দুর্যোগকালীন স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য ভূমিকা রেখেছে কমিউনিটি ক্লিনিক

বাংলাদেশের গ্রামীন জনপদের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিটি মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকের সুফল পাচ্ছে দেশবাসী। বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি ও দুরদর্শীতার বাস্তব প্রমাণ মিলেছে এবারের প্রাণঘাতী করোনা মহামারীকালে। বিশ্বের বহু দেশ যেখানে অপ্রতুল ভ্যাক্সিন ও সুব্যবস্থাপনার অভাবে যথাসময়ে সবার কাছে ভ্যাক্সিন পৌঁছাতে পারেনি, বাংলাদেশ সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে এই সেবা যথাসময়ে পৌঁছে দিতে পেরেছে। এসময় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালুর রাখার পাশাপাশি ভ্যাক্সিন প্রদানেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সারাদেশে এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে পৌনে ৩ কোটিরও বেশি ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। টিকা আনা নেয়া, টিকা প্রদান এবং কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ ও পরিচালনা, সব দায়িত্ব পালন করেছেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)রা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সর্বমোট টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে তৃনমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ২ কোটি ৮৮ লাখ ১১ হাজার ৬০০ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ কোটি ৭৯ লাখ ১৯ হাজার ৯৪৫ জন শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ১ কোটি ৪৩ লাখ ২৯ হাজার ৯৬৯ জন এবং দ্বিতীয় ডোজের ৩৫ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭৬ জন।এছাড়া মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ২ হাজার ৯৪৪ জনকে প্রথম ডোজের ও ভাসমান জনগোষ্ঠীর ১৮ হাজার ২৬৬ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

সুত্র জানায়, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টিকা দেওয়া শুরু হয় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর এখন পর্যন্ত টিকার দুই ডোজ দেওয়া হয়েছে ১১ কোটি ৭১ লাখ ৬৬ হাজার ১০ জনকে এবং এক ডোজ পেয়েছেন ১২ কোটি ৮৭ লাখ ৮ হাজার ১৩২ জন। প্রাপ্তি সাপেক্ষে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোভ্যাক, ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, মডার্না এবং চীনের তৈরি সিনোফার্ম কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। জনসংখ্যার বিপরীতে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় এসেছে। পাশাপাশি বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৫২ জনকে। এভাবেই কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ধাপে ধাপে ভ্যাক্সিন সেবা পেয়েছে।কমিউনিটি বেইজ হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মাসুদ রেজা কবির বলেন, বর্তমান সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য করোনা টিকা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিকে করোনা টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে প্রান্তিক মানুষকে টিকা দেওয়ার যে লক্ষ্য সরকার নির্ধারণ করেছিল, তা সফল হয়েছে। সারাদেশের ক্লিনিক গুলোতে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলো লাইন ধরে টিকা নিচ্ছেন। বাড়ির আশে পাশে টিকা দেওয়ার কারণেই এই সফলতা এসেছে। অনেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে টিকা নিতে চায়নি, যখন দেখলেন বাড়ির কাছেই টিকা পাওয়া যাচ্ছে, তখন তারা টিকা নিয়েছেন।সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার কুসম্বি কমিউনিটি ক্লিনিকে করোনা টিকা নিয়েছেন দেব্রত সরকার। তিনি বলেন, “আমার পক্ষে ১০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়া সম্ভব নয়। শুনেছি সেখানে গিয়ে নাম নিবন্ধন করতে হয়, লাইন ধরতে হয়, লাইনের পিছনে পরলে অনেক সময় টিকা শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে কাজ বাদ দিয়ে এই সকল ঝামালে কে করবে? আবার করোনার এই সময়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হয়। সরকারী হাসপাতালে অনেক জায়গা থেকে রোগী আসবে, কে কোথায় থেকে আসবে, তার শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কি না এসব ভেবেই বাড়ির কাছে কোন ঝামেলা ছাড়াই কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে টিকা নিয়েছি।

সিএইচসিপিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনার সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যকর্মীরা সার্বক্ষণিক মানুষকে পরামর্শ দিয়েছেন। পরবর্তীতে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে করোনা টিকা প্রাদন কার্যক্রমে ও অংশ নিয়েছেন। তারা বলেন, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাড়তি চাপ হলেও করোনা থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে টিকাদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারায় তারা গর্বিত। কুসম্বি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি অমৃত প্রামাণিক বাসসকে বলেন, সরকারের এই উদ্যোগ ছিল অত্যন্ত কার্যকর। যে সব মানুষ আগে উপজেলায় গিয়ে টিকা নিতে চাইতেন না, তারা কমিউনিটি ক্লিনিকে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিয়েছেন। আমাদের যদিও একটু কষ্ট হয়ছে তবুও আমরা খুশি, যে আমরা আশেপাশের মানুষকে টিকা দিতে পেরেছি। বর্তমানে দেশে ১৩ হাজার ৮৬১টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হচ্ছে। আরও ১ হাজার ৩৯টি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে ৩০ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণের পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার-পরিকল্পনা ও পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া থানাধীন পাটগাঁতী ইউনিয়নের ঘিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে এই কার্যক্রমের সূচনা করেন। ২২ বছরে কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবায় এক অপরিহার্য্য অংশে পরিণত হয়েছে।

Advertisement