এই কবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক বিশ্বব্যাপী। প্যাট্রিয়টের সঙ্গে বহু বরেণ্য রাজনীতিকের মিল খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে। তবে এর ঠিক উল্টোও যে হতে পারে কখনো, তার এক আশ্চর্য উপাখ্যান আমরা দেখলাম সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষের ছাত্রীদের নিপীড়নকারী হিসেবে নিন্দিত একজন ছাত্রলীগ নেত্রীকে (ইফফাত জাহান) মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে প্রবল বরেণ্য হয়ে উঠতে দেখি আমরা এতে। জুতার মালা, গণধাওয়া এবং বহিষ্কারে বহিষ্কারে জর্জরিত ছিলেন তিনি। আশ্চর্য দ্রুততায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁরই গলায় ওঠে ভারী ভারী গাদা ফুলের মালা। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এমনকি তাঁর সম্পর্কে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হয়ে ওঠেন দিন কয়েক আগের তাঁর শাস্তিদাতারা।
২.
ইফফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের, আরও গুরুতর অভিযোগ ছিল আন্দোলনপক্ষের একজন ছাত্রলীগ নেত্রী মোর্শেদা খানমের পায়ের রগ কেটে ফেলার। এসব অভিযোগের কোনো সুষ্ঠু তদন্ত না করেই ইফফাতকে প্রথমে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ, এর কয়েক ঘণ্টা পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বহিষ্কারের পরদিন ছাত্রলীগ একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। কমিটি মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট জমা দেয়, ২৪ ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই তারা ইফফাতের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটিও করেনি। ছাত্রলীগ ইফফাতের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পরপরই উপাচার্য নিজেই টেলিভিশনে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হবে বলে ঘোষণা দেন।
ইফফাতের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অবস্থান সম্পর্কে আমি তেমন বিস্মিত নই। ইফফাত বা তাঁর মতো ছাত্রলীগের বহু নেতা-কর্মী বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে ব্যবহৃত হন। তাঁদের নিয়ন্ত্রণের আসল সুতো অন্য জায়গায়। ছাত্রলীগের (বা বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ছাত্রদলের) এসব সুতোর মালিকেরা মূলত তাঁদের ক্ষমতার পাহারাদার হিসেবে ব্যবহার করেন ছাত্রসংগঠনটিকে। ‘সরকারি ছাত্রসংগঠনের’ তাই মূল কাজই হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে সরকারবিরোধী কোনো দলকে (যেমন বর্তমানে ছাত্রদল) বা আন্দোলনকে (যেমন বর্তমান রামপালবিরোধী বা ডাকসুর পক্ষের আন্দোলন) বাধা দেওয়া এবং সরকারের গুণগানে শিক্ষাঙ্গন ও রাজপথ মুখর করা। ছাত্রাবাসগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে নিজেদের পক্ষভুক্ত করা এবং অবাধ্য বা প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এখানে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইফফাত তাই অভিযোগকারীদের বক্তব্য অনুসারে একজন নির্যাতক হলে তাঁর পক্ষেই দাঁড়ানোর কথা ছাত্রলীগের। কোটাব্যবস্থা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে তারা ইফফাতের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা হয়তো ছিল স্রেফ পরিস্থিতির চাপে। এ ধরনের চাপ না থাকলে বা চাপ কমে গেলে ইফফাত যে রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করেন, তাতে তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে আবারও বরণ করে নেওয়াই স্বাভাবিক ছাত্রলীগের জন্য।
৩.
