ইমরানই এ মুহূর্তে পাকিস্তানের শেষ আশা

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ইমরান খান নামটা শুনলেই চোখের পর্দায় যে ছবিটা ভেসে ওঠে, এক কথায় তার জুতসই প্রকাশ হতে পারে বুঝি ‘ফ্ল্যামবয়েন্ট’। সবকিছুতেই একটা জাঁকাল ব্যাপার। কী মাঠে, কী বাইরে। সেই তিনি, ইমরান, আজ শনিবার এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। বন্ধুমহলে তাঁকে নিয়ে প্রত্যাশা অসীম। তাঁরা মনে করেন ইমরান হচ্ছেন অকার্যকর রাষ্ট্র পাকিস্তানের ‘শেষ আশা’। বিরোধীরা বলেন, তিনি আদতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল। এমন অবস্থায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ইমরান কি জনগণের বন্ধু হতে পারবেন, নাকি শেষতক পরিস্থিতির কয়েদি হিসেবেই তাঁর শাসনকাল চিহ্নিত হবে? তিনি কি সত্যি তৈরি?

পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ‘ডন’-এ ‘পাকিস্তানের সেরা বছরগুলো?’ শিরোনামে এক নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত ও চীনে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ জাহাঙ্গীর কাজী আশা করছেন, পাকিস্তানকে তার সেরা সময় উপহার দেওয়া ইমরানের পক্ষে সম্ভব।

জাহাঙ্গীর কাজী বলছেন, একটি ‘নমনীয় দেশ’ কোনোভাবেই নিজেকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে না। ইমরান খানকে বক্তব্য, সিদ্ধান্ত এবং সাফল্যের মধ্য দিয়ে দেখাতে হবে অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র কখনো ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে পারে না। অন্যদিকে, এই ২১ শতকে সেনানিয়ন্ত্রিত উন্নয়নশীল দেশগুলো নাজুক রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় থাকবে। এসব দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই সত্যের জোরে ইমরান পাকিস্তানকে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে আবির্ভূত হতে পারেন। জাহাঙ্গীর কাজী মনে করছেন, কাজটা করতে পারলে পাকিস্তান সত্যিই একটি সফল রাষ্ট্রের অভিধা লাভ করতে পারে।

ইমরানের বিপক্ষে কাজ করছে ব্যক্তি ও নেতা হিসেবে তাঁর কিছু সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা। তিনি প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বা বড় ছবি দেখতে পান না। তাঁর আছে নারীপ্রীতি, ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে দহরম-মহরম, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক রক্ষণশীলতা।

অন্যদিকে সমর্থকেরা মনে করেন, ইমরানের মধ্যে একধরনের আত্মগরিমা এবং নিয়তিতে অপার বিশ্বাস কাজ করে, যা তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত হতে দেয় না এবং এ ক্ষেত্রেও দেবে না।

ইমরান হাড্ডাহাড্ডি করেই কূলে ভিড়েছেন। তাঁর জয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অবশ্যই খুশি। অনেকেই তাঁকে সেনাবাহিনীর প্রিয়পাত্র হিসেবে চেনেন। কিন্তু কত দিন? পাকিস্তানকে একটি গণতান্ত্রিক সুস্থতার পথে ফিরিয়ে আনতে হলে ইমরানকে দেশটির ‘ডিপ স্টেট’কে মোকাবিলা করতেই হবে। এমন একটি জোড়াতালির মোর্চার শক্তিতে তিনি কতটা পারবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে একরকম প্রতি মুহূর্তে হাত পাততে হচ্ছে চীনের কাছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ, অন্যান্য চীনা লগ্নির মতোই, ক্রমশ ফাঁস হয়ে এঁটে বসছে গলায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের থেকে বেইল আউটের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বভাবতই আইএমএফ সেখানে কিছু শর্ত জুড়ে দিতে চাইবে, যা মেনে নেওয়ার ওপর নির্ভর করবে অর্থের জোগান।

দেশময় কট্টরপন্থীরা আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইমরানের সামনে তাই এখন কঠিন চড়াই-উতরাই। পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে হবে। ঋণের ফাঁদে পা না দিয়ে চীনের সাহায্য নিতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) ধূসর তালিকা থেকে। পাকিস্তান বিশ্ব জিহাদির সূতিকাগার, এই দুর্নাম ঘোচাতে হবে।

