ইরান পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ কী

:: ড. আকমল হোসেন :: ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোন চেষ্টা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে ছয় দেশের সম্পাদিত পরমাণু চুক্তিকে টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন না। তিনি চান একটি নতুন চুক্তি, যা ইরানের পরমাণু শক্তিকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাঁচটি দেশ- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন ও রাশিয়া দীর্ঘ ও এক জটিল কূটনৈতিক দরকষাকষির পর ২০১৫-এর জুলাইয়ে ইরানের সঙ্গে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন, সাধারণভাবে যা ইরান পরমাণু চুক্তি নামে পরিচিত, স্বাক্ষর করেছিল। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরানের ওপর জাতিসংঘের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া এবং শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ইরান যাতে পরমাণু শক্তিকে ব্যবহার করতে পারে, তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছিলেন। তার ভাষায় এটি হচ্ছে, ‘এ পর্যন্ত সম্পাদিত সবচেয়ে বাজে চুক্তি।’ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চুক্তি নিয়ে সমালোচনায় মূল যুক্তি দেওয়া হয়েছে, ইরানকে এ চুক্তির মধ্য দিয়ে তোষণ করা হয়েছে। অন্যদিকে চুক্তি মানার ব্যাপারে ইরানের ইচ্ছা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। ইরানের ভেতর এর বিরোধিতাকারীরা রক্ষণশীল রাজনীতির বলয়ভুক্ত যারা এ জাতীয় চুক্তির মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন।

চুক্তি সম্পাদনের আগে যে দীর্ঘ কূটনৈতিক আলোচনা হয়েছে, তার শুরু ২০০৩ সালে, যখন দু’পক্ষের ভেতর গভীর আস্থার সংকট ছিল। ইরান শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিয়ে তার অধিকারের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছে সে সময়। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিশ্বাস করত যে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজটি চালু করেছে। অপ্রাসঙ্গিক বলা হবে না যে, পরমাণু অস্ত্রের বিষয়ে ইরানের অভিসন্ধি থাকলে তা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের শক্তির বিন্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ইসরায়েলের হাতে অঘোষিত পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, যা দেশটিকে এ অঞ্চলে এক একগুঁয়ে ও সম্প্রসারণবাদী শক্তিতে পরিণত করেছে। অন্যদিকে ইরানের সেকালের প্রতিদ্বন্দ্বী ইরাকের পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ প্রচেষ্টা তাকে একই পথে চালিত করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু ইস্যুতে ইরানের ওপর কঠোর নীতি গ্রহণের পক্ষপাতী ছিল। নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ গ্রহণে তার উদ্যোগ ছিল। অন্যদিকে ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের সঙ্গে এক

গঠনমূলক সংলাপের ভেতর দিয়ে তাকে প্রণোদনা দিয়ে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু কী ধরনের প্রণোদনা দেওয়া যায়, তা স্থির করতে তারা ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে ২০০৫ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থি আহমাদিনেজাদ নির্বাচিত হয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো কঠিন করে তুলেছিলেন।

ইরানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে মার্কিন ইচ্ছা ধীরে ধীরে প্রাধান্য পেতে থাকে, যা অন্য পক্ষগুলোকেও প্রভাবিত করতে পেরেছিল। দরকষাকষির প্রধান বিষয় ছিল, ইরান কতটুকু ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে। এ জাতীয় শর্ত আরোপে ইরানের আগ্রহ ছিল না। উল্লেখ করা দরকার যে, আমেরিকানরা ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন আলোচনা চালিয়ে নিচ্ছিলেন, যা পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তি তৈরি করেছিল। ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংস্কারপন্থি হাসান রুহানি নির্বাচিত হওয়া পরমাণু ইস্যুতে অচলাবস্থা কাটাতে সাহায্য করেছিল।

এদিকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতির ওপর গভীরভাবে নেতিবাচক হয়েছিল। যেমন, ২০১৩ সালে মুদ্রাস্টম্ফীতি ৪৫ শতাংশ, তেল রফতানি ২০১২-এর তুলনায় ৪০ শতাংশের বেশি হ্রাস এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন ডলার করে কমে যাচ্ছিল। সুতরাং অর্থনৈতিক কারণে ইরানের পক্ষে পরমাণু ইস্যুতে তার আগের অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি এবং তাকে ২০১৫ সালে চুক্তিটি মেনে নিতে হয়েছিল। চুক্তিটি হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ফ্রেডেরিকা মঘেরিনির ভাষায় সব পক্ষের শক্তিশালী রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের মিলিত রূপ।

২০১৫ সালের চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য এক স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা দূর হওয়ার প্রেক্ষাপটে তা তৈরি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কাজটি সীমাবদ্ধভাবে করবে- পরবর্তী দশ বছরে ইরান ২০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ থেকে ৬১০৪টি সেন্ট্রিফিউজে কমিয়ে আনবে বলে চুক্তিতে শর্ত আছে এবং তা করবে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য। তাছাড়া তার ফোরদৌ গবেষণা কেন্দ্রকে রূপান্তর ঘটাবে, যেখানে পাশ্চাত্যের গবেষকরা ইরানি গবেষকদের পাশাপাশি কাজ করতে পারবে। সঙ্গে আরাক হেভি ওয়াটার চুল্লিকে নতুন করে তৈরি করবে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ইরানের পক্ষে এখন অস্ত্র তৈরি করার কাজটি সুকঠিন হয়েছে। কেননা বোমা তৈরির জন্য যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে হয় (ইৎবধশড়ঁঃ :রসব), তা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের ২-৩ মাসের তুলনায় এক বছর বা তার বেশি সময় প্রয়োজন হবে এখন। তাছাড়া চুক্তির কারণে ইরানকে তার স্থাপনাগুলোকে পরিদর্শনের জন্য আইএইএর পরিদর্শকদের অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র এখন চুক্তির বিরুদ্ধে যে যুক্তি দিচ্ছে, তা তার পশ্চিমা মিত্রসহ চীন ও রাশিয়াকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলেও তারা এর সঙ্গে থাকবে বলে দিয়েছে। তবে মার্কিন চাপে এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ইরানকে কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে চুক্তিতে কোনো পরিবর্তন আনার জন্য তার তিন মিত্র ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি যদি তাদের অবস্থান বদলায়, তখন চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে, সে প্রশ্ন থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইরানের প্রতি বৈরিতার কারণে ইসরায়েল ও সৌদি আরবও চুক্তি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তাদের মিলিত চাপে চুক্তিতে কোনো পরিবর্তন হলে ইরান তা মেনে নেবে না। যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলে ইরান বেরিয়ে যাবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। তা হলে ট্রাম্পের একগুঁয়েমির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চিরকালীন আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা মিলিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে আরও হুমকির মুখে ফেলে দেবে, সন্দেহ নেই।

সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement