খুলনা ও গাজীপুরের উত্তাপ কিসের পূর্বাভাস?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: শুধু দুটি নগরের বাসিন্দা নয়, সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি এখন গাজীপুর ও খুলনার প্রতি। ১৫ মে এই দুই সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বাদানুবাদ ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলছে। সেই সঙ্গে চলছে প্রার্থীদের পক্ষে জোরদার প্রচারও।

এই ভোট নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য যেমন, তেমনি সরকার, প্রতিদ্বন্দ্বী দল, প্রার্থীদের জন্যও বড় পরীক্ষা। সরকারি দলের নেতারা সব সময় বলেন, নির্বাচন পরিচালনা করে ইসি। এ ব্যাপারে সরকারের কিছু করণীয় নেই। তাঁরা যদি কথাটি মনে রাখেন এবং ইসির কাজে কোনো রকম বাধা না দেন, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। আর যদি আগের ইউপি ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মতো পেশিশক্তি দৌরাত্ম্য দেখায়, তাহলে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়।

এবার গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে প্রার্থী নন, দলের ‘যুদ্ধই’ প্রাধান্য পাবে। তবে দলের মধ্যে যে উপদল থাকে, নানা গ্রুপ থাকে, সেসবও নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করে। প্রথমদিকে নির্বাচনী পরিবেশ কিছুটা নিরুত্তাপ থাকলেও ভোট গ্রহণের তারিখ যত এগিয়ে আসছে, উত্তাপও তত বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার খুলনায় দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিএনপির মেয়র প্রার্থী কয়েক ঘণ্টার জন্য নির্বাচনী প্রচার বন্ধ রেখেছিলেন। তাঁর দাবি, প্রচারকাজে বাধা দিতেই দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে দলের নির্দেশে তিনি নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। বিএনপি নেতাদের দাবি, প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও তাঁরা দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনী লড়াই চালাচ্ছেন। ধারণা করি, শেষ পর্যন্ত বিএনপি লড়াইয়ের মাঠে থাকবে।

এদিকে গাজীপুরে দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ এনেছে। বিএনপির অভিযোগ, গাজীপুরে পুলিশ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারি দলের পক্ষে কাজ করছে। বিএনপির প্রার্থীর প্রচারকাজে বাধা দিচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পাল্টা অভিযোগ, নির্বাচনী প্রচার চালাতে বিএনপি সারা দেশ থেকে সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের গাজীপুরে নিয়ে এসেছে। তারা জঙ্গি হামলা ও নাশকতারও আশঙ্কা করছে। নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা দৌড়ের ওপর আছেন। তারপরও দলের সন্ত্রাসীরা কীভাবে বাইরে থাকে, সেটি মস্ত বড় প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগের অভিযোগ দেখে মনে হয় তারা নয়, বিএনপিই ক্ষমতায় আছে। ২০১৩ সালে যে রাজনৈতিক পরিবেশে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিল, এখনকার নির্বাচনী পরিবেশ তার থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। তখনো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, আর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। পার্থক্য এটুকু যে তখন বিএনপি সংসদে ছিল, এখন সংসদের বাইরে। দলের প্রধান খালেদা জিয়া জেলে।

গাজীপুরে দুই দলই প্রার্থী বদল করেছে। বিএনপি সাবেক মেয়র এম এ মান্নানকে বাদ দিয়ে নিয়েছে হাসান সরকারকে, যিনি একসময় জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন। মান্নান গুরুতর অসুস্থ। তাঁর পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ আজমত উল্লার স্থলে জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে এসেছে। খুলনায় আওয়ামী লীগ সাবেক মেয়র প্রার্থী এম এ খালেককে বদল না করলেও বিএনপি বর্তমান মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের স্থলে সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে এনেছে।

