:: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী ::
একবার এক ছেলে মাকে বললো, মা তুমিতো আমার জন্য অনেক করলে এখন থেকে আমি তোমার জন্য করবো। তুমি আমাকে যেভাবে মায়া মমতা দিয়ে লালন পালন করেছো আমিও তোমার জন্য ঠিক সেভাবে তোমাকে লালন পালন করবো। মা বললো, তুই কি পারবি? ছেলে বললো, মা আমি তোমার জন্য সব কিছু করতে পারি। তুমি পরীক্ষা করে দেখো। মা বললো, আচ্ছা দেখবো। রাতে ঘুমানোর আগে মা ছেলের বুকে একটা পাকা কলা দিয়ে বললো, সাবধানে ঘুমিও। কলাটা যেন বুকের উপর থেকে পড়ে না যায়। ছেলে বললো, ঠিক আছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মা ছেলেকে ডেকে বললো, কিরে কলাটা কোথায়? ছেলে মাথা নিচু করে বললো, মা ঘুমের ঘুরে কলাটা আমার পিঠের নিচে পড়ে চেপ্টা হরে গেছে। মা হেসে বললো, আরে খোকা তুই আমাকে বলেছিলে আমি যেভাবে তোকে লালন পালন করেছিলাম তুই ঠিক সেভাবে করবি। তুই কি জানিস শিশু কালে তুই আমার বুকের উপর ঘুমাতে। আর তোকে বুকে নিয়ে কত নিদ্রাহীনরাত কাটিয়েছি? অনেক সময় ঘুম আসলেও ঘুমাইনি, আমার ঘুমের ঘোরে যদি পড়ে গিয়ে তুই ব্যাথা পেয়ে যাস। অথবা তোর যদি আবার ঘুম ভেঙে যায়। তুইতো একটা কলা বুকে নিয়ে একটা রাত কাটাতে পারলেনা। ছেলের দুচোখ বেয়ে তখন অশ্রুধারা এবং বাকরুদ্ধ। মুখ দিয়ে কোন কথা আসেনা। চাপা কণ্ঠে বললো, মাগো – তোমার ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়।
উপরের গল্পটি মনে হলো এই করোনা ভাইরাসের সময়ে আজকের দিনে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনায় –করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গোটা ভারত যখন লকডাউনে, তখন অসুস্থ ছেলেকে দেখতে ২ হাজার ৭০০কিলোমিটার পাড়ি দিলেন এক মা। পঞ্চাশ বছর বয়সী মা সিলাম্মাভাসান ভারতের কেরালা রাজ্য থেকে ১১ এপ্রিল রওনা দেন। তিনি তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্য ঘুরে ১৪ এপ্রিল রাজস্থানে অসুস্থ ছেলের কাছে পৌঁছান। করোনা ভাইরাস কিংবা কবিড –১৯, কিছুই মায়ের ভালোবাসাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শুধু মায়ের কথা বললে ভুল হবে, বাবার স্নেহও কিন্তু কম নয়। আজকের দিনের একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ছিলো, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। বাবার প্রিয় সন্তান মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, জরুরীভাবে ঢাকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। হাসপাতালের বাইরে এম্বুলেন্স পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য স্ট্রেচার প্রয়োজন, করোনা আক্রান্তের ভয়ে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয় কেউ এগিয়ে আসলেন না, যদি তারাও সংক্রমিত হন। বুকের ধনকে বাঁচাবার জন্য বাবা নিজে সন্তানকে কোলে নিয়ে এম্বুলেন্স পর্যন্ত আনলেন। ছবিগুলো দেখে আর ঘটনার বিস্তারিত জেনে কিছুক্ষণ স্তব্ধহয়ে গিয়েছিলাম, মনের অজান্তেই দুই চোখের অশ্রু সম্বরণ করতে পারলাম না। মা অথবা বাবারা হারতে জানেনা, প্রিয় সন্তানদের জন্য শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত থাকেন।
