‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়’ ধর্ষণকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে?

:: মালবী গুপ্ত ::

‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, বা ‘নিউ ইন্ডিয়া’ শব্দবন্ধগুলি শুনলেই কেন জানি মনে হয়, আমরা ভারতীয়রা ক্রমেই বেশ উন্নত, আধুনিক এক ভারতের নাগরিক হয়ে উঠছি – যেখানে দেশের প্রতিটি পঞ্চায়েতে একটি করে গ্রামকে হাইস্পিড ইন্টারনেটের মাধ্যমে জোড়ার কথা।

কথা, নানা সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করা, গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজকে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি-জ্ঞান নির্ভর আধুনিক সমাজে রূপান্তরিত করা।

অর্থাৎ প্রযুক্তির মাধ্যমে সমস্ত তথ্য সর্বত্র ছড়িয়ে মানুষের ডিজিটালি ক্ষমতায়ন ঘটানো। এবং সরকারের লক্ষ্যও ভারতীয় সমাজকে ‘ডিজিটালি এম্পাওয়ার্ড সোসাইটি’ তে উন্নীত করা ।

শুনতে ভাল লাগছে। ভাল লাগছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ২০২২ এর মধ্যে সমস্ত গরিবদের পাকা বাড়ি, চাষিদের দ্বিগুণ আয়, বিদ্যুৎ সংযোগ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা পরিষেবা, যুব ও নারীদের জন্যও নানা সুযোগ তৈরির পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, বর্ণবৈষম্যমুক্ত, আতঙ্কবাদমুক্ত এক ‘নিউ ইন্ডিয়া’ বা নতুন ভারত গড়ার স্বপ্নের কথা শুনেও।

নাহ্, সেই স্বপ্নে নারী ও শিশুকন্যা নির্যাতনমুক্ত ভারতের কথা স্থান পায়নি। পেলে অবশ্য সেই স্বপ্নের দ্যোতনা হতো ভারতের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠা।

আসলে ভারতে প্রতিবছরই হাজার হাজার নারী ও কন্যা শিশু ভয়ঙ্কর হিংসার শিকার হচ্ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও বলছে, গত চার বছরে সেই হিংসা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ।

তাই প্রশ্ন জাগছে, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ + ‘নিউ ইন্ডিয়া’ = উন্নত ভারত কি? যদি তাই হয়, তাহলে কিছু অনিবার্য প্রশ্নও এসে পড়ছে।

যেমন, এই ‘অর্ধেক আকাশ’র সুরক্ষা, তার অধিকারগুলি কি সেই ইন্ডিয়ায় সুনিশ্চিত হবে? ডিজিটাল ইন্ডিয়া কি আসমুদ্র হিমাচলে, সামগ্রিক ভাবে আধুনিক ভারতের মুখ হয়ে উঠতে পারবে?

না কি আজও একই ভারতের মধ্যে যে কুসংস্কার ও বহুবিধ বর্বরতায় দীর্ণ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের বসবাস, তার বহমানতাকে অটুট রেখেই মাত্র কিয়দংশের ওপর ‘নিউ ইন্ডিয়া’র সিলমোহর লাগাবে?

তা নাহলে এই ২০১৮তে পৌঁছেও কেন দেখতে হচ্ছে, যে আচরণের জন্য লজ্জায় অধোবদন থাকার কথা, যে অপরাধের জন্য তার হাজতবাসের কথা, সেই অপরাধই তাকে বর বেশে ছাদনাতলায় দাঁড়ানোর ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছে?

ভারতের একটি হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকেও বলতে শোনা গেছে,’ধর্ষণকারীর উচিত ধর্ষিতাকে বিয়ে করে নেওয়া।’
কেন একজন ধর্ষিতাকে বরমাল্য পরিয়ে দিতে হচ্ছে তারই ধর্ষণকারীর গলায়? এমন বিকৃতি এমন নিষ্ঠুরতায় শুধু সামাজিক সায় নয়, সমাজকেই যে সেখানে অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি।

তা নাহলে দেশে হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকেও কেন বলতে শুনছি, ‘ধর্ষণকারীর উচিত ধর্ষিতাকে বিয়ে করে নেওয়া।’

যেখানে শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিরই এই মানসিকতা, সেখানে দরিদ্র প্রায়-নিরক্ষর পরিবারগুলি একঘরে হওয়ার হুমকিতে, কখনো বা গোষ্ঠীর সম্মান রক্ষার ভয়ঙ্কর দায় ওই কচি মাথাগুলির ওপর চাপিয়ে দিতেই বাধ্য হচ্ছে।

এবং ধর্ষণকারীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার পঞ্চায়েতের নিষ্ঠুরতম নিদানকে মান্যতা দিতে গিয়ে নিজেদের ধর্ষিতা কন্যাকে তাঁরা নিজেরাই আবারও হিংসার শিকার করে ফেলছেন। তারই অত্যাচারীর সঙ্গে তাকে সারা জীবনের মতো জুড়ে দিয়ে তার সমস্ত অধিকারকেই ছিনিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা।

আর সেই অসহায় মেয়েদের রেপিস্টকেই শেষপর্যন্ত স্বামীর মর্যাদা দিতে হচ্ছে? হায় কন্যা জন্ম! হায় আমাদের সমাজ মন!

