।। মাহমুদুল হাসান।।
নাসা (ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থাটি মহাকাশ গবেষণা, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন কিংবা দূর মঙ্গলে মানব-বসতি বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তাই স্বাভাবিকভাবে আমরা ধরেই নিই, নাসা হয়তো শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা মহাকাশ-সংশ্নিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সব বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে।
কিন্তু একটু ভেবে দেখেন, নাসা যদি কখনও ভিনগ্রহে নতুন প্রাণের সন্ধান পায়, তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মহাকাশ বিজ্ঞানীর পাশাপাশি নাসাকে কিন্তু জীববিজ্ঞানীদেরও শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ, নতুন ভিনগ্রহে প্রাণের ধরন কেমন হতে পারে, নতুন প্রাণের উৎপত্তিই বা কীভাবে হয়েছিল কিংবা মহাকাশে প্রাণের বিবর্তন কীভাবে হতে পারে- এ রকম অসংখ্য প্রশ্নের ব্যাখ্যা হয়তো জীববিজ্ঞানীদেরই খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মহাকাশে প্রাণের বিস্তার-সংশ্নিষ্ট গবেষণার জন্য নাসাকে আলাদাভাবে জীববিজ্ঞানীদের খুঁজতে হবে না; বরং নাসা নিজেই অনেক দিন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে নিজেদের গবেষণা কেন্দ্রে মহাকাশ জীববিজ্ঞান বা স্পেস বায়োলজি-সংশ্নিষ্ট গবেষণা নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
আজকের পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের বহুমুখী সেবার কথা আমরা জানি। নাসার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থা, যেমন- রাশিয়ার রসকসমস, জাপানের জাপা, ইউরোপের ইএসএ, কানাডার সিএএ এই মহাকাশ স্টেশনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়মিতভাবেই নভোচারী বা মহাকাশ বিজ্ঞানীকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাঠায়। আবার নভোচারীদের দিনের পর দিন ওজনহীন অবস্থায় আমাদের জন্য কাজ করতে হয়। মহাকাশযাত্রা কিংবা মহাকাশে পৃথিবী ভিন্ন এসব পরিবেশ নভোচারীদের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম, কোষীয় বিপাক ক্রিয়া বা খাদ্যাভ্যাসে কী কী প্রভাব ফেলছে- এ রকম অনেক গবেষষণা সম্পন্ন করে আজকের দিনে নাসা ও অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থাগুলো এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
দূর ভবিষ্যতে মানুষ যদি চাঁদে বা পৃথিবীর বাইরে মহাকাশের অন্য কোনো গ্রহে পাড়ি জমায়, সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ মহাকাশযাত্রা বা মহাকাশের পরিবেশ মহাকাশচারীদের বিপাক ক্রিয়া, প্রজনন, অভিযোজনে কী পরিবর্তন আসতে পারে কিংবা দূর মঙ্গলে পৃথিবী ভিন্ন পরিবেশে আমাদের খাবারের সংস্থানই বা কীভাবে হবে- এ রকম অসংখ্য চমকপ্রদ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে নাসার বিশেষায়িত ‘স্পেস বায়োলজি’ প্রকল্পের মাধ্যমে।
এ প্রকল্পের গবেষণাগুলো মূলত চারটি বিভাগে পরিচালিত। প্রথমেই আসে ‘সেল অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি’ বিভাগ। এককোষীয় ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে বহুকোষীয় মানুষের টিস্যু বা বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম মহাকাশযাত্রা বা গ্র্যাভিটেশনাল পরিবর্তনে কীভাবে সাড়া দেয়, তা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করাই হচ্ছে এ বিভাগের বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু। এ ক্ষেত্রে প্রাণিকুলের জিনোম বা ডিএনএর পরিবর্তন, শারীরিক প্রোটিন তৈরিতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও এমনকি কোষীয় যোগাযোগের সাম্যবস্থায় মহাকাশযাত্রা বা মহাকাশে জীবনধারণের প্রভাব নিয়ে নাসার জীববিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ। আমরা যেখানেই যাই, আমাদের শরীরে বাস করা জীবাণু সঙ্গে করে নিয়ে যাই। সেই যাওয়াটা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনই হোক কিংবা ভিন্ন কোনো গ্রহেই। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের পরিবেশ জীবাণুমুক্ত রাখা কিংবা নভোচারীদের সহযাত্রী এসব ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস দীর্ঘ মহাকাশযাত্রায় বা বায়ুশূন্য পরিবেশে কেমন আচরণ করে- এসব নিয়ে গবেষণা করাই হচ্ছে এ বিভাগের মূল প্রতিপাদ্য। একটা জিনিস কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে, আমাদের অন্ত্রে বসবাস করা ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয়ে থাকে আমাদের ‘দ্বিতীয় ক্রোমোজোম’। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের শরীরের মধ্যে বসবাস করা এসব ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রম আমাদের শারীরবৃত্তীয় কাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে আমরা যদি মঙ্গলে পাড়ি জমাতে চাই, তাহলে আমাদের জীবাণুদের নিয়েও ভাবতে হবে। কেননা এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের বন্ধু কিংবা শত্রু উভয়ই হতে পারে।
তৃতীয়ত, ‘প্লান্ট বায়োলজি’ বিভাগ। বাস্তুসংস্থান সম্পর্কে আমাদের সবারই ধারণা আছে। মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের প্রাথমিক যে উৎপাদক তা হচ্ছে উদ্ভিদ। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীদের খাবারের তালিকায় যদি এমন শাকসবজি রাখা যেত, যা কিনা মহাশূন্যেই স্পেশালাইজড বায়োস্ম্ফিয়ারের মধ্যেই উৎপাদিত হবে, তাহলে বিষয়টি কেমন দাঁড়ায়। এ ব্যাপারটি কিন্তু এখন আর কোনো আইডিয়া নয়। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে রোমান লেটুস ও বাঁধাকপির চাষ হচ্ছে এবং শিগগির টমেটোর উৎপাদনও শুরু হতে যাচ্ছে।
পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের বাইরে এসব শাকসবজি বা উদ্ভিদের উৎপাদন এত সহজে সম্ভব ছিল না। মহাকাশে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্র্যাভিটি উদ্ভিদের প্রজনন, শারীরিক বৃদ্ধিতে বা বিভিন্ন বিপাকে কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতে হয়েছে। আবার দীর্ঘমেয়াদি মঙ্গল বা চাঁদের অভিযানে মহাজাগতিক বিকিরণ কিংবা সংশ্নিষ্ট বাস্তুসংস্থান উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়েও নাসার প্লান্ট বায়োলজি বিভাগের উদ্ভিদবিদরা বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বস্তুত মহাকাশে খাদ্য উৎপাদন ও সুরক্ষাবিষয়ক সমস্যা সমাধানের এ কাজ ভবিষ্যতে পৃথিবীর বাইরে স্থায়ী আবাস গড়তে আমাদের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
চতুর্থ বিভাগ ‘ডেভেলপমেন্ট, রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ড ইভল্যুশনারি বায়োলজি’। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই বিভাগের বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রাণী বা উদ্ভিদকুলের পরবর্তী প্রজন্মের আগমন, তাদের বেড়ে ওঠা কিংবা অভিযোজন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এই প্রাণীর তালিকায় শীর্ষে কিন্তু আমরা দ্বিপদ মানুষরা। মহাকাশে প্রজনন বা কয়েক প্রজন্মের সহাবস্থানটা কেমন হতে পারে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণে হরমোনাল প্রক্রিয়ায় মহাকাশের পরিবেশ কি স্বাভাবিক ভূমিকা পালন করবে নাকি সেখানে ভিন্নতা আসতে পারে- এ রকম চমকপ্রদ ও চাঞ্চল্যকর বিষয় নিয়েই গবেষণা হচ্ছে। আমরা যতই মঙ্গলে বসতি স্থাপনে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই এসব বিষয়-সংক্রান্ত গবেষণা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
অদূর ভবিষ্যতে দূর কোনো মায়াবী গ্রহে আমরা হয়তো মানব-বসতির সূচনা করব কিংবা কিছুদিন পরেই হয়তো আমাদের কাছে মহাকাশযাত্রা অনেক সহজলভ্য হয়ে যাবে। কিন্তু এই যে আমরা কল্পকাহিনির ভবিষ্যতের দিকে একটু একটু করে বিজ্ঞানের দৃঢ়তায় হেঁটে চলছি- এর পেছনে রয়েছে শতসহস্র বিজ্ঞানীর মেধা, শ্রম ও অজানাকে জানার গল্প। সেখানে নাসার অদম্য জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পৃথিবীর প্রাণের স্পন্দনকে মহাকাশে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞায়।