ভোটটি দৃশ্যত খালেক বনাম মঞ্জু কিংবা হাসান বনাম জাহাঙ্গীরের মধ্যে হলেও আসল লড়াইটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিরই। ভোটাররা প্রার্থীর চেয়ে দলের গুণাগুণ বিচার করবেন। এর আগে যে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে একটিতে আওয়ামী লীগ, একটিতে বিএনপি ও একটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়ী হন। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের এক ডজন নেতা গিয়েও দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে পারেননি। সেখানে নির্বাচিত হন বিএনপির মনিরুল হক। রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বিপুল ভোটে হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদকে। আর নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে যে সেলিনা হায়াৎ আইভী জিতেছেন, তাতে দলের চেয়ে ব্যক্তি ইমেজের ভূমিকাই ছিল বেশি। আগেরবার দলের সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে তিনি প্রায় এক লাখ ভোটে হারিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারাও স্বীকার করেছেন, আইভি রাজনীতির মাঠের ম্যারাডোনা। কিন্তু গাজীপুর ও খুলনায় কোনো দলে ম্যারাডোনা নেই।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গাজীপুরে গিয়ে বলেছেন, নির্বাচনী আইন ভাঙলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আগের রাতে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও ব্যালট পেপারে ইচ্ছেমতো সিল মারার দিন শেষ হয়েছে। তবে শুধু মুখের কথায় তো চিড়ে ভিজবে না। নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত সব ব্যক্তি ও সংস্থাকে সততা, সাহস ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অজানা ‘শত্রু’ লেগেছে, যারা দলের সক্রিয় নেতা-কর্মীদের ফোনে বা সামনাসামনি ‘সাবধান’ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এই হুমকিদাতাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা না নিতে পারলে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা ৬ মে খুলনা ও ৭ মে গাজীপুর যাবেন। দেখা যাক, নির্বাচনের পরিবেশ উন্নয়নে তিনি কী পদক্ষেপ নেন।

আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অব্যাহত বাহাসের কারণে দুই সিটিতেই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি প্রায় চাপা পড়ে গেছে। দুই পক্ষের প্রচারে স্থানীয় সমস্যার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ‘জাতীয় রাজনীতি।’ সরকারের পক্ষ থেকে এই ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, ক্ষমতায় থাকবে। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলেই এলাকার উন্নয়ন হবে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য বিএনপির প্রার্থীকে জয়ী করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের নিয়ামক যে দুই সিটি করপোরেশনের মানুষ, তাদের দাবিদাওয়া ও সমস্যা অনেকটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহার হারিয়ে যাবে অসুস্থ ও অসহিষ্ণু রাজনীতির ডামাডোলে।

আমাদের স্থানীয় সরকার বা শাসনের স্বরূপ কী হবে তা সংবিধানে স্পষ্ট করে লেখা আছে। স্থানীয় শাসন স্থানীয়ই হবে। জাতীয় রাজনীতির ছাপ এখানে পড়ার কথা নয়। স্থানীয় রাজনীতি স্থানীয় সমস্যা নিয়েই কথা বলবে। নেতারা যে দলেরই হোন একসঙ্গে কাজ করবেন। কিন্তু অসুস্থ জাতীয় রাজনীতি সেটি সব সময় হতে দেয় না।

সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসন সম্পর্কে বলা আছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। ২. এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইনসাপেক্ষ সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লেখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেই রূপ দায়িত্ব পালন করিবেন এবং অনুরূপ আইন নিম্নলিখিত বিষয়-সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে: ক. প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, খ. জনশৃঙ্খলা, গ. জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।’

এই আলোকে দেখতে গেলে বাংলাদেশে কখনোই স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো সংবিধান অনুযায়ী স্বশাসিত হতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকার এক কণা ক্ষমতাও ছাড়তে চায় না। অথচ বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলে রাজনীতিকেরা মুখে ফেনা তোলেন।

শুরু থেকে যাঁরা খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁদের মতে, তিনটি বিষয় নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এক. প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, দলের জনপ্রিয়তা এবং দলের বাইরের ভোট নিজের পক্ষে নিয়ে আসার দক্ষতা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যতই বাহাদুরি দেখাক, এককভাবে কোনো নির্বাচনে জিততে পারেনি। জিতেছে জোট বেঁধে। তবে প্রকাশ্য জোটের বাইরে নির্দলীয় ভোটার, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মই সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবেন, যদি তাঁরা ভোট দেওয়ার সুযোগটি পান।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

Advertisement