আহাদ চৌধুরী বাবু : কনজারভেটিভ এবং লিবডেম কোয়ালিশন ২০১০ সালে ক্ষমতায় এসে বাজেট কাটের লক্ষ্যে হাত দেয় দেশের ওয়েলফেয়ার বা বেনিফিট সিস্টেমেও। ওয়েলফেয়ার বাজেট সংঞ্চয় এবং বেনিফিট নির্ভর মানুষকে আরো বেশি কর্মমূখী করতে সরকার ‘বেনিফিট ক্যাপ’ এবং ইউনির্ভার্সেল ক্রেডিট সিস্টেম নিয়ে আসে। ক্যাপ হলো, দুই বেডরুম বা ততোধিক বেডরুমের বাসিন্দাদের জন্যে বেডরুম হিসাব করে বেনিফিটের অর্থ নির্ধারণ করে দেওয়া। আর ইউনিভার্সেল ক্রেডিট হল ছয়টি বেনিফিটকে এক জায়গায় নিয়ে এসে এক সাথে পরিশোধ করা।
২০১৩ সাল থেকে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে চালু হওয়া ইউনিভার্সেল ক্রেডিট চলতি মাস থেকে ব্যাপকতা পাচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে মাসে অন্তত ৫০টি জব সেন্টারে ইউনিভার্সেল ক্রেডিট চালু করতে চায় সরকার। অন্যদিকে তা বাতিলের দাবীতে পার্লামেন্টে হচ্ছে বিতর্ক। বিরোধীদের দাবীতে ইউনিভার্সেল ক্রেডিট হেল্পলাইনের কলচার্জ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। অনলাইনে আবেদনের পর ইউানিভার্সেল ক্রেডিট পেতে অন্তত ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। আর তাতে বেনিফিট নির্ভর আবেদনকারীদের মারাত্মকভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ইউনিভার্সেল ক্রেডিটের ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে বাঙালী কমিউনিটিতেও।
চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট, ওয়ার্কিং ট্যাক্স ক্রেডিট, হাউসিং বেনিফিট, ইনকাম সাপোর্ট, ইএসএ অর্থাৎ ইনকাম রিলেটেডে ইমপ্লয়মেন্ট এন্ড সাপোর্ট এলাউন্স এবং জেএসএ অর্থাৎ ইনকাম বেইসড জব শিকাস এলাউন্স এই ছয়টি এক সাথে ইউনিভার্সেল ক্রেডিট হিসেবে পরিশোধ করবে সরকার। ইউনিভার্সেল ক্রেডিট হেল্প লাইনে টেলিফোন করলে প্রতি মিনিটে ৫৫ পেন্স চার্জ করা হয়। তাতে বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড কল চার্জ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ মিলিয়ন কল করা হয়েছে হেল্প লাইনে। বিরোধীদের দাবীর মুখে এই কলচার্জ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই বিষয়টি নিয়ে ব্রিটবাংলার সঙ্গে কথা বলেন ব্যারিষ্টার তারেক চৌধুরী। গত কয়েকদিন ধরে পার্লামেন্টের বিতর্ক এবং সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে স্থান পাচ্ছে ইউনিভার্সেল ক্রেডিট। বিষয়টি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন তিনি। ইস্ট লন্ডনের কিংডম সলিসিটর্সের প্রিন্সিপাল সলিসিটর তারেক চৌধুরী জানান, হেল্প লাইনে কল করে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এতে কারো কারো ৮ থেকে ১০ পাউন্ড বিল উঠে যাওয়ার রেকর্ড আছে। তাই পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিতে তা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যদিকে সময় ক্ষেপনের বিষয়টি নিয়ে লেবার এবং টোরির কিছু এমপিও পার্লামেন্টে কথা বলেছেন বলে জানান তিনি। তারেক চৌধুরী জানান, ইউনিভার্সেল ক্রেডিট সিস্টেমের কিছু জঠিল বিষয় আছে। এগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে খুবই ভুগান্তির কারণ হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রথমতো অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনের পর ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করা। এরমধ্যে যদি কোনো ভুল হয় তাহলে আরো ৬ সপ্তাহ, পরবর্তী ভুল হলে প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত আবেদনকারীকে অপেক্ষা করতে হয়। আর ভুলের পর নতুন করে আবেদনের জন্যে ৭০ পাউন্ড করে কর্তন করা হয়। ইউনিভার্সেল ক্রেডিটের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আবেদনকারীর মৃত্যু হয়েছে, ফুডব্যাংকের সদস্য বেড়েছে, রেন্ট পরিশোধ করতে না পারায় হোমলেস হয়েছেন। এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং আগামীতে আরো ঘটতে পারে।
