ব্রিট বাংলা ডেস্ক : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচনের প্রধান দুই পক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। দুই দলের মেয়র পদপ্রার্থীরাও শেষ দিনের প্রচারে ভোটারদের কাছে ভোট চাওয়ার সঙ্গে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলায় সোচ্চার ছিলেন। এদিকে নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যাতে আইন মেনে চলেন সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করেছে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। এ জন্য নেওয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা। আজ রাত শেষে আগামীকাল সকাল ৮টা থেকে শুরু হচ্ছে ভোটগ্রহণ। গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা প্রধান দুই পক্ষের অভিযোগ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু আছে বলেই মনে হয়। কোনো ধরপাকড়ও হচ্ছে না। তবে বোমাবাজ সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে ভিন্ন কথা। বহিরাগত প্রবেশ করেছে বলেও আমাদের কাছে তথ্য নেই।’
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনে ভীতি ছড়াতে বিএনপি বহিরাগত দাগি আসামি ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ঢাকায় জড়ো করেছে এবং ঢাকার প্রতি কেন্দ্রে এই ধরনের ৫০০ লোক রাখার পাঁয়তারা করছে। এ ছাড়া তিনি বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে দলের কর্মীরা সাংগঠনিকভাবে মাঠে থাকবেন।
পাল্টা অভিযোগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের উসকানিমূলক বক্তব্য, তাদের দলের মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্যের ফলে নির্বাচনের পরিবেশ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিকেই চলে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের মহল্লায় মহল্লায় ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী দিয়ে মহড়া ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির মেয়র-কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ও কর্মীদের নির্বাচনী প্রচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। হুমকি দিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এ ছাড়া গতকাল বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর অভিযোগ করে, “আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও আওয়ামী লীগ ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের’ পথেই হাঁটছে। আর নির্বাচন কমিশনও আওয়ামী লীগের ভোট সুরক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে। কমিশন নির্বাচন পর্যন্ত দৃশ্যমান অপরাধ না হলে গ্রেপ্তার হবে না বলে জানিয়েছিল, কিন্তু গ্রেপ্তার চলছে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হয়রানি করা হবে না বলেছিল, কিন্তু সেটিও শুরু হয়ে গেছে।”
সাংবাদিকদের তিনি আরো বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি শুধু জিতবে না বহু ভোটে জিতবে। তাই ভোট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতিবাচক অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তাদের কনসার্ন আমরা বুঝতে পারছি। দেশীয় দলীয় পর্যবেক্ষকদের ২২টার মধ্যে ১৮টির ওয়েবসাইট নেই। আবার দুটির একই ব্যক্তি চেয়ারম্যান ও আরেকটিতে চিফ এক্সিকিউটিভ। সেই প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর আওয়ামী লীগের নেতারা। আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদের অবজারভারদের দিয়ে সব কিছু করতে চায়, বাইরের কেউ দেখবে তারা চায় না।
গতকাল দুপুরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপির জন্ম হয়েছে অগণতান্ত্রিকভাবে। তারা যতই দাঙ্গা-হাঙ্গামা করুক নির্বাচন সময়মতো হবে। নির্বাচনে সমতা আছে বলেই বিএনপি ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাচ্ছে। সরকার চায় সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। বিএনপি নির্বাচনে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করলে আমরা তার মোকাবেলা করব। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি যতই সন্ত্রাসী জড়ো করুক আমরা মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।
নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আইন মেনে চলার জন্য গতকাল আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে। কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর এইচ টি ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক যাঁরা আছেন তাঁরা যেন দেশের আইন-কানুন মেনে চলেন। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যেন আন্তর্জাতিক যেসব বিধি-বিধান আছে সেগুলো যেন মেনে চলেন। আবার কোনো বিশেষ দেশের কেউ যেন মাতব্বরি না করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেখানে ভারতে বিদেশি পর্যবেক্ষক যেতেই দেয় না, অন্যান্য দেশেও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনেক বিধি-নিষেধ থাকে এবং অনেক নিয়ম-কানুনও মানতে হয়, সেখানে আমাদের দেশে অনেকেই (বিদেশি পর্যবেক্ষক) এমন অনেক কথা বলে ফেলেন যেসব আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বকে কটাক্ষ করা হয়।’
