ইয়েমেনে ‘সৌদি দোজখ’

মারুফ মল্লিক :: কিছুদিন আগে আল–জাজিরা টেলিভিশনে একটি তথ্যচিত্র দেখছিলাম। ইয়েমেনের সংকট নিয়ে নির্মিত ওই তথ্য দেখানো হয়েছে, কয়েকজন মিলে সেদ্ধ পাতা ভাগ করে খাচ্ছেন। সম্ভবত ইফতারের খাবার ছিল ওই সেদ্ধ পাতাগুলো। ওই ভুখা ইয়েমেনিদের সামনে সেদ্ধ পাতাছাড়া আর কিছুই ছিল না। বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানানো হচ্ছে, ইয়েমেনের কিছু কিছু অঞ্চলে এখন আর খাওয়ার মতো গাছের পাতা বা ঘাসও অবশিষ্ট নেই। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ইয়েমেনে মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটছে। ইয়েমেন বলতেই এখন চোখের সামনে অনাহার ক্লিষ্ট, হাড্ডি–কঙ্কালসার মানবচেহারা ভেসে ওঠে। কোনো রাখঢাক ছাড়া বলতে গেলে সৌদি আরবের আঞ্চলিক মোড়ল হওয়ার লিপ্সার শিকার হচ্ছে ইয়েমেনের সাধারণ জনগণ। মনে হতে পারে, ইয়েমেনে সৌদি ও ইরানের ছায়াযুদ্ধ চলছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক, সেখানে দুই দেশের মধ্যে অঘোষিত লড়াই চলছে। এই লড়াই নতুন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সৌদি আরব কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য ইয়েমেনকে সব সময় কবজায় রাখার চেষ্টা করেছে। সেই থেকে সৌদি আরব নানাভাবে ইয়েমেনের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।

জাতিসংঘের হিসাবমতে, ইয়েমেনের আট মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। চরম খাদ্যসংকটের মুখে পড়েছে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য ভিন্ন। ইয়েমেনে সৌদিসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছে। খাদ্যসংকটের পাশাপাশি সেখানে নানাবিধ রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। সংঘাতের কারণে তিন মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই মুহূর্তে মানবিক সহায়তা দরকার প্রায় ২২ মিলিয়ন মানুষের। চরম মানবিক সংকটের মুখে পড়ে ইয়েমেনিরা এখন দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও অর্থের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, দালালের মাধ্যমে ইয়েমেনিরা মিসরে গিয়ে কিডনি বিক্রি করছে।

বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইয়েমেনে ২০১৫ সালের মার্চ থেকে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে চরম বিপর্যয় নেমে আসে ইয়েমেনিদের ভাগ্যে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ধাক্কায় ইয়েমেনে সংকটের শুরু। মূলত, ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই সংঘাত। ইয়েমেনের সংকট বেশ জটিল। একদিকে ইয়েমেনে আল–কায়েদার শক্ত ঘাঁটি রয়েছে; আবার ১৯৯০ সালে দুই ইয়েমেন একত্র হলেও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই অংশের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে। উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনিদের মধ্যে রাজধানী সানার দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে। আল–কায়েদাও ইয়েমেনের কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই রকম পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের শেষ দিকে হুতি জনগোষ্ঠীর যোদ্ধারা ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদিকে হটিয়ে রাজধানী সানার দখল নিলে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ১৫টি আরব রাষ্ট্র ২০১৫ সালের মার্চে হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল হাদিকে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। এর আগেই অবশ্য আরব বসন্তের গণ–আন্দোলনের মুখের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহের ৩৩ বছর শাসনের অবসান ঘটলে মানসুর হাদি ক্ষমতায় এসেছিলেন।

মূলত, ইরান শিয়া হুতিদের সহায়তা করছে অভিযোগ করে সৌদি আরব ইয়েমেনের ওপর অবরোধ জারি করেছে। লোহিত সাগরের বাব আল মানদাব প্রণালির মুখে অবস্থিত ইয়েমেন সৌদি আরবের জন্য বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ১৯৩২ সালের সৌদ পরিবারের নামানুসারে গঠনের পর থেকেই ইয়েমেনের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় ছিল সৌদি আরব। ১৯৩৪ সালে এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। তায়েফ চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান হলেও সৌদি আরব নানা উপায়ে ইয়েমেনের ভেতর বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে কখনো কখনো সামরিক অভিযানও পরিচালনা করেছে। ২০১৫ সালের অপারেশন ডিসাইসিভ পরিচালনার মাধ্যমে দুই দেশের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে।যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের হুমকির সামনে। শিশুরা আক্রান্ত। ছবি-এএফপি২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরব সামরিক অভিযান পরিচালনা করে এলেও কার্যত হুতিদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি রাজধানী সানা হুতিদের দখল থেকে মুক্ত করতে পারেনি। পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহর অনুগত বাহিনীকে নিয়ে হুতিরা সানাসহ ইয়েমেনের বেশির ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে করে সৌদি আরবের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; যদিও ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অনেক অস্ত্রের মজুত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় অস্ত্র ক্রেতায় পরিণত হতে যাচ্ছে সৌদি আরব। সৌদি আরব মূলত নিজেদের আঞ্চলিক শক্তির মর্যাদা চায়। নিজের সামর্থ্য প্রমাণের জন্য সৌদি আরব কোনোভাবেই ইয়েমেনে ইরানের উপস্থিতি বরদাশত করবে না।

