কিশোরী বিউটি, তার বাবা ও খাদক শেয়াল

:: ফারুক ওয়াসিফ ::

বিউটি আক্তারকেও শেয়ালেরা খেয়ে গেছে। ১৬ বছরের মেয়েটিকে পাওয়া গেছে শুকনা হাওরের সবুজ ঘাসে, ধানখেতের পাশে। রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। ছোটবেলায় দুধের শিশুদের শেয়ালে টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা শুনতাম। নদী-জঙ্গল বা খেতের ধারে শিশুর আধখাওয়া দেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত। লোকে ভিড় করে দেখত।

রাতে ঘুমাতে না চাইলে মানুষখেকো শেয়ালের গল্প বলামাত্রই আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলতাম। এখন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি, সবুজ ঘাসের মধ্যে লাল পিরান পরা বিউটি আক্তারকে। রক্তে ভাসা, ছিন্নবিচ্ছিন্ন গ্রামীণ কিশোরী। যতটা বড় হলে শিশুর স্বপ্ন আর গ্রামীণ মায়া হারিয়ে যায়, ততটা বড় হয়নি সে! কিন্তু শেয়ালেরা অল্পবয়সী শিকার ভালোবাসে। হয়তো মুরগির মতো মনে হয় তাদের।

শেয়ালের পাল বিউটিকে আগেও একবার পেয়েছিল। সামান্য চাকরির কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেবার জানে মারেনি। রক্ত খেয়ে তছনছ দেহটা ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। এই করুণা নিতে পারেননি মেয়েটির বাবা সায়েদ আলী। তিনি শেয়ালদের সর্দার বাবুল মিয়াসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন হবিগঞ্জ আদালতে (হয়তো থানায় যাওয়ার সাহস করেননি বা থানার ওপর আস্থা করেননি)। মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে রাষ্ট্রকে সুবিচার করার সুযোগ দেন। কেননা, আইন প্রতিশ্রুতি দেয় বিচারের। কেননা, গণমাধ্যমে আমরা লজ্জা না পেয়ে প্রতিবাদ করার কথা বলি। সমাজের সচেতনরাও বলেন, মেয়ে, তুমি চিৎকার করো, প্রতিবাদ করো, গুটিয়ে যেয়ো না।

বিউটি আক্তার ও তাঁর বাবা-মায়ের বোধ হয় বিশ্বাস ছিল আমাদের সবার ওপর: আইনের ওপর, প্রশাসনের ওপর, গণমাধ্যমের ওপর, নাগরিক সমাজের ওপর। কিন্তু বাবুল মিয়া জানত, দেশটা কেমন করে চলে। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি-ধমকি চালাতে থাকে আসামিপক্ষ। যে শায়েস্তাগঞ্জ থানার পুলিশের ওপর তদন্তের দায়িত্ব, তাদের পাশে পায়নি পরিবারটি। ভীত বাবা ভেবেছিলেন, মেয়েটাকে নানিবাড়ি পাঠিয়ে দিই। নানিবাড়ি একই উপজেলার আরেক গ্রামে। তাতে কী? শেয়ালদের হাত ও নাক অনেক লম্বা। গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা বিউটির নানিবাড়ি চিনে আসে। তারপর ঝোপের মধ্যে ওঁত পেতে থাকে। তারা জানে, গরিব ঘরের মেয়ে বিউটির নানিও গরিব। এবং দেয়াল-পাহারাহীন বাড়ির মেয়েটিকে রাতে প্রকৃতি ডাকবেই, ঘরের বাইরে তাকে পাওয়া যাবেই। গরিব-মধ্যবিত্ত মেয়েদের এত সব দুর্বলতার কথা সব শেয়ালেই জানে। জানে যে, অনিরাপদ দুনিয়ার পথে তাদের বের হতে হবেই। বোরখা থেকে লোহার পোশাক, সব ছিঁড়তে জানে দাঁতাল শেয়ালেরা।

শুক্রবার রাতে বিউটি প্রকৃতির ডাকে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেন না। পরদিন শনিবার শায়েস্তাগঞ্জের শুকানো হাওরে তার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। যারা গিয়েছিল, তারা বাংলাদেশের আশ্চর্য এক পতাকার দেখা পায়। সবুজ জমিনে রক্তে লাল হয়ে শুয়ে আছে বিউটিফুল বাংলাদেশের এক বিউটি আক্তার।

স্বাধীনতার মাসে কিশোরীর রক্তমাখা সবুজ জমিন দুঃসহ বাস্তবতার প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই দৃশ্য অনেককেই ঘুমাতে দেয় না। তারা ফেসবুকে বিউটির লাল জামা পরা মরণঘুমের ছবি শেয়ার করতে থাকে। মানুষের মন এতটা নিতে পারে না। তাদের মনে পড়ে তনুর কথা, আফসানার কথা, প্রতিনিয়ত ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়া শিশু-কিশোরী আর তরুণীদের কথা।

