ইতালি ভ্রমন : পর্ব ১

।।ইমরান আহমেদ চৌধুরী।।

জুল ভার্ন তার বিশ্ব ভ্রমণ করেছিল আশি দিনে শুনলেই গাটা কেমন জানি শিউরে উঠত সেই কিশোর বয়সে প্রথম যখন পড়েছিলাম । আসলে জুল ভার্ন কাগজে কলমেই ঘুরে এসেছিল বিশ্বভ্রমান্ড – বস্তুত পক্ষে সে কখনো ফরাসীর বাইরে কোন দেশেই যায়নি জীবনেও

সেই শৈশব কাল থেকেই মনে মনে ইবনবতুতা কিংবা মার্কওপলো এর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর সখ ছিল প্রকট। বিলাতে স্থায়ীভাবে অভিবাসনের আগে কেবল বাংলাদেশেই বসবাস করেছি মোট ২৪ টি স্থানেম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়তে সর্বেসাকুল্যে মোট ১৪ টি স্কুলে পড়াশুনা করেছি

অবচেতন ভাবে কখন যে এই মনটা হয়ে গিয়েছে বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর ভক্ত তা আজ নিজেই উপলব্ধি করতে পারি নাই। আর সেজন্যই মনে হয় ভ্রমণের কোন প্রকার সুযোগ পেলে তা আর সহজে হাত ছাড়া করতে না করে হারিয়ে যাইএই একবিংশ শতাব্দীর নব্য পর্যটক মার্কও পলো অথবা ইবনবতুতার মত ঠিক এমনি ভাবেই গত ১৩ই অগাস্ট হারিয়ে গিয়েছিলাম জীবনের সকল কোলাহল, নিত্য নৈমত্তিককাজকর্ম থেকে সন্তর্পণে পালিয়ে গিয়েছিলাম এক সপ্তাহের জন্য —— গন্তব্য সেই জগত বিখ্যাত পর্যটক মার্কও পলোর শহর ভেনিসে

সেই ছোট শিশু বেলা থেকেই মা আর বাবার মুখে শুনেছি প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিত আমাদের দেশের বরিশাল নগর এর কথা , এইশহরে প্রথম গিয়েছিলাম স্কুলে পড়াকালীন সময়ে স্কাউট ক্যাম্পিং-এ পটুয়াখালী যাওয়ার পথে সেই ১৯৭৬৭৭ সনে স্কাউট টিমের ট্রুপলিডার থাকাতে বরিসাল শহরের সাথে ভেনিস শহরের মানসিক সেলুলয়েডগুলো প্রতিস্থাপন করার সুযোগ আর সেদিন হয় নাই খাল, নদী, হ্রদ, সাগরের উপহ্রদ (লেগুণ), গোনডোলা সমৃদ্ধ ভেনিস শহরপানির উপর দাঁড়িয়ে আছে মনের পর্দায় সেই অনাবিষ্কৃত কৌতুহল হয়ে আজ প্রায় ৫৮ বছর যাবত

১৯৮৬ শরৎকাল এর এক সন্ধ্যায় পরিচিত হয়েছিলাম এক জন কমবয়স্ক যুবকের সাথে এক বন্ধুর নতুন বন্ধুবেশ কিছু দিন পর তাকে প্ররোচিত করে চোরা শিকার করে নিয়ে আসলাম আমার কর্মক্ষেত্রে অনেক পটিয়ে এবং বলেছিলামআমার এখানে আসলে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসতে পারে ভবিষ্যতে তারপর ক্রমে ক্রমে আমারা পরিণতহলাম বন্ধুতে খুবই নম্র, ভদ্র এবং হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর । তখনও মাইক্রো সফট এর উইন্ডো এর যুগ আসে নাইডস বেইসেড কম্পুটার মাত্র ১৪০ মেগা বাইট মেমোরি একটা ফ্যাক্স বা চিঠি টাইপ করতে গেলে সারাদিন চলে যেত তাই বিদেশি প্রিন্সিপাল, বাইয়ার, এজেন্সি ধরতে হলে হাত দিয়ে বা ইলেকট্রিক আই বি এম টাইপ রাইটার ছিল শ্রেষ্ঠ সম্পদ সারা দিন হাত দিয়ে লিখে ফ্যাক্স করেই কেটে যেত ওর সারা দিন, মাথা গুঁজে কাজ করেই যেতমেঘ না চাইতেই অনেক টাবৃষ্টির মত কাজ পেতে থাকলাম আমরা বিভিন্ন সেক্টরে; ইন্ডেন্তিং, এজেন্সি, গার্মেন্টস এবং সাপ্লাই এর বিদেশি প্রিন্সিপ্যাল এর অভাব নাই । ক্রমান্বয়ে; ধীর গতিতে বাণিজ্য লক্ষ্মীর দেখা মিলল মনে হল বসির, জন, সোহরাব এবং সবাই একটা ভাল টিম বানিয়ে ফেললাম অবলীলাক্রমে;

