া। ঢাকার রুশ দূতাবাস এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, এই উচ্চাভিলাষী মেগা-প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে, যেটা প্রশংসনীয়। পদ্মা সেতু একটি সত্যিকারের গেম চেঞ্জার। কারণ, এটি আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযোগ, কর্মসংস্থান, পর্যটন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ প্রসারিত করবে। নিঃসন্দেহে এটি জাতীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে অবদান রাখবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির কারণে একটি যুগান্তকারী অর্জন।
ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান বলেছেন, বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে এই পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ধরনের মেগা প্রকল্প বাংলাদেশে তৈরি হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। এই সেতুর ফলে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা আরও আকৃষ্ট হবেন বলে আশা করেছেন তিনি।উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে সকাল ১০টায় সুধীসমাবেশে অংশ নেবেন। এরপর তিনি টোল দেবেন এবং সেতুর ফলক উন্মোচন করবেন। পরে তিনি গাড়িতে সেতু পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে পুনরায় ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর বিকেলে তিনি মাদারীপুরের শিবচরে জনসভায় বক্তব্য রাখবেন।শিবচরের জনসভায় ১০ লাখ লোকের জমায়েত করার পরিকল্পনা নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বরিশাল, বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল, বাগেরহাট থেকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে আসতে প্রস্তুতি সভা সম্পন্ন করেছেন ।দলটির নেতারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকেও লোকসমাগম ঘটাতে চান। তবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন ঢাকা-মাওয়া রুটে বাসসহ অন্যান্য যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত আছে সরকারের। সেতু দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হবে না।পদ্মা সেতু নিয়ে শুরু থেকে অনেকে অনেক কথা বলেছেন যার কারণে মানুষ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল আজ সেসবের সমাপ্তি হতে চলেছে । শুরু হচ্ছে স্বপ্ন যাত্রার।

হিমিকা আযাদ : যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট।

Advertisement