দেওনাই নদী কি ‘জলমহাল’ হবে?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: রংপুর বিভাগে নদ-নদীর সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে দেড় শতাধিক নদীর অবস্থা আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। এ বিভাগে তিস্তা, বুড়ি তিস্তা (কুড়িগ্রাম) ও দেওনাই—এ তিনটি নদী নিয়ে বড় বড় আন্দোলন আছে। তিস্তা নিয়ে যে আন্দোলন, তা ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে। অন্য দুটি দেশীয় দখলদারদের বিরুদ্ধে।

বুড়ি তিস্তার মুখ বন্ধ করে দিয়ে উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নে প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে সরকার নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে। এই সুযোগে অনেক মানুষ নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে। ‘বুড়ি তিস্তা বাঁচাও, উলিপুর বাঁচাও’ দাবিতে ‘উলিপুর উপজেলা প্রেসক্লাব’ এবং ‘গণকমিটি’ নামের দুটি সংগঠন অনেককে সঙ্গে নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ঈদের দুদিন পর থেতরাই এলাকায় গিয়ে দেখেছি, সরকার কত নির্মমভাবে একটি প্রবাহিত নদীর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। ওই নদীর মুখে এখন অনেক ঘরবাড়ি। নদীর একটি অংশে পুকুর তৈরি করেছেন আবদুল হক। তিনি নিজেই স্বীকার করলেন, অনুমতি ছাড়াই পুকুর করেছেন এবং মাছ চাষ করছেন। এ নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। খননের সঙ্গে তিস্তার পানি যাতে এ নদীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সে ব্যবস্থাও সরকারকে করতে হবে।

নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার একটি নদী দেওনাই। নদীটি স্থানীয় কিছু লোক দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। নদীর তীরবর্তী মানুষ এ নদী রক্ষায় আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তাঁরা গঠন করেছেন ‘দেওনাই সুরক্ষা কমিটি’। গত ঈদের দুদিন আগে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার দেওনাই নদীর তীরবর্তী হরিণচড়া ইউনিয়নের শেওটগাড়ি গ্রামে গিয়েছিলাম। অনেকেই আমাদের আসার কথা শুনে অপেক্ষা করছিলেন। আমার সঙ্গে ছিলেন গণমাধ্যমকর্মী বন্ধুস্থানীয় নিশাত ইসলাম। অপেক্ষারত জনগণ উচ্চশিক্ষিত কেউ নন। তাঁদের সবার বড় পরিচয়, তাঁরা সবাই নদীবন্ধু। তাঁরা কেউ দেওনাই নদীকে জলমহাল ঘোষণা করতে দেবেন না। আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে লুত্ফর রহমান বলছিলেন, ‘শত বছরের পুরোনো এ নদী বাপ-দাদার আমলেও কোনো দিন কেউ দখল করতে আসেনি। এ নদীটিতে যারা ইচ্ছা মাছ শিকার করতে পারছে। গত বছর থাকি মাছ ধরা বন্ধ।’ বেলাল হোসেন নামের একজন জেলে বলছিলেন, ‘হামরা অনেক জেলে পরিবার এলা বেকার হছি।’

২০১৭ সালে বর্ষা মৌসুমে নীলফামারী সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ সবুজপাড়া মৎস্যচাষি সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংগঠনের সদস্যরা সামান্য কিছু মাছ নদীতে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ করে দেন। এতে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়। সমিতির সদস্যরা শুধু মাছ ধরা নিষেধ করেই চুপ ছিলেন না, তাঁরা বাঁশের তৈরি বেড়া (বানা) দিয়ে তাঁদের নিজেদের সীমানা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে গিয়ে প্রতিবাদ করলে সংঘর্ষ বাধে। মৎস্যচাষি সংগঠনের সংগঠক থানায় একটি জিডি করেছিলেন প্রতিবাদকারীদের নামে। সেখানে জিডিকারী স্পষ্টত স্বীকারোক্তি করেছেন, তাঁরা লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে নদীতে মাছ ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। একটি নদীতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জলমহাল বিবেচনা করে মৌখিকভাবে মাছ ছাড়ার অনুমতি কীভাবে দেন, তা বোধগম্য নয়।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। সংঘর্ষ হওয়ার পর নীলফামারী ও ডোমারের দুই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সংশ্লিষ্ট দুই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান উপস্থিত থেকে নদীতে সবার মাছ ধরা বন্ধ করেন। অন্যায়ভাবে যাঁরা মাছ ছেড়ে দিয়ে নদীর দখল নিতে চান, কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, নদীতে সবার মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে করে সাধারণ জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়। গত বছরের পর এ বছরেও নদীটিকে উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়নি।

কোনো রকম লিজ না নিয়ে কি একটি নদীতে মাছ ছাড়া যায়? একটি নদী কি কেউ লিজ দিতে পারেন? প্রশাসন সেটা দেখে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বসে থাকতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান জরুরি। তাহলে কোন শক্তিবলে অবৈধভাবে মাছ ছেড়েছে একটি সংগঠন এবং সরকারি প্রশ্রয় কতটা তারও সরল সমীকরণ হাজির করা সম্ভব। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না, মত্স্যজীবী সমিতির সদ্যদের খুঁটির জোর অনেক। মুঠোফোনে লক্ষ্মীচাপ সবুজপাড়া মৎস্যচাষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি নুরন্নবী ইসলাম বলেন, ‘এ বছরও আমরা সরকারের অনুমতি না নিয়ে এক লাখ টাকার মাছ ছাড়ছি।’

অসাধু চক্র নদীটিকে জলমহাল ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। একটি নদীকে জলমহাল ঘোষণার জন্য আবেদনটি আমলে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রতিবেদনও দাখিল করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এলাকার মত্স্যজীবীসহ সাধারণ জনগণ দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাঁদের দাবিদাওয়া পেশ করেই যাচ্ছেন। আন্দোলনকারীরা স্থানীয় সাংসদ, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির কাছে প্রতিকার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। যেহেতু মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে এবং জলমহাল বানানোর প্রক্রিয়া চলছে, তাই আন্দোলনকারীরা উদ্বিগ্ন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, নীলফামারীর জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), ডোমারের ইউএনও, হরিণচড়া ইউপির চেয়ারম্যান, উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। মুখে তাঁরা বলেছেন ব্যবস্থা নেবেন। এখন সেই ব্যবস্থা গ্রহণ দেখার অপেক্ষায়। নয়তো যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে, তাদের কেউ রোধ করতে পারবে না। ‘দেওনাই নদী সুরক্ষা কমিটি’র আহ্বায়ক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘আমরা অন্যায়ভাবে একটি নদীকে কিছুতেই জলমহাল ঘোষণা করতে দেব না।’ অনতিবিলম্বে দেওনাই নদীটিকে উন্মুক্ত ঘোষণা করা হোক। যাঁরা অন্যায়ভাবে মাছ ছেড়েছেন, তাঁদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনাও জরুরি। তাঁদের খুঁটির জোর যতই হোক না কেন, নদীর পক্ষে সরকারের অবস্থান নেওয়াই বিধিসম্মত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার যে নদী সুরক্ষায় তাগিদ দিচ্ছেন, তা–ও মনে রাখা প্রয়োজন।

তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক

Advertisement