ধর্ষণ ও গণহত্যা পেরিয়ে আসা বাংলাদেশে চলতে থাকে পাকিস্তানি কায়দার অনুকরণ। ছোট ছোট একাত্তর ঘটে চলে ছোট ছোট কত পরিবারে। গ্রাম ও শহরের সেই মেয়েদের ছবি পাশাপাশি সাজালে নারী প্রজাতির ৬ মাস থেকে ৬০ বছর বয়সী সবাইকে পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে সব ধরনের পোশাকের, সব ধরনের বাস্তবতার নির্যাতিতদের। অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবধি শোনা যায় শেয়ালদের গ্রাসের শিকার কন্যা-জায়া-জননীদের বিলাপ।

মুরগিখেকো শেয়ালেরা আর নেই। উন্নয়ন ও আধুনিকতা প্রকৃতির শেয়ালদের তাড়ালেও নারীখেকো শেয়ালদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই শেয়ালেরা নারীকে মুরগি মনে করে। এদের অন্যতম হবিগঞ্জের বাবুল মিয়াকে এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ। কিন্তু তারা কি জানত না যে ধর্ষণের শিকার নারীর জীবন মামলার পরে আরও ঝুঁকিতে পড়ে? কেননা, সেই ধর্ষণের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী! তারা কি জানত না যে মেয়েটিকে গায়েব করে দিলেই ধর্ষক ও দল-বল নিদায়-নিরাপদ হয়ে যায়? জানত না যে লাগাতার ধর্ষণের ঘটনা ভুলিয়ে দেয়ার শক্তিশালী চেতনানাশক আমাদের হাতে আছে? জাতীয় জীবনের মেগাসিরিয়ালের মধ্যে বিউটি বা তনুদের লাশের জোগান চলতে থাকে। সব জেনেও কেন ৪ মার্চ মামলা করার পরেও ১৭ মার্চ পর্যন্ত আসামি বাবুল মিয়াকে ধরাই গেল না! পুলিশ যাদের খুঁজে পায় না, তারা দিব্যি হুমকি দিয়ে যায়, তারপর নিষ্পাপ মেয়েটিকে আরেকবার ধর্ষণের পর মেরে ফেলার জন্য ফাঁদ পেতে থাকে? বিউটির শরীর ছিন্নভিন্ন করার ঘটনা কি প্রমাণ করে না যে ধর্ষকেরা ভয় পায়নি। বরং মামলার প্রতিশোধের জন্য আরও বেপরোয়া হয়েছে। হতে পেরেছে, কারণ পুলিশ ছিল উদাসীন, কারণ পুলিশ আসামিদের খুঁজে পাচ্ছিল না। কারণ হয়তো তাদের কানাভোলা রোগ হয়েছিল, কারণ তারা পথ খুঁজে পাচ্ছিল না!

ধর্ষণ শুধু একা পুরুষালি ক্ষমতার কাজ না। এর সঙ্গে লাগে দলের ক্ষমতা বা টাকার ক্ষমতা বা প্রশাসনিক খুঁটির জোর। অভিযুক্ত বাবুলের মা একজন ইউপি সদস্য। ক্ষমতাকাঠামোর তৃণমূল পর্যায়ের খুঁটি ওই পদ। কেন বলছি ক্ষমতার কথা? কারণ, ধর্ষণের মামলা হওয়ার পর থানাসহ এলাকাবাসীর বাবুল মিয়ার বিষয়ে সজাগ থাকার কথা। এ অবস্থায় না পালিয়ে উল্টো পরিবারটিকে হুমকি দিয়ে যাওয়া এবং সেই হুমকি বাস্তবায়ন করতে নির্ভয় থাকার ক্ষমতা লাগে। এলাকায় আসামিপক্ষের দাপটই যদি না থাকবে, তাহলে ধর্ষকের বদলে নির্যাতিতকে পালাতে হলো কেন? তৃতীয়ত, পরিকল্পনা করে আরেক এলাকায় গিয়ে আবারো তুলে এনে আবারও ধর্ষণ করতে, তাকে কুপিয়ে হত্যা করতে লোকবলও লাগে, ক্ষমতার অন্ধ বিকারও লাগে। ক্ষমতার এই বিকারকে শায়েস্তা না করতে পারলে বিউটিরা বাঁচবে না, বাংলাদেশ শান্তি পাবে না।

দেশজুড়ে পাশবিক ক্ষমতামত্ত শেয়ালদের উত্থানের বীভৎস প্রতীক হয়ে থাকবে বাংলাদেশের পতাকার মতো বিউটি আক্তারের লাশের ছবি।

Advertisement