দুঃখে ভরা মিরসরাই ট্র্যাজেডির ১১ বছর

শোকাবহ মিরসরাই ট্র্যাজেডির আজ ১১ বছর। ২০১১ সালের ১১ জুলাই মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ শিক্ষার্থীসহ ৪৫ জন নিহত হয়। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে এলেই আঁতকে ওঠেন নিহতদের স্বজনরা। এখনো যাওয়া-আসার পথে দুর্ঘটনাস্থলে থমকে দাঁড়ায় পথিক। প্রতিবছরের মতো এবারও নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি।এ ১১ বছরকে ১১ দিনের চেয়েও কম মনে হয় সন্তান হারানো মা কোহিনুর বেগমের। তিনি মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহত রায়হান উদ্দিনের মা। কোহিনুর বলেন, আমার এখনো বিশ্বাস হয় না আমার ছেলে নেই। এইতো সেদিন রায়হান খেলা দেখতে বের হয়েছিল।মায়ের চাপা কান্নাকে উসকে দিতে বছর ঘুরে আবারও বেদনা হয়ে ফিরেছে ১১ জুলাই। দিনটির কথা মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তান হারানো মায়েরা। এ কান্নার শেষ কোথায় জানে না কেউই।কোহিনুর বেগম জানান, ২০১১ সালে তার ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। সে হিসেবে এতদিনে তার ছেলের স্নাতক পাস করার কথা।

প্রতিবছর ১১ জুলাই এলে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন নিহতদের পরিবার, স্বজন, স্কুল শিক্ষক তথা সমগ্র মিরসরাই। হারানো সন্তানদের ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে বাবা-মায়েদের কাঁদতে দেখা যায় এইদিনে। কারও আবার চোখের পানি ঝরতে ঝরতে এখন হয়ে গেছেন শুকনা পাথর। চাইলেও কাঁদতে পারেন না এখন তারা।কথা হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডি থেকে বেঁচে ফেরা তৎকালীন নবম শ্রেণির ছাত্র সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা খেলায় জেতার খুশিতে এতটাই বিমোহিত ছিলাম যে কখন রাস্তার পাশে খাদের পানিতে পড়ে ট্রাক চাপা পড়েছি কিছুই বলতে পারবো না। শুধু দেখছিলাম চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে হাত পা ছুঁড়তে থাকি। আমার মতো অন্যরাও চেষ্টা করেছে। একটা সময় আমি বের হতে পারি। অন্যরা পানির ভেতর থেকে টানাটানি করে আমার হাত পা নখ দিয়ে কেটে ফেলেছিল।

তিনি আরও বলেন, যখন আমি পানি থেকে উঠে উপরে আসি, তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি বেঁচে আছি। আমার হাত-পা নিথর হয়ে যায়। সে মুহূর্তের পর আর কিছুই আমার মনে নেই। আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপরই আমি অসুস্থ হয়ে যাই। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি। আমি বেঁচে ফিরেছি, অন্যরা মারা গেছে এটা মনে হতেই আমার খুব কষ্ট হয়।ভয়াল মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহত হওয়া অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আমিন শরীফের বাবা শাহজাহান বলেন, আমার ছেলে যখন মারা যায় আমি তখন বিদেশে ছিলাম। শেষ সময়ে ছেলেটাকে আমি দেখিনি। এর চেয়ে কষ্টের আমার কাছে আর কিছুই নেই।তিনি আরও বলেন, আমার ছেলেসহ ৪৫ জন যেখানে নিহত হয়েছে সেখানে পরবর্তীকালে অন্তিম নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যখনই ইকোনোমিক জোনের রোড দিয়ে যাতায়াত করি, সে অন্তিমটা নজরে পড়ে। কষ্টে তখন বুকটা ফেটে যেতে চায়।

নিহত ছাত্রদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। যার নির্মাতা নিজাম মিস্ত্রি। তার ছেলেও নিহত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে। বুকের কষ্ট বুকে চেপে পরম ভালোবাসায় নির্মাণ করেছেন স্মৃতিস্তম্ভ আবেগ। নির্মাণের পর আবেগে সাঁটানো নিহত ছেলের ছবিতে হাত বুলিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন নিজাম মিস্ত্রি। তিনি বলেন, আমার ছেলে মারা যায়নি। সে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকবে মানুষের আবেগ হয়ে।কথা হয় নিহত ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম মেধাবী ছাত্র ধ্রুব নাথ জয়ের মা আবুতোরাব ভূঁইয়া একাডেমির শিক্ষিকা সুপ্রীতি রানীর সঙ্গে। তিনি জানান, এই ১১ বছরে একদিনের জন্যও ভুলে থাকতে পারেননি ধ্রুবকে। প্রতিদিনই আশায় থাকেন তার ছেলে ফিরে আসবে কোনো না কোনো দিন।আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রথম প্রথম কয়েক বছর নিহতদের স্মরণে আনুষ্ঠানিক শোক যথাযথভাবে পালন করা হতো। এখন সেখানে ভাঁটা পড়ছে। গেলো দুবছর করোনার জন্য আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। এবারও কী কী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, তা নিয়ে আমরা এখনো কিছুই জানি না।এসময় ১১ জুলাইকে মিরসরাই ট্র্যাজেডি দিবস ও দিনটিতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার জোরালো দাবি জানান সুপ্রীতি রানী।ট্র্যাজেডিতে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৫ জন, আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারজন, আবুতোরাব ফাজিল মাদরাসার দুজন, প্রফেসর কামালউদ্দিন চৌধুরী কলেজের দুজন শিক্ষার্থী ছিল। এছাড়া একজন অভিভাবক ও এক ফুটবলপ্রেমীও মারা যান।আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবুল হোসেন বাবুল বলেন, গত দুবছর করোনা মহামারির কারণে বড় কোনো কর্মসূচি হয়নি। তবে এবছর সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় আমরা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। সকালে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। নিহতদের স্মরণে আবেগ ও দুর্ঘটনাস্থল অন্তিমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এরপর স্কুল প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার আবু তোরাব-বড়তাকিয়া সড়কের পশ্চিম সৈদালী এলাকায় স্কুলছাত্র বহনকারী একটি ট্রাক খাদে পড়ে ৪৩ শিক্ষার্থীসহ ৪৫ জন নিহত হয়।

Advertisement