মাথাগুঁজে কাজ করতে লাগলো ফ্রেডীফ্রেড্রিক ডি কোস্টা তেজগাঁও হোলি রোসারি রোমান ক্যাথোলিক চার্চের পাদ্রী ফাদার গোমেজ ডিকোস্টার কনিষ্ঠ পুত্র ফ্রেডী ১৬৭৭ সালে এই গির্জা নির্মিত ওরা পুরুষ (জেনারেশন) যাবত পাদ্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেদারুণ একটা মডার্ন এবং জ্ঞানী পরিবার ওদের ঢাকার এলিট সোসাইটির একটি বর্ধিষ্ণু পরিবার স্কয়ার ফার্মা, ঢাকার আর্চ বিসব থেকে শুরু করে বঙ্গভবন থেকে সর্বদাই আমন্ত্রণ পায় পারিবার অনেক ধরনের সামাজিক উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত এদের এই পরিবারবর্গী ( পোর্টোগিজ ) রক্ত বহন করে আসছে ওরা গত শতাব্দী যাবত । একেবারে মনে প্রাণে খ্রিস্টীয় ধর্ম অনুশাসন অনুযায়ী জীবন যাপন করে ওরা ওদের দেখে মনে পরে যেতো আমার বাল্য কালের খ্রিস্টান বন্ধু অলক, কল্পনা এবং ডিঙ্গেদার একদা জমিদার পরিবার রয় চৌধুরীদের কথা ওরা মনে হয় ব্যাপ্টিস্ট ছিল আর ফ্রেডীর পরিবার রোমানক্যাথলিক এই যা বিভক্তি কিন্তু, একদিন কথায় কথায় আমাকে বলল যে সে আসলে একজন এগ্নোস্টিক (অজ্ঞানবাদী) অর্থাৎ সে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রবণ এবং ধর্ম পালনে তেমন আগ্রহী নয় ওর এই ধরনের খোলামেলা কথায় আমি আরও ওর ব্যাপারে কেমন জানি আগ্রহী হলামবন্ধুত্ব গাঁড় থেকে আর গাঁড় হয়ে গেল ক্রমে ক্রমেনিজের অজান্তেই সে হয়ে গেল আমার সবচে বিশ্বস্ত বন্ধুতে অফিস শেষ প্রায়ই আইস ক্রিম খেতে চলে যেতাম কিন্তুকি অথবা ইন্টারকনের সুমিং পুলে বসে বসে কফি পান করতে করতে ওর কাছ থেকে পর্তুগাল, রোমান, জার্মান কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব প্লেয়ারদের সম্পর্কে ওর ভাষ্য ধারাবিবরিনি শুনতাম আইকমান, হিম্লার, গয়েবল, হিটলার সম্পর্কে ওর জ্ঞান ছিল অপরিসীম এবং বিভিন্ন আব্রাহমিক ধর্ম গুলোর গোড়াপত্তনের ইতিহাস বলেই যেত একটা টেপ রেকর্ডার এর মত আরও একটা মিল খুঁজে পেলাম আমাদের মধ্যে সেটা হল সে আমার মত পর্যটক হতে চায় সারা জীবন অবিবাহিত একাকী থাকার তার বাসনা

