চালাও গাড়ি সৌদি নারী

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ২৪ জুন ২০১৮। এই দিনে সৌদি আরবের নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার আদায়ের ৩০ বছরের সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ৩০ বছরের নিষেধাজ্ঞাকে পেছনে ফেলে সেদিন থেকে গাড়ির চালকের আসনে বসেছেন রক্ষণশীল সৌদি আরবের নারীরা। এই দীর্ঘ আন্দোলনকে একটি লড়াই বললেও বোধ করি ভুল হবে না। এই লড়াই ছিল সৌদি আরবের নারীদের অধিকার আদায়ের লড়াই, নিজেদের মর্যাদা রক্ষার লড়াই, অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই।

এই লড়াইয়ে প্রায় পুরোটা সময় নারীদের সহযাত্রী ছিলেন শুধু নারীরাই। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ প্রথম ইসলামিক আইন মেনে নারীদের গাড়ি চালনার অনুমতি দেওয়া হবে বলে একটি আদেশপত্র স্বাক্ষর করেন। তারই ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবের নারীদের জাতীয় ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। উল্লেখ্য, এত দিন সৌদি আরবের নারীরা যুক্তরাজ্য, কানাডা, লেবাননসহ অন্য দেশের লাইসেন্স নিতেন। তবে দেশেও তাঁদের সংক্ষিপ্ত গাড়ি চালানোর পরীক্ষা দিতে হতো। ২৪ জুনের আগ পর্যন্ত সৌদি আরব ছিল পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি ছিল না। ১৯৯০ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার চেয়ে শুরু হওয়া আন্দোলনে রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিভিন্ন সময়ে নারীরা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, এমনকি কারাবরণ করেছেন। সৌদি আরবের মতো একটি দেশে নারীদের এ ধরনের সাহসিকতা অনেকটাই অচিন্তনীয় একটি ব্যাপার।

নারীদের এই ঐতিহাসিক বিজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বয়সে মাত্র ত্রিশের কোটা পেরোনো সংস্কারপন্থী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এ নিয়ে কম বিপত্তি পোহাতে হয়নি। গাড়ি চালানোকে ইসলামের পর্দাপ্রথার লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করা থেকে শুরু করে গাড়ি চালালে মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হওয়ার কথাও বলা হয়েছে। অবশেষে সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে করে ২৪ জুন আসে সেই প্রতীক্ষিত দিন। সেদিন সৌদি আরবের নারীরা চালকের আসনে বসে স্টিয়ারিং হাতে তুলে নেন। মরচে পড়া অচল পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাঁরা সচল করেন গাড়ির চাকা। বস্তুতপক্ষে,ÿএই চাকা হলো প্রগতির চাকা, যার নেতৃত্ব হয়তো দিতে চলেছেন সৌদি আরবের নারীরা। এই চাকা তার নির্ধারিত গতিতে চললে অদূর ভবিষ্যতে সৌদি আরবের অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন সে দেশের নারীরা। কারণ, সেই সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে।

সৌদি আরবে নারীদের ওপর বিশ্বের সবচেয়ে কঠিনতম কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেসব নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা শুরু করেছে দেশটি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ তেলের ওপর নির্ভরশীল এই দেশে জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বয়সই ৩০ বছরের নিচে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে ২০১৪ সালে মারাত্মকভাবে কমে যায় তেলের দাম, যার ধাক্কা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। একদিকে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ আর অন্যদিকে তেলের মূল্যপতনের বিষয়টি অর্থনীতি নিয়ে নতুনভাবে শঙ্কিত করে তুলেছে দেশটির শাসকদের। ২০১৭ সালে সৌদি আরবে ঘোষিত হয়েছে ভিশন-২০৩০। সেখানে নারীদের বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে সৌদি আরবের নারীরা পুরুষদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষিত ও পরিশ্রমী। এ ছাড়া নার্সিং কিংবা ড্রাইভিংয়ের মতো পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার বেলায় তাঁদের নেই তেমন কোনো রক্ষণশীলতা। তাই নারীদের গুরুত্বপূর্ণ জনশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা সৌদি আরবের অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। আর এ ক্ষেত্রে প্রথম ধাপটি ছিল নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে গাড়ির চালক হিসেবে তাঁদের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি; কারণ সৌদি আরবের মোট জনশক্তির ২০ শতাংশ নারী। সৌদি আরবের উষ্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, শহরের বিভিন্ন স্থানের মধ্যে দূরত্ব, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা ইত্যাদি কারণে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া এমনিতেই যথেষ্ট কঠিন। তার ওপর নিজের পরিবারের পুরুষ সদস্য ভিন্ন অন্য কোনো পুরুষ চালকের গাড়িতে ওঠার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ নারীকে বাধ্য করেছে কর্মস্থল থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সৌদি আরবের মোট জনশক্তির ৬০ শতাংশই অভিবাসী। তাই সৌদি জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, অর্থাৎ নারীদের শ্রমবাজার ধরতে গেলে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের হয়তো কোনো বিকল্প ছিল না।

কার্যকারণ যা-ই হোক না কেন, আমরা সাধুবাদ জানাই সৌদি আরবের এই সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তকে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই সৌদি আরবের নারীদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটেছে। এই সিদ্ধান্ত আরেকটি বিষয়ে আশাবাদী করে; এর ফলে হয়তো সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীদের জন্য হয়তো ড্রাইভিং পেশায় যোগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। সেখানে রোজ নির্যাতিত হয়ে চোখের পানির বানে ভেসে যাওয়ার চেয়ে হয়তো সেটা ভালো।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক

Advertisement