:: আলী ইমাম মজুমদার ::
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে সম্প্রতি পেশ করেছে। ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে ৮ এপ্রিল প্রকাশিত তথ্যানুসারে এ প্রসঙ্গে দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, গেল বছরটিতে তাঁরা দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছেন। তাঁরা চান দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাজের একটি দৃঢ় নৈতিক অবস্থান।
এটা সত্য, এ ধরনের অবস্থান তৈরি না হলে দুর্নীতি দমন কার্যক্রমও টেকসই হবে না। তাই দুদক গঠনকালেই এর আইন কমিশনকে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু দায়িত্ব দিয়েছে। এর মধ্যে গণশুনানি, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আয়োজনসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রচারণাও রয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজে সচেতনতা বাড়বে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি নৈতিক অবস্থানও তৈরি হতে পারে। ফলে এর প্রকোপ হ্রাস পাবে। হয়তোবা সেই বিবেচনা থেকেই ২০১৬ সালের চেয়ে ২০১৭ সালে দুদক অধিক নজর দিয়েছে দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমের দিকে, এমন তথ্যই এসেছে সেই দৈনিকটিতে।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দুদক যথাক্রমে ১২ হাজার ৯৯০ এবং ১৭ হাজার ৯৫৩টি অভিযোগ পেয়েছে। এ দুই বছরের অভিযোগের সংখ্যা থেকে ধারণা করা যায়, দুদকের সামর্থ্যের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। তবে বছর দুটিতে তারা অনুসন্ধান (ইনকোয়ারি) শেষ করেছে যথাক্রমে ১ হাজার ৭৬৬ এবং ১ হাজার ৪৪৫টি অভিযোগের। মামলা দায়ের হয়েছে ৩৫৯ ও ২৭৩ টি। পূর্বেকার বছরগুলোর মামলাসহ ২০১৬ ও ২০১৭ সালে অনুসন্ধান (ইনভেস্টিগেশন) শেষ হয়েছে যথাক্রমে ২ হাজার ২৭১ এবং ৯৬৫টি অভিযোগের। অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দায়ের হয়েছে ৫৩৫ ও ৩৮২টি মামলায়। গ্রেপ্তার যথাক্রমে ৩৮৮ ও ১৮২। অন্যদিকে ২০১৬ সালে ৪৯৩টি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছিল। ২০১৭ সালে হয়েছে ৩ হাজার ২২১ টি। ২০১৭ সালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার ৯৪টি সততা সংঘ গঠিত হয়েছে। দুই বছরে গণশুনানি হয়েছে যথাক্রমে ৩০ ও ৪০ টি। সুতরাং দুদক দুর্নীতি দমনের চেয়ে প্রতিরোধের দিকে অধিক নজর দিচ্ছে, এটা স্পষ্ট লক্ষণীয়। দুদকের চেয়ারম্যান প্রথম আলোর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দুদক আইনে তাঁদের ১২টি নির্দেশিত করণীয়র মাঝে ৭টি প্রতিরোধমূলক।
আমরা ছোটবেলা থেকে জানি, প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে ভালো। রোগবালাইয়ের ক্ষেত্রে কথাটি বেশি বলা হয়। আর দুদক আইন প্রণয়নেও সম্ভবত সেই চেতনা কাজ করেছে। সুতরাং দুদক সংগতভাবে তা করতে পারে। আর এমনটা করা এ কারণে দরকার যে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা এ দেশে অনেক ক্ষেত্রে নন্দিত ভূমিকায় থাকছেন। সমাজে তাঁদের খাতিরও যথেষ্ট। তাঁরা প্রভাবশালীও। তাঁদের মধ্যে যাঁরা রাজনীতিতে আছেন, তাঁরা দান-দক্ষিণাও করেন যথেষ্ট। আর দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেই দানের টাকার রং বিচার করার ক্ষমতা নেই। বরং দাতাদের প্রশংসাই করেন তাঁরা।
সমাজে এই মানসিকতা চলছে দীর্ঘকাল ধরে। আর দিনে দিনে বাড়ছে এই শ্রেণির লোকের প্রভাব। এই অবস্থা থেকে কি দুদকের প্রতিরোধমূলক সভা-সমিতি বা এ-জাতীয় টোটকা চিকিৎসার মাধ্যমে উত্তরণ সম্ভব? দুর্নীতি তো ক্যানসারের মতো সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। এর জন্য শল্যচিকিৎসা বা কেমোথেরাপির মতো কঠিন ব্যবস্থার আবশ্যকতার কথাই অনেকে বলেন। ব্যাপারটি এরূপ পর্যায়ে আসত না যদি আমাদের দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম সব সময় সক্রিয় থাকত। দীর্ঘদিন যাবৎ এই শ্রেণিটি একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে চলেছে। অন্যরাও ধরে নিচ্ছেন, তাঁদের কেউ কিছু করতে পারবে না।