অন্যদিকে আবেদন মঞ্জুর হবার পর ইউনিভার্সেল ক্রেডিট পেলেও ইনকাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি ১ পাউন্ড ইনকাম বৃদ্ধির বিপরীতে ৬৩ পেন্স ইউনিভার্সেল ক্রেডিট কমবে। যদিও বেনিফিট নির্ভর মানুষকে কর্মমূখী করাই এই স্কীমের মূল উদ্দেশ্য বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে।
এদিকে বাঙালী পাড়া টাওয়ার হ্যামলেটসে গত বছর থেকে ইউনিভার্সেল ক্রেডিট চালু হলেও গত তিন মাসে প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যাপকতা লাভ করেছে। স্ট্রীফোর্ড সেন্টারের বেনিফিট এডভাইজার শামসুল ইসলাম ব্রিটবাংলাকে জানান, সপ্তাহে অন্তত ৭ থেকে ৮টি ইউনিভার্সেল ক্রেডিটের এডভাইস দিচ্ছেন তিনি। অনলাইনে আবেদন শেষে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষায় আবেদনকারীদের মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে যারা প্রাইভেট ল্যান্ডলর্ডের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। তাদের জন্যে বেশি ঝুঁকির কারণ রয়েছে। এছাড়া ইউনিভার্সেল ক্রেডিটের জন্যে কাউকে অনলাইনের প্রশিক্ষনও দেওয়া হচ্ছে না। জব সেন্টারে গেলে আবেদনকারীদের বলে দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে আবেদন করার জন্যে। কিন্তু বাঙালী, সোমালি তথা এশিয়ান কমিউনিটির অনেক মানুষই কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে না। তাহলে তারা কোথায় যাবে? কিভাবে আবেদন করবে? কিভাবে তারা তাদের আবেদনের আপডেট জানবে বা করবে? এই প্রশ্নগুলো নিয়েও সরকারের ভাবা উচিত বলে মনে করেন বেনিফিট এডভাইজার শামসুল ইসলাম।
ইউনিভার্সেল ক্রেডিট নিয়ে ব্রিটবাংলার সঙ্গে কথা বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসের অধিবাসী মোহাম্মদ জণ্টু মিয়া। তিনি পার্ট টাইম ওয়ার্কার। স্ত্রী এবং ৩ সন্তান নিয়ে গত মার্চে ইউনিভার্সেল ক্রেডিটের জন্যে আবেদন করেন। জানালেন, আবেদনের পর প্রায় ৬ সপ্তাহ তাকে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করতে হয়েছে। প্রাইভেট ল্যান্ডলর্ডকে সময়মতো ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় বিপাকে পড়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অনেক অনুনয়-বিনয় করে ল্যান্ডলর্ডের কাছ থেকে সময় নেন তিনি।
আবেদনের পর বেনিফিট পেতে সময় বেশি লাগায় রেন্ট এরিয়ার্স বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য ভুগান্তিও বাড়ে সীমিত আয়ের বেনিফিট নির্ভর পার্ট টাইম ওয়ার্কার বা সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের। ইউনিভার্সেল ক্রেডিটের ফলে বেনিফিট নির্ভর এই শ্রেণীর মানুষরাই বেশি ক্ষতির বা ভুগান্তির মুখোমুখি হবেন ধারণা করা হচ্ছে। এক সার্ভেতে দেখা গেছে ইউনিভার্সেল ক্রেডিটে প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন পার্ট টাইম ওয়ার্কার এবং প্রায় ২শ হাজার সিঙ্গেল পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।