সীমান্তের ওপারে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভাটা। আফগানরা নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য পাকিস্তানকেই দায়ী করে। নয়াদিল্লি মোটেই আগ্রহী নয় ইসলামাবাদের সঙ্গে কথা বলতে। এটাকে তারা পণ্ডশ্রম ও সময়ের অপচয় মনে করে।

ইমরানের জন্য আসল বাধা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি। জঙ্গি দমন করতে হবে। এ জন্য পাশে দরকার সেনাবাহিনীকে। উগ্রবাদের উত্থান প্রশমিত করতে হবে। পাকিস্তানের একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষায়। জীবিকা নির্বাহের জন্য যে শিক্ষা যথেষ্ট নয়। কিন্তু অভাবের তাড়না থেকে রক্ষা পেতে উগ্রবাদের জড়িয়ে পড়ার জন্য ওটুকুই কাফি।

ইমরান খান। এখন পাকিস্তান পরিচালনার দায়িত্বে। ছবি: এএফপিইমরানের যোগ্যতা এককথায় মিশ্র। তাঁর কোনো প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই। তবে এ মুহূর্তে তিনি পাকিস্তান শাসনের আসল চাবিকাঠি যাদের হাতে, সেই সেনাবাহিনীর পছন্দের অংশীদার। সেনাবাহিনী সব সময়ই দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের ওপর নিজের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বজায় রাখার ব্যাপারে সদা তৎপর। পাকিস্তানে এখনো যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষীণ সুতার মতো একটা ধারার অস্তিত্ব আছে, সেটা কিন্তু অতীতে সেনাবাহিনী ও প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে দড়ি টানাটানির কারণেই।

পাকিস্তানে বিচার বিভাগ সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করে থাকে। এর সবচেয়ে ঘৃণ্য নজির জেনারেল জিয়াউল হকের ইশারায় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো। এমনকি নওয়াজ শরিফকে কয়েদখানায় আটকে রাখার আইনগত বৈধতাও দিয়েছে দেশটির বিচার বিভাগই। নির্বাচনের সময় নওয়াজ শরিফ কারাগারে থাকায় পাকিস্তান মুসলিম লিগ-এন ভোটের প্রচারে তার সবচেয়ে ক্যারিশমাটিক নেতার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

এটা ঘটনা, ইমরান ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে তাঁর দলের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার দারুল উলুম হাক্কানিয়া মাদ্রাসায় ২.৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। এই মাদ্রাসার সবচেয়ে দৃশ্যমান ঝাণ্ডাবরদার ছিলেন মোল্লা উমর, নিহত তালেবানপ্রধান। ইমরান কি পারবেন এদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে? সেনাবাহিনী কি রাজি হবে এদের মুখোমুখি হতে? কতটা রক্তাক্ত হবে সেই লড়াই?

ইমরানের সমানে এ মুহূর্তে বিরাট সুযোগ। ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় অমরত্ব লাভ করতে পারেন। পাকিস্তানকে তিনিই ক্রিকেটের বিশ্ব মুকুট এনে দেন। এবার দেশটিকে গণতন্ত্রের পথে ফেরাতে পারেন। দুদিন আগে বা পরে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য। তাঁর অকথিত প্রাধান্যগুলোর মধ্যে সবার ওপরে থাকা উচিত সুযোগ বুঝে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত পাঠানো। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলে দেওয়া যায়, একটি মোর্চা সরকারে যেসব অন্তর্নিহিত দুর্বলতা থাকে, সেনাবাহিনী তখন সেগুলো নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাবে।

ইমরানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের প্রধান ও পিএমএল-এন নেতা শাহবাজ শরিফ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতৃত্ব এ কাজে তাঁর শরিক হতে পারে। যেমনটা এক দশক আগে নওয়াজ শরিফ আর বেনজির ভুট্টো এককাট্টা হয়ে জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে দরজা দেখিয়েছিলেন। তাঁদের মিলিত নেতৃত্বের বিক্ষোভের মুখেই মোশাররফ পিছু হটতে বাধ্য হন।

পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বনিয়াদ মজবুত করার লক্ষ্যে ইমরানের জন্য জরুরি হবে সে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সঙ্গে হাত মেলানো।

Advertisement