আমাদের এ-সংক্রান্ত কমিশনটির নামই কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন। সুতরাং ‘দমন’ এখানে অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দ্রুততার সঙ্গে এবং দৃশ্যমানভাবে আইনের আওতায় আনা হলে প্রতিরোধের কাজও অনেকটা হয়ে যাবে। এটা বিবেচনায় রাখা সংগত, আগেকার আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হওয়ার ফলে নতুন আইন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে দুদককে। কার্যত তারা স্বাধীন। এমনকি দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি তদন্তের এখতিয়ারও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। তাদের স্বাধীন সত্তা দৃঢ় করতে এবং প্রভাবমুক্ত রাখতে নেওয়া হয়েছে অনেক ব্যবস্থা। দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের কাউকে তাঁদের মেয়াদকালে অপসারণ করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
এত সব ক্ষমতা ও মজবুত সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়া হয়েছে কার্যত দুর্নীতি দমন করতে। প্রতিরোধমূলক কাজের জন্য এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষার আবশ্যকতা ছিল না। সে ধরনের কিছু কার্যক্রম সরকার ও বেসরকারি কিছু সংস্থার মাধ্যমেও হয়। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করছে সরকার। এ কাজে দুদকও অংশীদার। বেসরকারি খাতে টিআইবিসহ কিছু এনজিও এ ধরনের কাজ করে। সবাইকে শুদ্ধাচারী হওয়ার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কাজকর্ম চলছে। ধর্মীয় সভা-সমাবেশেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই দুদকের মতো আইনি কাঠামো দ্বারা গঠিত ও সুরক্ষিত নয়। দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারও আইনি এখতিয়ার নেই। সেই প্রেক্ষাপটেই দুদকের কাছে সবার প্রত্যাশা, তারা দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। নিচ্ছেও কিছু। তবে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালের কার্যক্রমের সূচক কয়েকটি ভিন্ন ধারণা দেয়। কেউ মনে করতে পারেন, দুর্নীতি দমনের বিষয়টি তাদের কাছে অগ্রাধিকারে নেই। তদুপরি যেকোনো কারণেই হোক, দুদককে সরকারের সম্প্রসারিত একটি অঙ্গ বলেও কেউ কেউ ইদানীং মন্তব্য করছেন।
তবে বিভিন্ন মত-পথের অনেক পর্যবেক্ষকের বিবেচনায়, ২০০৪ সালে দুদক গঠিত হওয়ার পর তুলনামূলকভাবে এর বর্তমান নেতৃত্ব অনেকটা বিচক্ষণ ও নিবেদিত। তাঁরা, বিশেষ করে একটি কঠিন খোলস থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের মধ্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এই বিবেচনায় তাঁদের কাছে সবার প্রত্যাশা বেশি। তবে সেই প্রত্যাশা খুব কমই পূরণ হচ্ছে দেখে আমরা হতাশ ও বিচলিত। কোথাও দুদকের হাত-পা বাঁধা নেই বলে দুদকের চেয়ারম্যান যতই বলুন না কেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, তারা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাধন্য প্রতিপত্তিশালীদের দিকে হাত বাড়াতে পারছে না। এর একটু পেছনের কাতারে যাঁরা আছেন, তাঁদের দিকেও যদি হাত না বাড়ানো হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের হতাশা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষোভকে অন্যায্য বলা যাবে না।
চিহ্নিত অসৎ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক বা ব্যবসায়ীদের নথি তদন্ত হতে সময় নেওয়া হয় মাসের পর মাস। অথচ দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত সবই দলিল ও ব্যাংক বিবরণীনির্ভর। অনুসন্ধানে প্রাথমিক প্রমাণ মিললে এজাহার দায়ের ও চার্জশিট দিতে তেমন সময় লাগার কথা নয়।
আদালতে দুদকের আইনজীবীদের তৎপর রাখতে সক্ষম হলে আসামিদের সাজা হওয়ারই কথা। আমরা দেখি, মাঝেমধ্যে চড়া গলায় কাউকে ডাকা হয় দুদকে। জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কিন্তু সফল পরিণতি দেখি না। নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি ও অসম্মান করা হোক, এটা আমরা চাই না। কিন্তু সেখানে যাঁদের ডাকা হয়, তাঁদের অনেককে আমরা চিনি ও জানি। দুর্নীতিপরায়ণ বলেই তাঁদের অনেকের পরিচিতি। কিন্তু কোথায় যেন অনেক কিছু থেমে যায়। বর্তমান নেতৃত্বে দুদকের বেশ কিছু সাফল্য আছে। তবে সেগুলো ধরে রাখা বা জোরদার করার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দেওয়াতে আমরা আপত্তি করব না। তবে দমনের গুরুত্ব তার চেয়ে কম হওয়া সংগত নয়। দুর্নীতি দমনের জন্য আমাদের তো আর দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব