।। জামিলুর রহমান চৌধুরী ।।
বাবার চাকরীর সুবাদে একটা চা বাগানে জীবনের প্রায় অনেকগুলো বছর কাটাতে হয়েছে এবং যা ছিল আমার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য এবং আসাধারন সময়। সারি সারি বাসভবন এবং ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষের একত্র বাস । কেউ কারো অত্মীয় না হলেও এ যেন ছিল এক বিশাল পরিবার । হিন্দু-মুসলমান কোন ভেদাভেদ ছিলা না একেবারেই ।
তবে চা বাগানের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। চা শ্রমিক হিসাবে যারা যারা কাজ করতেন তাদের প্রায় ৯৯.৯৯ ভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং সম্ভবত এখনো তাই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে কিছু মুসলমান ছিলেন । তবে কে হিন্দু, কে মুসলমান এ জাতীয় বিভাজনের কোন স্মৃতি একবারেই মনে পড়ছে না ।
আমাদের যেখানে বাসা ছিল এর ঠিক সামনেই ছিল হিন্দু ধর্মীয় পূজার মন্দির, যার সাথে বিশাল নাচ ঘর/যাত্রাঘর যেখানে দূর্গাপুজা বা কালিপূজার সময় বিনোদনমুলক যাত্রাপালার আয়োজন হতো। এতে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও বিভিন্নসামাজিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হয়ে থাকতো, যা নিশ্চিতই চলমান আছে ।
পূজা-পার্বনের সময় বিশেষ করে যাত্রাগানের আয়োজন থাকলে আমাদের বাসায় মেহমানের আনাগোনা বেড়ে যেতো কারন সবাই যাত্রাগান দেখতে আসতেন । অনেক আনন্দ হতো তাতে কোন সন্দেহ নাই । তাছাড়া হিন্দু ধর্মীয় বিধান মতে উৎসব/মহাণামযজ্ঞও বছরে একবার আয়োজিত হতো, যা সারা রাতব্যাপী এবং বেশ কয়েকদিন ধরে চলতো ।
বাসার সামনেই অর্থাৎ মাত্র ২০-৩০ হাত দুরত্বে অনুষ্টানস্থল হওয়াতে এবং বেশ কিছূ মাইক বিভিন্নমুখী করে স্থাপিত থাকতো বিধায় কোন না কোন মাইক একেবাবে মনে হতো আমাদের বাসার দিকেই তাক করে স্থাপন করা থাকতো । এতে করে মোঠামুঠি অনুষ্টান চলাকালীন দিনগুলোতে আমাদের বাসার সকলের রাতের ঘুম প্রায় হারাম হয়ে যেতো। মাঝে মাঝে অয়োজকদের অনুরোধ করলে তারা হয়তো আমাদের বাসামুখী মাইকের দিকটা অনেক সময় অন্যমূখী করার চেষ্টা করতেন কিন্তু কতোই আর অনুরোধ করা যেতো । তাছাড়া আমাদের অনুরোধ রক্ষা করলে হয়তো যারা ঘরে বসে যজ্ঞ/উৎসব উপভোগ করতেন তাদের আবার সমস্যা হতো মানে তারা অনুষ্টানের আলোচনা বা অন্যসব কার্যাদি ঠিকমতো উপভোগ করতে পারতেন না । তবে বিষয়টা আামাদের গা সওয়া হয়ে যাওয়াতে অনেক সময়ই আর অনুরোধ করা হতো না, বরং কোন না কোনভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হতো । তবে এ নিয়ে কোনদিন কারো সাথে কোনসমস্যা, বাদানুবাদ বা মনোমালিন্য হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না ।
আমাদের তিনটা মুসলিম পরিবারের বাসা ছিল একেবারে মন্দির-নাচঘরের ঠিক কাছে এবং সকলেরই একই সমস্যা হতো এবং তিন বাসার মানুষের ভিতরেই কিছুটা অসন্তোষ থাকলেও কেউ কাউকে এ নিয়ে কোন বিরক্তিসূচক কথা কখনো বলেছেন বা কোথাও নালিশ করেছেন এমন কোন উদারহরন একেবারেই মনে করতে পারছি না এবং তা করলে বরং বিষয়টি ইডিয়টিকই মনে হতো । কারন যে কোন ধরনের বাস্তবতা অনুধাবনের ক্ষমতা সম্ভবত এবং কেবলমাত্র মানুষকেই সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন বলে আমার মনে হয় আর সেটা ধর্মী্য় কোন বিষয় হলে তো আর কোন কথাই নেই ।
উপরোক্ত বর্ননা মুলত একই সাথে থাকা আমাদের দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে সহমর্মিতার বিষয়টি কত প্রকট ছিল তা বুঝানোর উদ্দেশ্যেই লিখা হয়েছে এবং পুরো বিষয়টি মুলত ইদানীং কতিপয় সনাতনী স্বজন/বন্ধুর কিছু দু:খজনক আচরনের প্রেক্ষিতেই লিখতে উৎসাহিত হয়েছি ।
অতি সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকা মারফত জানা গেলো যে কানাডা সরকার অন্টারিও’র কয়েকটি শহরে উচ্চস্বরে আযান প্রচারের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় কিছু হিন্দু বন্ধু অত্যন্ত ক্ষুব্ধভাব প্রকাশ করেছেন , যাতে খুব খটকা লেগেছে। কেন যেন মনে হয়েছে কেন এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের কিছু বিধানে খুশী না হয়ে এতো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান । তারা কেন পারলেন না নিজের ফেসবুকে একটা অসাধারন স্ট্যাটাস লিখে কানাডা সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে? না, তারা তা পারেননি বরং একজন লিখেছেন, “এসব আবার এদেশে কি শূরু হলো । ভীষণ চিন্তার বিষয় !” আরেকজন লিখেছেন, “মমতা দি’র মতো ভোটের রাজনীতি নয় তো?”
এক অনলাইন নিউজ পোর্টাল মারফত জেনেছি যে একজন আইনজীবি নাকি আরো দুকদম বাড়িয়ে আরো ভারী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন । তিনি লিখেছেন, ”এরপর কি? উট ও ছাগলচালকদের জন্য আলাদা রাস্তা, কোরবানীর নামে বাড়ীতে পশু হত্যার অনুমতি, সমস্ত মহিলাদের খুশী করার জন্য ভোটের ব্যবস্থা তাঁবুতে, সেখানে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রেখে তারা আসবে, এইসবেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? ফলস্বরূপ, সরকার এই ভদ্রলোককে অনেক শাস্তির আওতায় আসতে হয়েছে, যেমন তাকে একটা স্কুল কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি তিনি কোনদিন কোন মিটিংএ উপস্থিত থাকতে পারবেন না । তাছাড়া একটা রিয়েল এস্টেটের চাকুরীও তিনি হারিয়েছেন । টুইটারে নিজেকে একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবি দাবী করে লিখেছেন যে তার আইনজীবি লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে । এখন যদি তিনি তার গাড়ী বাড়ীর মর্টগেজ দিতে না পারেন তাহলে শীঘ্রই নাকি হোমলেস হিসাবে বিবেচিত হবেন এবং ভবিষ্যতে কোথাও কোন চাকরী পাওয়াও তার জন্য হবে দুষ্কর । তার বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার জন্য নি:সন্দেহে আমরা ভীষণভাবে অনুতপ্ত কিন্তু তিনি যে ভাষায় একটা ধর্মের মানুষকে টার্গেট করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এরজন্য তিনি অনুতপ্ত হবেন কি ?
অতি সম্প্রতি কানাডায় বসববাসকারী এক বিশিষ্ট সাংবাদিকের (জনাব সওগাত আলী সাগর) আলোচনার মাধ্যমে জানা গেছে যে আযানের বিরুদ্ধে নাকি একটি সম্প্রদায়ের মানুষ এমনকি সিটি কার্যালয়ে অভিযোগ নিয়ে গেছেন । অভিযোগের চিঠিতে যা লিখেছেন তাও তো রীতিমতো ভয়ংকর বলে জানা গেছে । এমনকি তারা আযানের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে লিখতেও দ্বিধা করেননি । এমন কেন হবে বলতে পারেন?
আচ্ছা, আযানটিতে আসলে কতো সময় ব্যয় হয় এবং ৫বার আযানে বড়জোর কত সময় লাগতে পারে তা কি আযানের বিরোধীতাকারীরা কখনো হিসাব করে দেখেছেন । আযানে কেমন শব্দ দুষণ হয়? আমার উপরোল্লিখিত অভিজ্ঞতার চাইতেও বেশী কি?
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এমনকি কর্মজীবনেও যেক’জন বন্ধু বা সহকর্মী পেয়েছি তাদের মাঝে কখনো কি এমন কাউকে পেয়েছি যে বা যিনি একজন মুসলমান হিসাবে আমাকে বা আমার ধর্মকে নিয়ে অসম্মানজনক কোন কথা বলেছেন । না , একেবারেই মনে পড়ছে না বরং একে অন্যের ধর্মীয় দিনগুলোতে তো মহা আনন্দে কাটিয়েছি বলেই মনে পড়ছে, যা এখনো চলছে এবং অনাগত দিনেও চলবেই আশা করি ।
মনে-প্রানে এ ও আশা করবো অনাগত দিনে প্রতিটি ধর্মের মানুষই অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন । কারন ধর্মের পরিচয়ের আগে তো আমাদের পরিচয় আমরা মানুষ। আর মানুষের জন্যই তো ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয় ।
আসুন, সবাই অনুধাবন করার চেষ্টা করি !
জামিলুর রহমান চৌধুরী। কিগালী, রুয়ান্ডা।