আমার প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিয়ে। তাদের সমস্যা কোথায়? তারাও কি হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির পুরোপুরি ক্রীড়নক? এত বড় প্রশ্ন উত্থাপনের কারণ হিসেবে আগে কোটাব্যবস্থা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন ইন্টারনেটে বহুল প্রচারিত একটি ভিডিওর বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি।
এই ভিডিওতে ইফফাতকে বহিষ্কার করার কিছুক্ষণ পর আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এর প্রক্টরকে বলতে শুনি: ‘যিনি আঘাত করেছে তার নাম হলো ইফফাত জাহান, এ রকম একটি নাম। তখন আমরা এসে তার, আমি তার মুখ থেকেই শুনেছি, সে নিজেও ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। তখন আমি বুঝতে পেরেছি যে এই অপরাধটি এখানে সংঘটিত হয়েছে।’ এর পরপরই উপাচার্যের বক্তব্য: ‘তাকে (অভিযোগকারীকে) আহত করেছে, ফিজিক্যালি। শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। তো এটি জানার পরে আমি দুই দিক থেকে এটা ভেরিফাই করলাম। প্রক্টর সাহেবও আমাকে এই কথা বললেন, হল প্রশাসনও বললেন। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই মেয়ে (ইফফাত) যেহেতু শারীরিকভাবে আরেকজনকে লাঞ্ছিত করেছে, আহত করেছে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলো।’
কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পর ইফফাত সম্পর্কে একই উপাচার্যের বক্তব্য: ‘সে শুধু ছাত্রত্ব ফিরে পাবে না, বরং সম্মানিত হবে। এবং সেটি উচিত হবে। কারণ, আমরা তো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করতে পারি না।’ উপাচার্যের এমন অকল্পনীয়ভাবে উল্টো দিকে ঘুরে যাওয়ার কারণ কী? ভিডিও দেখে যা বোঝা যায়, উপাচার্যকে অভিযোগকারী জানিয়েছেন যে তিনি আসলে নিজেই দরজায় পা দিয়ে আঘাত করেছেন বলে রক্তপাত হয়েছিল তাঁর।
উপাচার্যের বক্তব্য শুনলে এটি পরিষ্কার যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ইফফাত নিজেই প্রক্টরের কাছে দোষ স্বীকার করেছিলেন বলে তিনি জানান) ও সুফিয়া কামাল হলের প্রশাসনের যাচাই করা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি ইফফাতকে বহিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি সম্ভবত একজন ভিকটিমের (মোর্শেদা) কথা শুনে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেন।
ইফফাত আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তাঁকে অন্যায় শাস্তি দেওয়া হোক, তা আমরা চাইতে পারি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো: ইফফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত না করে কেন তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, কেনই বা আরও প্রশ্নবিদ্ধভাবে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলো? তাঁর বিরুদ্ধে শুধু একজনের পা কাটার অভিযোগ ছিল না, ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন ও হুমকির অভিযোগ। ছিল আরও আগে থেকে ছাত্রীদের নিপীড়ন করার অভিযোগও।
উপাচার্য তাহলে শুধু মোর্শেদার বক্তব্য শুনে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেন কীভাবে? আমার মনে হয়েছে, উপাচার্য বহিষ্কার এবং তা প্রত্যাহার দুটি ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের ইচ্ছার অনুসরণকারী হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে তাঁর যে নিরপেক্ষতা, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্ব দেখানোর কথা, তা সম্ভবত এ ক্ষেত্রে তিনি মনে রাখেননি।
উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে ন্যক্কারজনক কাজটি করেছে ছাত্রলীগকে তৃতীয়বার অনুসরণ করতে গিয়ে। ইফফাতের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর ছাত্রলীগ থেকে অভিযোগকারী ও তাঁর প্রতিপক্ষ ২৪ জন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার মাত্র এক দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মূলত সেই ২৪ জনকে (মোট ২৬ জন) বহিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এক গোপন তদন্তের ভিত্তিতে। এই তদন্ত কমিটি কবে গঠন করা হলো, কারা এর সদস্য, এটুকু জানানোর সৎসাহস পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেনি এখনো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন গোপন ও অস্বচ্ছ তদন্তের নজির আছে বলে আমার জানা নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা, জুতার মালা দিয়ে লাঞ্ছিত করা-এ রকম বহু কিছু হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক হিসেবে উপাচার্য বা অন্য কোনো দায়িত্বশীল শিক্ষক এ রকম ঘটনার পক্ষ হতে পারেন না। উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধানতম দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের (শিক্ষাঙ্গনে ও ছাত্রাবাসে) নিরাপত্তা বিধান করা এবং তাঁদের সম্মান রক্ষা করা। কোনো আন্দোলন বা বিরোধে তাঁদের ভূমিকা অস্বচ্ছ, প্রশ্নবিদ্ধ ও ভঙ্গুর হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের কাছে উপাচার্যকেই বরং ভীতিকর একজন মানুষ মনে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, বিশেষ করে শিক্ষক সমিতিকে এর প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা এটি করতে ব্যর্থ হলে আমাদেরও লজ্জিত হওয়া উচিত।