আম বিতর্ক: বিষ কি শুধু আমে?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: সপ্তাহান্তে আবার আম ধ্বংসের উৎসব আরম্ভ হয়েছে। এবার মঞ্চ সাজানো হয় ঢাকার বাইরে। শিল্পী সুলতানের শহর, ক্রিকেট প্রতিভা মাশরাফির শহর নড়াইলে। সুলতানের তুলির জোর, মাশরাফির বলের জোরের পাশে এবার নড়াইলবাসী দেখল আইনের জোর। মৌসুমের শুরুতে অপরিপক্ব ফল পাকানোর অভিযোগে ঢাকার মিরপুরে ১ হাজার ১০০ মণ এবং কারওয়ান বাজারে প্রায় ৪০০ মণ আম ধ্বংস করা হয়েছিল। পরে আরও কয়েকটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত একই অপরাধে শত শত মণ আম ধ্বংস করেন। আমসম্পদও এবং এর সঙ্গে বাংলাদেশের আমপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের ভবিষ্যতের গুরুতর সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি তাই হুজুগে মীমাংসা করার মতো নয়।

গত ২২ জুন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটি ইউনিয়নের আফরা গ্রামে তথাকথিত কেমিক্যাল মিশ্রিত ৩০ মণ আম খুঁজে পান ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপর সেগুলো ট্রাকের চাকার নিচে ফেলে নষ্ট করা হয়। দুই আম ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আমের সঙ্গে জব্দ এক বোতল কেমিক্যালও উপস্থিত জনগণের সামনে ধ্বংস করা হয়েছে বলে খবরে জানা যায়।

কী এই কেমিক্যাল? ব্যবসায়ীরা তার কতটুকু, কীভাবে কথিত আমে প্রয়োগ করেছিলেন আর ভ্রাম্যমাণ আদালত সেটা কীভাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। হতে পারে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে, গোপনে পরীক্ষা করে আইন প্রয়োগে নিয়োজিত ব্যক্তিরা নিশ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু কেমিক্যালের বোতলটি তো দণ্ডিত ব্যক্তিদের পাপের আলামত ছিল, সেটা কেন ধ্বংস করতে হলো?
এ ধরনের অভিযানে নিরাপদ খাদ্য আইনের (২০১৩) ২৩ ধারাকে ব্যবহার করা হয়। এতে উল্লেখ আছে, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য (যেমন: ক্যালসিয়াম কারবাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট), কীটনাশক (ডিডিটি, পিসিবি তেল) বা অন্য কোনো বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য মজুত, বিপণন বা বিক্রি করা যাবে না। অভিযুক্ত ব্যবসায়ীরা কোন বোতলের কী বিষ ব্যবহার করছেন, তার মাত্রাটাই–বা কী—এসব না জানালে পাবলিকের পেরেশানি বাড়বে, তারা সংশয় আর আতঙ্কের চোরাবালিতে ডুবতে থাকবে।