এইচ টি ইমাম বলেন, ‘নির্বাচনের সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা এবং কিভাবে আমরা তাদের (ইসিকে) সহযোগিতা করতে পারি, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। পাশাপাশি আগের মতো আমাদের সহযোগিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছি। আর নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয় সে দাবি জানিয়েছি।’
এদিকে পরিবেশ সুষ্ঠু আছে জানিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশনের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন সিইসি। গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে জানানোর পাশাপাশি বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে নুরুল হুদা বলেন, ‘তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার বিষয়ে কোনো বাধা নেই। স্থানীয় বিভিন্ন দূতাবাসের যাঁরা আছেন তাঁদের নিবন্ধনের দরকার নেই। আমাদের কাছে তালিকা দিলে আমরা সেই তালিকা অনুযায়ী তাঁদের অনুমতি দিতে পারি।
নির্বাচন কমিশন পরিবেশ সুষ্ঠু আছে দাবি করলেও নির্বাচনী মাঠের পরিস্থিতি স্বস্তিকর নয় বলেই অনেক প্রার্থীর অভিযোগ। গতকাল বিকেলে নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে প্রতিপক্ষের কর্মীদের হামলায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীসহ পাঁচ-ছয়জন আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ একাধিক। এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই হামলা প্রমাণ করে, সরকার নির্লজ্জভাবে নির্বাচনকে একদলীয় করার সব আয়োজন করে ফেলেছে। প্রচারণার শেষ দিনে বিএনপির মিছিলের ওপরে এই ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা জানাচ্ছি।’
বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, হামলা-গ্রেপ্তার তো চলছেই। সেটি এখন পর্যন্ত একটি মাত্রায়ই রয়েছে। এই সরকার ও এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি, এখানেই আমাদের শঙ্কা। ভোটগ্রহণ ও ফলাফল দেওয়া পর্যন্ত আমাদের সেই শঙ্কা থাকবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটির একটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আ. মান্নান গতকাল বলেন, ভোটারদের সাড়া পাচ্ছি, পরিস্থিতি এখনো ভালো। গণ্ডগোল হওয়ার আশঙ্কা দেখছি না।’ একই ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মোটামুটি পরিবেশ শান্ত আছে। প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগ শান্ত থাকলে পরিবেশ শান্ত থাকবে। যদি তারা ঝামেলা করে তবে অবস্থা খারাপ হবে।
ব্যাপক নিরাপত্তা : ঢাকার দুই সিটিতে গতকাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হচ্ছিল নিরাপত্তা চৌকি। গত বুধবার থেকে বহিরাগত ও সন্দেহভাজন ধরতে আবাসিক হোটেল, মেস, বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে তল্লাশি জোরদার করেছে পুলিশ ও র্যাব। রাজধানীতে টহলে নামানো হয়েছে ৬৫ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য। ভোটারদের নিরাপত্তা আর ভোটদান নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশ, র্যাব, বিজিবির ও আনসার মিলে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক সদস্য এই নির্বাচনে মাঠে কাজ করছেন।
নির্বাচনী অপরাধ দমন ও সংক্ষিপ্ত বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাঠে রয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। নির্বাচনের রুটিন ওয়ার্কের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার আর সন্ত্রাসী, মাস্তানদের আটকে পরিচালনা করছেন বিশেষ অভিযান। মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে পুলিশ, এপিবিএন, ব্যাটালিয়ন আনসার, র্যাব ও বিজিবি মোতায়েন থাকবে। যান চলাচল ও বহিরাগতদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইসি। সিটি নির্বাচনে জনস্বার্থে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মালিকদের সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ইসির নির্দেশে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ আদেশ জারি করা হয়েছে।
আজ শুক্রবার মধ্যরাত ১২টা থেকে ১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাস, বেবি ট্যাক্সি/অটোরিকশা, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, ট্রাক, টেম্পোসহ অন্যান্য যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে গতকাল রাত ১২টা থেকে। এ নিষেধাজ্ঞা থাকবে ২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টা পর্যন্ত। তবে রিটার্নিং অফিসারে অনুমতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাঁদের এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহনে নিষেধাজ্ঞা শিথিলযোগ্য। এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্র থাকতে হবে। নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক (পরিচয়পত্র থাকতে হবে), নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচনের বৈধ পরিদর্শক এবং জরুরি কাজে বিশেষ করে অ্যাম্বুল্যান্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।