:: লীনা পারভীন ::
বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শুনছিলাম এই কথা বেশ ক’বছর ধরেই। শেষ পর্যন্ত সেই সুখবর পাওয়া গেলো। জাতির জনকের ৯৯তম জন্মদিনে পাওয়া গেলো সেই কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)-এর ২০তম অধিবেশনে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এ এক অনন্য পাওয়া।
একটা সময় বাংলাদেশকে দেখা হতো বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি হিসেবে। বিশ্ব মানচিত্রে অনেকের কাছেই এই নামটি জানা ছিল না। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’–আমেরিকান পররাষ্টমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের করা সেই উক্তি আজও আমাদের প্রতিটি নাগরিকের মনে অপমানের চিহ্ন হয়ে আছে।
সেই তলাবিহীন ঝুড়িকে একটি পরিপূর্ণ ঝুড়িতে পরিণত করার গুরুদায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন জাতির পিতা। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে টেনে মাটির উপরে তুলে আনার শপথ কোনোভাবেই সহজ কিছু ছিল না। কিন্তু সেই কাজটিকেই সহজ করে তুলতে শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন। শিখিয়েছিলেন স্বপ্ন কেমন করে দেখতে হয়। বিশ্বের কাছে কেমন করে মাথা উঁচু করে নিজেদের অবস্থানকে জানান দিতে হয়।
সেই স্বপ্নকে বুকে লালন করেই এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নয়নের শপথ নিতে তিনিই পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। পিতার স্বপ্নকে ধারণ ও লালন করে সেই স্বপ্নকে আজ সত্য হিসাব করে দেখিয়েছেন তিনি। বিশ্ব এখন আর বাংলাদেশের নাম ভুলতে পারবে না। কেউ আর প্রশ্ন করবে না বাংলাদেশ কোথায় অবস্থিত? আর কোনও দেশ বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলার মতো সাহস দেখাবে না। ঋণের বোঝা চাপাতে পারবে না। শর্তের বেড়াজালে বাঁধার চেষ্টা করবে না। আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজের অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে তৈরি করছি পদ্মাসেতু।
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতগুলোর উন্নয়ন এই অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।
একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের এই অর্জনে আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি কিছু প্রত্যাশার কথাও বলতে চাই। দেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। উন্নয়নশীল দেশ মানেই আমাদের কাছে অনেক উঁচু একটি সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিক জীবনে আছে শান্তির ছায়া, আছে নিরাপত্তা, আছে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, আছে উন্নত জীবনযাপনের জন্য যেসব নিয়ামক প্রয়োজন সেগুলোর উপস্থিতি। আমি আশা করতেই পারি আমার দেশের সকল নাগরিকের বাসস্থানের নিশ্চয়তা দেবে রাষ্ট্র। বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না কেউ। সঠিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজেকে কুশিক্ষার মাঝে ফেলে দেবে না কোনও নাগরিক। ন্যূনতম শিক্ষার নিশ্চয়তা নেবে রাষ্ট্র। উচ্চশিক্ষা হবে অবারিত। উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকবে নাগালের মাঝে, যেখানে একজন নাগরিক বেছে নেবে তার পছন্দমত বিষয়। জীবনধারণের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তার সংস্থানের সুযোগ থাকবে প্রতিটি নাগরিকের।
প্রত্যাশার শেষ নেই। কিন্তু কিছু বিষয় একেবারেই এড়িয়েও যাওয়া যায় না। খুব সংকীর্ণভাবে বললে, আমি একজন নাগরিক, আমি একজন নারীও। বর্তমান সময়ে আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় একজন নারী কতটা স্বাধীনতা ভোগ করছে সেটি প্রতিদিনের বাস্তবতায় একদম পরিষ্কার। নতুন করে বলার আর কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
জাতিসংঘ যে কারণগুলোকে আমাদের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠার জন্য নির্ধারণ করেছে সেখানে বাস্তবেই কতটা উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সেটাও একটু অনুধাবন করা উচিত। জাতীয় আয় হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু সমাজ থেকে দরিদ্র মানুষের হার কতটা কমেছে? কতটি পরিবার এখন তিনবেলা খাবারের নিশ্চয়তা পেয়েছে? সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য কি কমেছে নাকি আরও বেড়েছে? কেবল কাগজে কলমে বাড়লেই কি বাড়া বলে?
প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী পাস করে বেরুচ্ছে। তাদের কতজন কাঙ্ক্ষিত কর্মের সন্ধান পাচ্ছে? বেকারের হার এখন কত? আমি জানি একদিনেই সব হয়ে যাবে না, তবে বেকারত্ব দূর করার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এই নিশ্চয়তা অবশ্যই চাইতে পারি।
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন কি আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে পারছে? এখনও বাংলাদেশের সামর্থ্যবান মানুষেরা দেশের বাইরে যান চিকিৎসা করাতে। আস্থার সংকট আছে দেশীয় ব্যবস্থাপনায়।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের মর্যাদায় পৌঁছাতে চায়। একটি উন্নত দেশ মানেই সেখানে থাকবে না কোনও অনাহারী লোক, একজন লোকও শিক্ষার বাইরে থাকবে না, স্বাস্থ্য সুবিধায় থাকবে অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস, যেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিশ্চিত হবে সকলের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা। শিশুমৃত্যু, প্রসূতি মৃত্যুর হার নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই অনেক সামাজিক ইন্ডিকেটর অর্জনে সফল হয়েছে।
তবে উন্নত দেশের নাম অর্জন করতে হলে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি। আমাদের দেশে বর্তমানে এই বিষয়টি অত্যন্ত অবহেলিত। এই সমাজে নারীর অবস্থান এখনও নাজুক। একজন নারীকে মর্যাদার আসনটি ছেড়ে দিতে পারিনি আমরা। প্রতিদিনের খবরে যে পরিমাণ নারী নির্যাতনের খবর আসে তার ক’টি সঠিক বিচারের আওতায় এসেছে সেটি এখন এক বিরাট প্রশ্ন। তনু ধর্ষণ ও হত্যার মতো আরো কয়েকটি ঘটনার বিচার আজও নীরবে কেঁদে চলেছে। তকির মতো একজন কিশোরের জীবন আমরা রক্ষা করতে পারিনি। পারিনি তার হত্যার বিচার আদায় করতে।
আমরা চাই আমাদের সমাজ হবে একটি ন্যায় বিচারের সমাজ। একজন মানুষও হারিয়ে যাবে না কোনও ঠিকানা ছাড়া। একজন মানুষকেও চিন্তা করতে হবে না সে বাইরে গেলে আর ফেরত আসবে কিনা? একজন নারীও আর ধর্ষিত হবে না। কোন ধর্ষণ বা অবিচারের ঘটনা বিনা বিচারে পার পেয়ে যাবে না কেবল অবহেলার কারণে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়ে উঠুক আমাদের বাংলাদেশ।
আমি গর্বিত একজন উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে। কিন্তু আমি এও চাই, উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক নয়, এই উন্নয়ন আসুক সামাজিক ও আইনি কাঠামোতেও। উন্নয়নের ছোঁয়া এসে লাগুক সমাজের প্রতিটা নাগরিকের জীবনে। দূর হয়ে যাক সকল বৈষম্য।