আর করোনা ভাইরাসের সময় ঘটে যাওয়া একটি উল্টো ঘটনা – গত ১৩ই এপ্রিলে বাংলাদেশের খবরের শিরোনাম ছিলো করোনা সন্দেহে বৃদ্ধা মাকে সখিপুরের এক জঙ্গলে ফেলে যায় তার সন্তানরা। মায়ের ছিল শুধু সর্দি– কাশি এবং হালকা জ্বর ৷ তার জন্য চিকিৎসা করানো তো দূর ৷ করোনা সন্দেহে বৃদ্ধা মা–কে জঙ্গলে রেখে চলে যায় তার ছেলে, দুই মেয়ে এবং জামাই৷ ডাক্তার দেখানোর নাম করেই রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের শখীপুর জঙ্গলে নিয়ে যায়। মধ্যরাতে জঙ্গলের ভিতরে যাওয়ার পর মাকে বলে, “মা, তুমি এই বনে একরাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব” এই কথা বলেই বৃদ্ধাকে জঙ্গলের ভিতরে রেখে পালিয়ে যায় তাঁর ছেলেমেয়েরা ৷ গভীর রাতে বৃদ্ধার কান্না শুনে স্থানীয় মানুষ প্রশাসনকে খবর দেন। রাত দেড়টা নাগাদ তাঁকে উদ্ধার করা হয়। যদি গ্রামবাসী সময়মতো এগিয়ে না আসতো তাহলে ঐ রাতে মা–কে শেয়াল কুকুর খেয়ে ফেলতো। করোনার উপসর্গ থাকায় অ্যাম্বুল্যান্সে করে পাঠানো হয় ঢাকার কুয়েতসমৈত্রী হাসপাতালে। কিন্তু ১৭ই এপ্রিল টেস্ট করার পর জানা যায় ঐমায়ের করোনা ছিলো না।
প্রিয় পাঠক একবার দুচোখ বন্ধ করে ভাবুন, এই ছেলের জন্মের পর সেই মা কেমন গর্ববোধ করেছিলো। আর এই ঘটনার পর সন্তানের প্রতি ঐ মায়ের অনুভুতিটা কেমন ছিলো। চিন্তা করেন, ঠিক কি পরিমান পাষান্ড এবং নির্মম হলে এরকম একটি জঘন্য কাজ সন্তানরা করতে পারে। যে মা গর্ভ ধারণ করে, বুকের দুধ পান করে সন্তানদের লালন পালন করে আর সেই মাকে কিনা গভীর রাতে জঙ্গলে ফেলে যায় তারই সন্তান। ভাবতে অবাক লাগে মানুষের মানুষত্ববোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে।
তবে সখিপুরের ঐ মায়ের কু–সন্তান কিন্তু সব মায়ের কপালে নেই। যেমন রোহিঙ্গারা দলে দলে যখন বাংলাদেশে আসছিলো তখন দেখেছি সন্তানরা মাকে ঝুড়িতে তুলে মাথায় নিয়ে পায়ে হেটে এসেছে মাইলের পর মাইল। বেশ কিছুদিন আগে হানিফ সংকেতের একটি অনুষ্টানে দেখেছি বাংলাদেশে এক ছেলে টাকার অভাবে প্রতি মাসে মাকে মাথায় নিয়ে ডাক্তার দেখতে কুড়ি মাইলের উপর পায়ে হেটে যায়। এরকম ঘটনা অজস্র।
করোনা বিশ্বে আজ সবচেয়ে বেশি অসহায় আমাদের বৃদ্ধ কমিউনিটি। আক্রান্ত কিংবা মৃত দুটো দিকেই তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ব্রিটেনে বর্তমানে আমরা একটি ভলান্টারি নেটওয়ার্ক করেছি আর এই সুবাধে অসংখ্য মানুষের সাথে কথা হয়। এই বয়স্ক কমিউনিটির অনেকেই অসহায় দিন যাপন করছেন। অনেকে ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না কিংবা বের হতে সাহস করতে পারছেন না। তারা যে সমস্যাগুলো মোকাবেলা করছেন তার মধ্যে ফার্মেসি থেকে ঔষধ আনা, ঘরের বাজার খরচ করা কিংবা জরুরি চিঠি পোস্ট করা। আমরা ইচ্ছে করলে এই ছোট ছোট কাজ তাদের জন্য করতে পারি। এমনকি কিছু না করতে পারলে দয়া করে অন্তত একটি টেলিফোন করে খোঁজ খবর নেন এবং তাদের সাহস এবং মনোবল দেন। তাই আমি সবাইকে অনুরোধ করবো বাঙালি কিংবা নন বাঙালি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আসুন এই জাতীয় দুর্যোগে তাদের প্রতি আরেকটু সদয় হই। আমাদের মা–বাবা এবং এইবয়স্ক কমিউনিটির পাশে দাঁড়াই।
পরিশেষে সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন এবং নিরাপদে থাকবেন।
লেখক: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
কলামিস্ট, কন্ট্রিবিউটর ব্রিট বাংলা২৪ কম এবং প্রিন্সিপাল সলিসিটার, কেসি সলিসিটর্স ইউকে।