বিজনেস সম্প্রসারিত হতে লাগলোছোট বেলার বন্ধু আলিম এর সাথে একটা ফ্যাক্টরি তে একসাথে কাজ আরম্ভ করলাম লক্ষ পিস লেডিস টপ এর ইতালিয়ান কোম্পানি এসিয়াটেক্স এর জন্য বিরাট অর্ডার আলিম রিকুয়েস্ট করলো ওর অফিসে কাজের অনেক চাপ তাই ওর ফ্রেডী কে দরকারটেলেক্স এবং বাইয়ার দের সঙ্গে যোগাযোগ এর জন্য জাস্ট দিনে দুই ঘণ্টা পাঁচটার পর থেকে আলিম ফ্রেড আর আমি এক কড়কড়া রোদেলা দুপুরে হোটেল সোনারগাঁ তে ক্যাফে বাজার রেস্তরাতে বুফে লাঞ্চ এর জন্য নিয়ে গেলাম ইতালিয়ান কোম্পানির বাইয়ার মারথা বিয়াঙ্কা কে সাথে নিয়ে  প্রচণ্ড গরম বাইরে আমার গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে মনে হল যেন আগুনের চুলার মধ্যে প্রবেশ করালামমারথা বলল এই গরম কিছুই না ওদের দেশেশুনে আমরা অবাক রেস্তরাঁতে আমরা এক টেবিল আর একটা মাত্র টেবিলে ছয়জন গেস্ট বাকি সব খালিচুঁটিয়ে আড্ডা মারলাম সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত গরমে আর শিতাতাপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বের হতে ইচ্ছা হচ্ছিল না । প্রায় আমার থেকে এক ইঞ্চি লম্বা পাঁচ ফুট এগার ইঞ্চি লম্বা স্লিম তম্বীতরুণী মারথা অলিভ অয়েলের মত গায়ের রং বেশ খোলামেলা পোশাক পরনে তবে খুবই মার্জিত ; আধো আধো ভাঙ্গা ইংরেজিতে বেশ সুন্দরভাবে কথা বলে পারিবারিক ব্যবসা ওর দাদার বানানো এই কোম্পানিঅনেক গল্প করলো বছর যাবত কাজ করছে মিলান ইউনিভার্সিটি এর বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইন ফ্যাকাল্টি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েই নিজেদের কোম্পানিতে যোগদান করেছেওর বাবা, ওর মা, তিন ভাই এবং ওর বড়বোন সবাই মিলে কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার টার্নওভার এর এই ব্যবসা চালায়বাংলাদেশে এটাই ওদের প্রথম কাজ শুনে আমার আর ফ্রেড এর বুক টা ফুলে গেলকারন ওদের সাথে আমরাই প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করে নিয়ে এসে প্রথম অর্ডার আনি আলিম এর তো চক্ষু চরকগাছে আমাদের কে সর্ব সাকুল্যে প্রায় থেকে ১০ পারসেন্ট কমিশন পেতে শুনে প্রায় অপ্রকিতস্থ মারথা যখন জানতে পারল যে ফ্রেডও রোমান ক্যাথলিক তখন ওর আমাদের উপর আরও কেমন জানি আস্থা বেড়ে গেলঅবলীলায় প্রকাশ করে ফেলল যে ওরা আগামীতে আরও তিন চারটা কাজ আমাদের দিতে চায়সব গুলোই লক্ষ পিস এর মত শার্ট, মেয়েদের শর্টস, ব্লাউস এবং মেয়েদের জিনসওরা শুধু মেয়েদের ফ্যাশন নিয়েই কাজ করে গল্পে গল্পে ফ্রেড যখন বলতে লাগলো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ক্লিওপেট্রা, মারক এন্থনি, জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস, কনস্টান্টিনোপল এর সম্রাজ্ঞী কেথেরিন, বিযেন্টাইন এবং অটোম্যান এর ইতিহাস মারথা এসব একজন বিদেশির মুখে শুনে হতভম্ব, বিহ্বল স্থম্ভিত হয়ে শুনতে থাকল সারাক্ষণফ্রেডির দিকে ওর চোখেরমায়াবী চাহনি দেখেই বুঝে ফেললাম কেল্লা ফতে। অভিজ্ঞ জহুরি তো আর খাঁটি সোনা চিন্তে ভুল হওয়ার কথা না গল্পে গল্পে মারথা বলল ওদের ফ্যামিলি অনেক অনেক মিশ্রণ – ওর দাদী ইহুদি পোল্যান্ডে, ওর দাদা ইতালিয়ান রোমান ক্যাথলিক, ওর মা জার্মান প্রটেস্টান্টখ্রিস্টান, বোন এর বয়ফ্রেন্ড ব্রাজিলের এবং ভাই রা দুজনাই ইতালিয়ানসঙ্গী এবং দুজনাই রোমান ক্যাথলিক নিজেও এতটা ধর্ম তে বিশ্বাসীনাকিন্তু সে খুবই গর্বিত একজন ইতালিয়ান রোমান হেরিটেয হিসেবে ইতিহাস সম্পর্কে জানার খুবই তার আগ্রহ তারপর সবই আজ বাস্তব অতীত সব আজ ইতিহাসমারথা আর ফ্রেডী এখন দুই দুইটি কন্যার মাতাপিতা ।।

সেই ফ্রেডির আমন্ত্রণে আজ আমি ইতালির ভেনিসের উদ্দেশের ওয়ানা দিচ্ছি ……… ত্রিশ বছর পর ওর সাথে দেখা হবে আবার ত্রিশ বছরের জমে থাকা কত কথা …… হতে যাচ্ছে আমাদের মোলাকাত আবার ত্রিশটি বসন্ত পরে । চলবে

Advertisement