ইরানের প্রভাব কমাতে সৌদি আরব যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিয়ে ভুলই করেছে। মানবিক বিপর্যয় ঘটলেও হুতিরা দুর্বল হয়নি; বরং সৌদির সামরিক খরচ বাড়ছেই। পশ্চিমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সৌদি নিজস্ব ভূখণ্ড পেয়েছে। কিন্তু কখনোই বাস্তবভিত্তিক দক্ষ কৌশল সৌদিকে অবলম্বন করতে দেখা যায়নি; বরং সব সময়ই পশ্চিমা শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে আচরণ করেছে। বর্তমানে সৌদি গণমাধ্যম ও ধর্মীয় গোষ্ঠী প্রচার করছে যে শিয়ারা শুধু ইয়েমেনই নয়, গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। শিয়া-সুন্নি বিভেদের রূপ দিয়ে সৌদি আরবে ইয়েমেন ইস্যুতে অন্যান্য সুন্নি দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে।

ইরান হুতিদের সব ধরনের রসদই জোগান দিচ্ছে বা দেবে। মাঝ থেকে সাধারণ জনগণ দুর্দশার মধ্যে পতিত হয়েছে। পবিত্র রোজার মাসে সাহরি ও ইফতার খাওয়ার মতো খাদ্য এখন ইয়েমেনের অনেক নাগরিকের কাছেই নেই। অন্যদিকে, অবরোধ আরোপ করে বিলাস, শানশওকতের মধ্যে ইফতার ও সাহরি করছেন সৌদির বাদশাহরা। মানবিকতা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে সৌদির শাসকগোষ্ঠী। লোকদেখানো যে ত্রাণ সৌদি আরব বা অন্য পশ্চিমা দেশগুলো জাতিসংঘের মাধ্যমে বিতরণ করছে, তা মানবসভ্যতার প্রতি নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই না।স্কুলবাসে সৌদি বিমান হামলায় মৃত শিশুদের কবর খোঁড়া হচ্ছে। ছবি এএফপিপ্রশ্ন হচ্ছে, ইয়েমেনের বিষয়ে সৌদি এতটা কঠোর নীতি অবলম্বন করছে কেন? আরবজুড়ে যে রাজনৈতিক বসন্তের সূচনা ঘটেছিল ২০০৯ সাল থেকে, তা সৌদি আরবের সুন্নিধর্মীয় নেতৃত্ব ও রাজতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। অগণতান্ত্রিক আচরণ, অমানবিকতা, পশ্চিমাদের পদলেহনসহ বিভিন্ন কারণে সৌদি আরবের আঞ্চলিক শক্তির মর্যাদা লাভ ও সামগ্রিকভাবে বিশ্বস্ততা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে আরব বসন্ত। গণতান্ত্রিকবোধসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এখন সৌদি নীতিকে সমর্থক করেন না।

আরব বসন্তের অনেক ব্যর্থতা আছে। আরব বসন্ত এক ব্যর্থ জন–আন্দোলনের নাম। অন্তত এখন পর্যন্ত। কিন্তু একই সঙ্গে আরব বসন্ত আরবের জনসাধারণের জন্য নতুন এক ক্ষেত্র, নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। এখন সেই দুয়ার দিয়ে গণতন্ত্রের সেই মাঠ বা ক্ষেত্রে আরবরা ঢুকবে কি না, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আরবের স্বৈরশাসকেরা কখনোই জনগণের উত্থানকে মেনে নেননি। সৌদি বাহশাহরাও আরব বসন্তকে ভালোভাবে নেননি। এ অবস্থায় সৌদি শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার জন্য ইয়েমেনকেই বেছে নিয়েছেন। এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করছে সৌদি আরব—অভ্যন্তরে কোনো বিক্ষোভ যেন দানা বাঁধতে না পারে, আর ঘাড়ের ওপর ইরানের নিশ্বাস স্তব্ধ করে দেওয়া।

Advertisement