এত আশঙ্কার, এত সন্দেহের নির্বাচন!

তুহিন ওয়াদুদ :: ‘আর্মি নামলে কেউ দুর্নীতি করতি পারবি না। ভোট সুষ্ঠু হবি।’ ‘ভোটে আওয়ামী লীগই জিতবে।’ ‘ভোট যেমন কর‌্যা পারে লিবে।’ ‘প্রশাসন নিরপেক্ষ থ্যাকলে মারিং-কাটিং কর‌্যা জেতা সহজ লয়।’ ‘ভোট যুদিল না হয়, তাহলি এত ট্যাকা খরচ কররি ক্যা?’

১৩ ডিসেম্বর বগুড়া শহরের করতোয়া নদীর এসপি সেতুর পাশে কয়েকজনের এমন কথোপকথনই চলছিল। বাদশা মিয়া নামের একজন বলছিলেন, বগুড়ার সারিয়াকান্দি- সোনাতলা আসন ছাড়া সব কটিতেই ধানের শীষের অবস্থা ভালো।

বগুড়া থেকে নাটোর যাওয়ার পথে নন্দীগ্রাম উপজেলায় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। আইজুদ্দি নামের একজন বলছিলেন, ‘এটি (এখানে) সব প্রার্থী সমান কর‌্যা ভোট চাওয়ার পারিচ্ছে না।’ এর বেশি তিনি বলতে চান না। সামনেই কয়েকজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলেন। আমি এগিয়ে পাশে দাঁড়াতেই আলাপ বন্ধ করলেন। জিজ্ঞাসা করলাম হিরো আলমের (আশরাফুল আলম হিরো) কথা। হিরো আলম নন্দীগ্রাম-কাহালু আসনে নির্বাচন করছেন। একজন বললেন, ‘হিরো আলমকে দেখছি টিভিত।’ আরেকজন বলছিলেন, ‘ভোট অত সহজ লয়। হিরো আলম জিতবার পাইরবার লয়। ওত্তুনা চেংড়া (ছোট ছেলে) ভোট কইরবার আসিচ্ছে।’

ধানের শীষের প্রচারণা নিয়ে অনেকখানেই একই অভিযোগ। আবার অনেক স্থানে নির্বিঘ্নে প্রচারণার কথাও জানা গেছে। সিংড়া উপজেলায় যাঁদের সঙ্গেই কথা বললাম, তাঁরা সবাই বলছেন, নাটোর–৩ আসনে ভোট ভালো হবে। জুনাইদ আহমেদ পলক এ আসনে জিতবেনই। দু-একটি স্থানে ধানের শীষের পোস্টার চোখে পড়ল। নাটোর জেলা শহরে ফেরি করে পতাকা বিক্রি করেন আবদুল জলিল। তিনি জানালেন, এ বছর পতাকা খুব কম বিক্রি হয়েছে। কম বিক্রির কারণ হিসেবে বললেন, এ বছর স্কুল-কলেজে বিজয়ের অনুষ্ঠান কম হয়েছে। ভোটের হালচাল জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘পতাকা বেচা হইচ্ছে না। দিনই চলিচ্ছে না। ওইলা ভোটের খবর রাইখ্যা হামাকেরে লাভ নাই।’

১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রংপুরের আশরতপুর এলাকার কামারের মোড়ে নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেখানে ‘নতুন প্রজন্ম লাঙ্গলে ভোট দেবে না’—এ কথা একজন বলতেই বয়স্ক এক ব্যক্তি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় যদি নৌকা হয়, বগুড়ায় যদি ধানের শীষ হয়, তা হইলে কেন রংপুরে লাঙ্গল হবার নয়?’ লাঙ্গলের আরেকজন সমর্থক বললেন, ‘সবাই খালি এরশাদকে স্বৈরাচার কয়, উনারা তাহলে কী?’

১৯ ডিসেম্বর গিয়েছিলাম রংপুরের কাউনিয়া এবং লালমনিরহাট সদর এলাকায়। কাউনিয়ায় একজন জানালেন, সেখানে ধানের শীষের প্রচারণায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। বরং ধানের শীষের একজন সমর্থক বললেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধানের শীষের প্রার্থীর চেয়ে বেশি যোগ্য। কিন্তু তিনি মার্কা দেখে ভোট দেবেন।’ লালমনিরহাট সদর আসনে রাজপুর ইউনিয়নে ধানের শীষের এক প্রচারকর্মী বললেন, ‘শুনবার নাগচি, পোলিং এজেন্টদের নাকি ধরি নিয়া যাইবে। কথাটা কি হয়, ভাই?’

