‘মানে কী? আপনার লুকিং গ্লাস নাই?’
তাকিয়ে দেখা গেল, লুকিং গ্লাসের জায়গায় দুটো লোহার দণ্ড অনেকটা বেরিয়ে এসে এটাই জানান দিচ্ছে, একদা হয়তো ছিল আয়না এখানে। এখন বাসের আয়নার দরকার নেই, কারণ চালকের আছেন হেলপার। তিনি বাসের গায়ে চাটি মারেন ‘বরাবর, বরাবর’ (মানে সোজা চালান), অথবা আরেক চাটি মেরে বলেন, ‘ওস্তাদ, বামে প্লাস্টিক’ (মানে প্রাইভেট কার)।
কে যে ওস্তাদ আর কে যে শাগরেদ, মাঝে মাঝে তা আপনি বুঝতেই পারবেন না। কারণ, যখন শাগরেদ হাতে-কলমে কাজ শেখেন যাত্রীবাহী বাস শহরের রাস্তায় চালিয়ে, তখন তো চালকের আসনে শাগরেদই বসেন ওস্তাদ বেশে! এই তো, ৩ মে প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালনা, কারাগারে ১০ চালক’। আর পাশের গাড়িটা প্লাস্টিক তো বটেই, ভাগ্যিস হেলপার বাসের গায়ে ডবল চাটি মেরে এখনো বলেন না, ‘ওস্তাদ, প্লাস্টিকের ভেতরে কাগজ!’
তবে কোনো কোনো বাসের চালক মানুষের জীবনকে কাগজের জীবনই ভাবেন বোধ হয়। নয়তো বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে বাসের চালক কী করে একজন গাড়ির চালকের গায়ের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দিতে পারেন? খবর প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল। শিরোনাম ছিল ‘এবার পা কেড়ে নিল বাস’। এই শিরোনামের ‘এবার’ শব্দের ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেক ধারাবাহিক তথ্য। কয়েক দিন আগে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলছিল রাজীবের। রাজীব শুধু হাতই হারাননি; হারিয়েছেন জীবন। বাবা-মাহারা ছেলেটি একটু যখন নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাইলেন, তখনই তাঁর জীবন গেল।
রাজীবের দুর্ঘটনার দুই দিন পর দুই বাসের প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে চলার শক্তি হারান আয়েশা খাতুন। নিয়ম না মানা বাসের চালক বাস তুলে দেন ট্রাফিক পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনের ওপর। হয়তো এ জীবনে তিনি আর কাজে ফিরতে পারবেন না। ময়মনসিংহের রোজিনা প্রথমে পা হারালেন, পরে জীবন, ওই বেপরোয়া বাসের জন্যই। একের পর এক। কয়েক দিন আগে একটি ছবি দেখলাম সংবাদপত্রের পাতায়: বাসের নিচে চাপা পড়েছেন মা, পাগলপ্রায় ছেলে একাই হাত দিয়ে ঠেলছেন গোটা বাস। এত সব ঘটনার পরও টনক নড়ে না কারও। একের পর এক, অতঃপর, এবার। শিরোনাম হচ্ছেই।
গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। সেখানে আছে খুঁটিনাটি অনেক তথ্য। কিন্তু লাভ কী তাতে? প্রতিবেদক পরিশ্রম করেছেন, সংবাদ ব্যবস্থাপকেরা তা যত্ন করে গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছেন, পাঠক পড়ে একে অপরকে বলেছেন, ‘দেখেছ? যা-তা চলছে!’ এটুকুই। রাস্তায় কি লক্কড়ঝক্কড় একটা বাসও কমেছে? বাসগুলো রাস্তা দিয়ে নির্লজ্জের মতো কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যায়। যাবে ডানে কিন্তু বামের রাস্তা বন্ধ করে বসে থাকে। ডান-বাম, ডান-বাম লেন বদল করতেই থাকেন ওস্তাদেরা। এক দিনেও ওস্তাদ হওয়া যায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ঢাকার রাস্তায় বড় বড় হরফে সাইনবোর্ডে লেখা—২৪ ঘণ্টায় ড্রাইভিং শিখুন।
কিছুদিন আগের ঘটনা। ঢাকার রাজপথে একটি গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ভচকে দেয় একটি বাস। গাড়ির চালক অনেক কষ্টে বাসটি থামিয়ে ক্ষতিপূরণ চাইলেন। অনেক বাগ্বিতণ্ডার পর বাসচালক এক হাজার টাকা দিতে চাইলেন। গাড়ির পক্ষ রাজি নন, কারণ তাঁরা জানেন খরচ হবে দশ গুণ। উত্তেজিত বাসচালক বললেন, ‘কালকে একটা নতুন প্রাডো ভচকাইছি, দুই হাজার দিছি, আপনারটা তো পুরানা মডেল…।’ ভাবটা এমন, আপনারটা তো শুধু প্লাস্টিকই না, পুরোনো প্লাস্টিক। শুধু তা-ই নয়, যখন পেছন থেকে ধাক্কা মেরে বাসটা পালিয়ে যাওয়ার কৌশল করছিল আর গাড়ির চালক তাকে থামানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন আরেকটু হলেই চাপা পড়তেন প্লাস্টিকের ভেতরের কাগজগুলো। বাসের যাত্রীরা হস্তক্ষেপ করে বাস থামিয়ে শেষ রক্ষা করেছেন।
জানি, বাসচালকদের কাছে এ বড় মামুলি ঘটনা। তাঁরা জানেন, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। যা কিছুই হোক, তাঁরা ঠিক পালিয়ে বাঁচবেন। ওস্তাদেরও তো ওস্তাদ আছে। কিন্তু যার যায় সে-ই জানে কী যায়। প্রথম আলোর কৌতুক ক্রোড়পত্র ‘রস+আলো’র ভাষায় বলি: ‘ওস্তাদ, একদিন আপনার আপনজনও থাকতে পারেন প্লাস্টিকের ভেতর!’
