খেলাপি ঋণ তিন লাখ কোটি টাকা

ব্রিট বাংলা ডেস্ক : খেলাপি ঋণ হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় না আনায় দিন দিন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪১৭ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
মঙ্গলবার জুম অনলাইনে টিআইবি পরিচালিত ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান ধারা বিশ্লেষণের পাশাপাশি খেলাপি ঋণ তদারকিতে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকাঠামো এবং নেতৃত্বের দুর্বলতার নানা দিক তুলে ধরা হয়।
সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনসহ ১০টি সুপারিশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানতের সুরক্ষা দেওয়া। প্রতিষ্ঠানটি লুটপাটকারী ও সরকারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তথাকথিত ব্যাংক মালিক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার এই তিন পক্ষই জনগণের আমানতের কথা ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী ও ঋণখেলাপিদের সুযোগ করে দিচ্ছে। সরকার অনেক সময় ঋণখেলাপি, অর্থ আত্মসাৎকারী ও জালিয়াতদের সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করছে। অনেক সময় মনে হচ্ছে সরকার তাদের কাছে জিম্মি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন ও নীতিমালা এমনিতেই দুর্বল। সরকার আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯-২০১১ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণের হার পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে বৃদ্ধি ৪১৭ শতাংশ। এ সময়ে প্রতিবছর গড়ে ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টিআইবি বলছে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।
বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কার্যকর না করে বারবার ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে মনে করছে টিআইবি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনায় খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃ তফসিলীকরণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এভাবে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
টিআইবির প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা; ব্যাংক কম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করা; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করা; ব্যাংকসংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সকল ধারা সংশোধন কিংবা বাতিল করা; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি; আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ প্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিধান প্রণয়ন করা; বারবার পুনঃ তফসিল করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করা; ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগগুলোর শূন্যপদসমূহ অবিলম্বে পূরণ; পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং পরিদর্শনে তাত্ক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শকদলকে দেওয়া এবং তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

Advertisement