রংপুর-৬ আসনে পীরগঞ্জ উপজেলার অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকম। ২০ ডিসেম্বর সেখানে এক যুবকের সঙ্গে কথা হয়। প্রথমে আমাকে বললেন, তিনি নৌকা মার্কার সমর্থক। কিন্তু আওয়ামী লীগের কড়া সমালোচনা করছেন। ধীরে ধীরে কথা বলে জানতে পারলাম, তিনি ধানের শীষের কর্মী। তিনি জানালেন, কাউকে না জেনে হঠাৎ করে ধানের শীষের সমর্থক—এ কথা বলতে চান না। পীরগঞ্জে ধানের শীষের প্রচারণায় তাঁদের কোনো অসুবিধা নেই। পীরগঞ্জ উপজেলায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন। শিরীন শারমিন চৌধুরী স্থানীয় লোকজনের মন জয় করতে পেরেছেন। হাওয়া তাঁর পক্ষেই আছে। চাঁদ মিয়া নামের একজন বললেন, ‘সংসদে শেখ হাসিনাও শারমিন আপার অনুমতি নিয়া কথা কয়। তাকে ভোট না দিলে চলবে না।’

পীরগঞ্জ উপজেলার পাশে রংপুর-৫ আসন মিঠাপুকুর উপজেলা। ২০ ডিসেম্বর দিনাজপুর-ফুলবাড়ী সড়কের মোসলেম বাজারে এ আসনের নির্বাচনী এলাকা আহাদ হোটেলে দুপুরের খাবার খাই। হোটেলের পেছনে কর্মচারীরা কাজ করছিলেন। ভোটের কথা তুলতেই একজন বললেন সম্ভবত রসিকতা করে, ‘যাঁই টাকা দেবে তাকে ভোট দেমো।’ মমতাজ বেগম নামের একজন বৃদ্ধ বললেন, ‘মুই বয়স্ক ভাতা পাং নাই। তেঁও ভোট দেমো শেখের বেটিক। শেখ তো দ্যাশ স্বাধীন করছে।’ হোটেলটিতে খাওয়ার সময় একজন বলছিলেন, ধানের শীষের প্রার্থিতা এখন স্থগিত অবস্থায় আছে। ধানের শীষ না থাকলে অনেকে ভোট দিতে আসবেন না।

শহরের দমদমা এলাকায় বাড়ি কৃষক সাইফুল ইসলামের। ২২ ডিসেম্বর তিনি বলছিলেন, ‘কৃষক তো ধান চাষ করি মরি গেল। খালি লস আর লস। আওয়ামী লীগ ফির সরকার হইলে ধানের কি দাম বাড়বে?’ পাশেই দাঁড়ানো দর্শনার মোড় এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘সরকার খালি চাকরিজীবীদের সুবিধা দেয়। তার মধ্যে পুলিশ আর প্রশাসনকে বেশি দেয়।’ বিএডিসির অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মচারী বলছিলেন, ‘কয় বছর থাকি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের খুব বিপদ হইচে। সরকার যারাই গঠন করুক, এবার নিম্নমধ্যবিত্তের দিকে তাকাতে হবে।’ এই আলাপের মধ্যে একজন কথা তুললেন এরশাদের অসুস্থতা নিয়ে। জাতীয় পার্টির একজন বললেন, ‘এরশাদের কোনো দোষ নাই। জোর করি একটা পক্ষ অসুস্থ বানে (বানিয়ে) সিঙ্গাপুর পাঠাইচে। কথায় কথায় খালি মামলার ভয় দেখায়।’

গত কয়েক দিন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মানুষের সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছি। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের বিচিত্র-বিশ্লেষণ আছে। মানুষ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে চায়। জনমনে আশঙ্কা, ভোট সুষ্ঠুভাবে হবে না। এই অনুমান করার মতো যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এই কথার সত্যাসত্য দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

আমাদের তো গণতন্ত্র ছাড়া আর কোনো ভিন্ন ভালো পথ নেই সরকার গঠনের। সেই পথ যদি আমরা নির্মাণ করতে না পারি, তাহলে আমাদের মতামতের কোনো গুরুত্ব প্রতিফলিত হবে না। ভোটশক্তির পরিবর্তে যদি অন্য কোনো শক্তির ওপর ভর করে সরকার গঠিত হয়, তার ফল সরকারের জন্যও কল্যাণের হবে না। শুধু মহাজোটের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা নয়, ঐক্যফ্রন্টের পক্ষেও ভোট কারচুপি হতে পারে। যারা যেখানে প্রভাবশালী, সেখানেই এই আশঙ্কা অমূলক নয়। নির্বাচন তো দেশ পরিচালনার জন্য পাঁচ বছরের প্রকল্প নয়; এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সুষ্ঠু নির্বাচন সবার জন্য জরুরি। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতার বাইরে থাকা যা-ই মনে হোক না কেন, আমরা সবাই এ দেশের জনগণ। ৩০ ডিসেম্বর জনমনের সব আশঙ্কা-সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর হবে—এটাই আমাদের কাম্য।

Advertisement