কিছুই কি করার নেই? কদর্য, কঙ্কালসার, উচ্ছৃঙ্খল বাসগুলো নগরে এভাবেই চলতে থাকবে? যেখানে খুশি দাঁড়াবে, যাত্রী তুলবে, নামাবে, পরস্পর অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে মানুষের হাত, পা, প্রাণ কেড়ে নেবে? আলাপ হচ্ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের তরুণ অধ্যাপক আখতার মাহমুদের সঙ্গে। তিনি গুছিয়ে বললেন: ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) কর্তৃক প্রণীত ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান’-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন বাসমালিকদের মধ্যকার অসুস্থ প্রতিযোগিতার অবসান ঘটাতে পারে। পরিকল্পিত ‘বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি’ বাস্তবায়ন করা গেলে যাত্রীসেবার মান বাড়বে, বাসের মান ভালো হবে, যানজট কমবে, সর্বোপরি নগরে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আসবে।
তবে তিনি এও বললেন, অল্প সময়ের ব্যবধানে কিছু ফল পেতে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের তদারকির সততার বিকল্প নেই।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংবাদপত্রের পাতায় কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তাতে ‘রিঅ্যাক্ট’ বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া না করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি ‘রেসপন্স’ করেন বা সাড়া দেন, তাহলে নাকি সমাজের উপকার হয়। আবার এও বলেন, একই কথা বারবার শুনতে শুনতে শ্রোতার বা পাঠকের নাকি গা-সওয়া হয়ে যায়। ভোঁতা হয়ে যায় সংবেদনশীলতা (নারকোটিক ডিসফাংশন)। সংবাদপত্রের পাতায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষের মানবিক কাহিনিগুলোও কি তবে ধীরে ধীরে আমাদের গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে? নয়তো ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের বয়স তো কম হলো না। আমরা কি ধরেই নিয়েছি এটা শুধু তার বেদনা, যার নিজের ক্ষতি হয়েছে?
মনে আছে, সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা সাগরের ঢেউয়ে প্রাণ হারানো সেই ছোট্ট আয়লানের নিথর দেহের কথা? তুরস্কের একজন নারী সাংবাদিকের তোলা সমুদ্রের পাড়ে আয়লানের জামা-জুতো পরা প্রাণহীন ছবিটা চাবুক মেরেছিল বিশ্বের মানবিক চেতনায়। ইউরোপে সিরীয় শরণার্থীদের প্রবেশের বিষয়ে জীবন দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে গিয়েছিল ছোট্ট মানুষটি। যেন হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে বাধ্য হয়েছিল সবাই। একটি ছবি কত শক্তিশালী হতে পারে! কত কূটনৈতিক তৎপরতার চেয়েও কার্যকর হতে পারে।
কিছুদিন আগে কারওয়ান বাজার এলাকায় দুই বাসের রেষারেষির শিকার হয়ে ঝুলছিল বাসযাত্রী রাজীবের হাত। সেই ছবি মোবাইল ফোনে তুলে এনেছিলেন আমাদের সহকর্মী মিজানুর রহমান খান। তা ছাপা হয় প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। ভয়ংকর ছবি! এই একটা ছবির কারণেই আলোচনায় উঠে এল শহরের বাস-নৈরাজ্যের কথা নতুন করে। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রাধান্য পেল গণমাধ্যমে। ফলোআপের পর ফলোআপ প্রতিবেদন। কিন্তু লাভ কী তাতে? রাজীব পৃথিবী থেকে চলে গিয়েও আমাদের টনক নড়াতে পারেনি। আমাদের চেতনায় চাবুক মারে কার সাধ্য? আমরা যে ঘায়ের ওপর মাছি বসলেও তাড়াতে ভুলে গেছি!