তবে শুধু আমাদের সমাজেই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশসহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশেই মেয়েদের সঙ্গে এই চরম নিষ্ঠুরতা স্মরণাতীত কাল ধরে চলে আসছে।

আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও দেখছি ধর্ষকেরা আইনের সাজা থেকে অনায়াসেই মুক্তি পায়, যদি তার ধর্ষিতাকেই সে বিয়ে করতে ‘রাজী’ হয়ে যায়। জানতে পারছি শুধু এই ভাবেই জর্ডনে ২০১০-২০১৩ এর মধ্যে ১৫৯ জন রেপিস্ট ছাড়া পেয়ে গেছে। ( আরও জানতে এখানে ক্লিক করুন )

জর্ডানের মত লেবাননেও ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়ার প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অবশ্য বিগত কয়েক বছরে সমাজকর্মী ও নারী-সংগঠনের তীব্র প্রচার আন্দোলনের চাপে এ ধরণের আইন বাতিল হতে চলেছে জর্ডন, লেবানন, বাহরাইন ইত্যাদির মতো দেশগুলিতে। কিন্তু ভারতে বোধহয় এখনও সে সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

কারণ গত বছরই উত্তর প্রদেশে বেরিলি’র ১৪ বছরের সেই কন্যাটির কথা মনে পড়ছে।

ধর্ষণের ফলে যার গর্ভসঞ্চার ঘটার ২০ সপ্তাহ পর বিষয়টি জানাজানি হয়। ভারতে ২০ সপ্তাহের পর গর্ভপাত আইনত নিষিদ্ধ হওয়ায় আদালত তাকে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়নি।

সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে গরিব বাবা-মা’ও সেই ধর্ষিতা ও তার সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। পাড়া-প্রতিবেশীর চাপে নিজের ধর্ষণকারীকেই শেষ পর্যন্ত অসহায় মেয়েটি বিয়ে করতে বাধ্য হয়।

আর সম্প্রতি ১৫ বছরের কন্যা তার ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে কেস করলেও সেই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার সাত দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়ে দেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি – এই বলে যে ধর্ষণকারী তার ধর্ষিতাকে ‘বিয়ে করবে’ এবং ‘সুখে রাখবে’!

কিন্তু প্রশ্ন হলো বিয়ের পরেই সেই ধর্ষিতা কন্যাটির উপর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নির্মম অত্যাচার শুরু হলে, মেয়েটির ধর্ষণকারী স্বামীর ‘জামিন’ বাতিলের আবেদন কেন আদালত আর গ্রাহ্য করে না? প্রশ্ন, আইনত নিষিদ্ধ হলেও বালিকা-বিবাহই বা আদালতের সমর্থন পেয়ে যায় কীভাবে?

আসলে শিক্ষা-স্বাবলম্বন নয়, বিয়েই মেয়েদের একমাত্র পরিণতি; ধর্ষিতারও ‘কলঙ্ক’ মোচনের একমাত্র উপায় মনে করা হয়, সেই বিয়ে ধর্ষণকারীকে হলেও।

কেউ ভাবেন না, চরম নির্যাতন ও অপমানে বিক্ষত একটি মেয়ে কীভাবে তার ধর্ষণকারীকেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে? কীভাবে তার সঙ্গে আজীবন ‘সুখে’ কাটাবে?

তাই মনে হচ্ছে, মানুষের মৌলিক অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, আইনি সুরক্ষার বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে ইনফরমেশন এবং সেই সব পরিষেবা কি নাগরিকদের নাগালের মধ্যে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে ডিজিটাল ইন্ডিয়া?

ওই সোসাইটি কি প্রতিরোধ করতে পারবে ভারতে ক্রমবর্ধমান নারী ও শিশুর প্রতি বীভৎস হিংসাকে? তাদের প্রতি সনাতনী সমাজের মনোভাব বদলাতে সাহায্য করতে পারবে কি?

তা না পারলে তো দেশের মাত্র ছোট্ট ভগ্নাংশই হয়তো ‘নিউ ইন্ডিয়া’র উঠোনে পা রাখতে পারবে। আর তার দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে বৃহত্তর ভারতের পরিম্লান ‘অর্ধেক আকাশ’ ।

Advertisement