মানুষ এখন আম বিষ বিতর্কের যুদ্ধে নিতান্তই নলখাগড়ায় পরিণত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নিরলসভাবে বলে চলেছে আমে বিষ নেই, পাকানোর জন্য নির্ধারিত রাসায়নিক মাত্রামতো ব্যবহার করায় কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। অন্যদিকে, পরিবেশ ও ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার দাবি, ইথোফেন নিয়ে ফল পাকানোর পর তা খেলে শরীরে নানা জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের মধ্যেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বাজার থেকে আমের নমুনা সংগ্রহ করে ভারতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত (অ্যাক্রেডিটেড) একটি ল্যাবে পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় আমে ক্ষতিকর মাত্রায় কোনো রাসায়নিক উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন আড়ত থেকে আমের নমুনা সংগ্রহ করে ওই পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। দুই ভাগে এগুলোর পরীক্ষা করা হয়। গত ১ জুন এই পরীক্ষার ফলাফল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কাছে পাঠানো হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নিজেদের পরীক্ষাগারে সম্প্রতি বিভিন্ন ফলের নমুনায় পরীক্ষা করে ক্ষতিকর মাত্রায় ফরমালিন বা অন্য কোনো রাসায়নিকের সন্ধান পায়নি। বাস্তবে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজ, লেবু, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা, জামরুল, বেল, কতবেল, ডেউয়া ইত্যাদি মৌসুমি ফলের মধ্যে ফরমালিন মেশানো যায় না। তবে আমের মধ্যে খুব অল্প পরিমাণে মেশানো সম্ভব। আর তা যদি খাওয়ার আগে পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া যায়, তাহলে কোনো ভয় থাকে না।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে ২৭টি ফলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি নমুনা আমের, ৬টি লিচুর এবং কলা, খেজুর, আঙুর, আপেল ও মাল্টার একটি করে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব নমুনায় ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে তা ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি অথোরিটির (ইএফএসএ) নির্ধারিত সহনশীল মাত্রার চেয়ে কম। ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি অথোরিটি আমের ক্ষেত্রে ৬ থেকে ৩৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিগ্রাম) সহনশীল বলে মনে করে। ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে ১৬টি আমের নমুনায় শূন্য দশমিক ৬৫ থেকে ৯ দশমিক ৪৬ পিপিএম পর্যন্ত ফরমালডিহাইড পাওয়া গেছে। এরপরও বিতর্ক বন্ধ হয়নি। কেন বন্ধ হয়নি?

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমের বাজার আটকে দেওয়ার কোনো ভুল চেষ্টা এসব বিতর্কের কলকাঠি নাড়ছে না তো? বালাই ষাট, এসব ভাবাও পাপ! ভারতের আম পৃথিবীর বাজার হারাচ্ছে। কেরালা ও কর্ণাটকে নিপা ভাইরাসের আক্রমণ সেটাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। দেশের মধ্যেও মৌসুমি ফলের বাজার ছোট হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আমের বাজারকে বিষ–আতঙ্কে কোণঠাসা করতে পারলে কাদের লাভ?

গত বছর রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আম দিয়ে বাংলাদেশের আম ইউরোপের ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, পর্তুগাল, ফ্রান্স, রাশিয়াতে পাঠানো কথা প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। হটেক্স ফাউন্ডেশন ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ আয়োজনে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মাধ্যমে এই আম রপ্তানির প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল। সে সময় ৫০ জন বাগানমালিককে কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করে সনদপত্র দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ২০১৬ সালে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লিড ফার্মারদের বাগানে উৎপাদিত ও ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত প্রতিটি ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের আম ঢাকা বিএসটিআই ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এসব আয়োজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে—এমন যেকোনো পদক্ষেপ আমচাষি তথা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী।

আম নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। সবকিছুতেই সন্দেহের গন্ধ খোঁজা কোনো কাজের কথা নয়। তার আগে ওপরে তোলা প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে যে কেন শুধু আমের মধ্যে বিষ খোঁজা হচ্ছে? বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলমূলের মধ্যে বিষ আছে কি না, তা কে কখন পরীক্ষা করছে? বাংলাদেশের বাজারে সয়লাব বিদেশি ফলের মধ্যে আপেল অন্যতম। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রায়ই বলে থাকেন, ভারতের আপেলে খারাপ কিছু নেই, সামান্য মোম পলিশ থাকতে পারে। সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু নয়। কিন্তু ওটা আসলে মোম নয়, বিষাক্ত প্যারাফিন। সম্প্রতি কলকাতার ফলের বাজারে সাধারণ ক্রেতারা সেই জারিজুরি ধরে ফেলেছেন। পুলিশ ডেকে ফল বিক্রেতাদের পুলিশের গাড়িতে তুলে দিয়েছেন। পরীক্ষাগারে ক্রেতাদের সন্দেহ প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আমরা এসব আপেলকে ছাড়পত্র দিচ্ছি আর দেশি আমের ঝুড়িকে পিষে দিচ্ছি ভারী চাকার নিচে?

Advertisement