জামালউদ্দিন বারী: মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রগতি ও স্থিতিশীলতার উপর যেন বিপর্যয় নেমে এসেছে। ট্রাম্পের প্রো-জায়নবাদি ও এন্টি মুসলিম রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। অবশেষে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তায় ট্রাম্পের জেরুজালেম নীতি ঘোষনার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি রক্তাক্ত সংঘাতের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণও প্রবলভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিশ্বরাজনীতিতে যেমন ট্রাম্পের অবস্থান নিম্নগামি, একইভাবে মার্কিন জনগনের মধ্যেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন ধসে যেতে বসেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন ভোটারদের মধ্যে প্রেসিডেন্টের সমর্থন এখন শতকরা ৩৫ ভাগেরও নিচে নেমে এসেছে। অন্যদিকে সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। মার্কিন ইতিহাসের প্রথম আফ্রো-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা ওবামার জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন থাকার এই বাস্তবতা তাকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একজন অতিব গুরুত্বপূর্ণ সেলিব্রেটিতে পরিণত করেছে। সম্প্রতি বিবিসি টিভি চ্যানেলে প্রেসিডেন্ট ওবামার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। প্রায় তিনমাস আগে গত সেপ্টেম্বরে গ্রহন করা সাক্ষাৎকারটি ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ বিবিসি’র রেডিও ফোরের ফ্লাগশিপ প্রোগ্রাম ‘টুডে’তে প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হচ্ছে, এর প্রশ্নকর্তা বৃটিশ রাজপরিবারের অন্যতম উত্তরাধিকার, প্রিন্সেস ডায়ানার পুত্র প্রিন্স হ্যারি, অর্থাৎ ইন্টারভিওতে অংশগ্রহনকারি দু’জনই আন্তর্জাতিক সেলিব্রেটি, এমন ঘটনা বিরল। প্রিন্স হ্যারি বিবিসির অতিথি সাংবাদিক হিসেবে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন। এ কারণে মিডিয়া রিপোর্টে এই সাক্ষাৎকারকে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আজকের বিশ্ববাস্তবতা এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ বা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বকে এক সংঘাতময় অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তখন সদ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বির্বতন সম্পর্কে নিজের প্রজ্ঞাপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করছেন। দুই সেলিব্রেটির সাক্ষাৎকারে সাম্প্রতিক মার্কিন ও বিশ্ব রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ উঠে আসলেও প্রচ্ছন্ন অথবা ডি ফ্যাক্টো বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম কেউই উচ্চারণ করেননি। নাম না আসলেও তাদের আলোচনায় বিশ্ব রাজনীতিতে ট্রাম্পের অপরিনামদর্শি নীতির কুপ্রভাব সম্পর্কিত আলোচনা পরোক্ষ ভাবে উঠে এসেছে। আর গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক ভূমিকা, অবস্থান এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সামাজিক-রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া ও আন্তযোগাযোগের গতানুগতিক ধারা বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট সকলকে আরো দায়িত্বশীল ও সাবধানতা অবলম্বনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা। জনমত গঠনে ও সামাজিক বির্বতনে মেইনস্ট্রীম মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ ভ‚মিকা বেড়ে যাওয়ায় দেশে দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক সহাবস্থান নানাভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ওবামা তার আলোচনায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা সামাজিক ঐতিহ্য ও সহাবস্থানের পরিবেশ নস্যাতের বিষগুলো তুলে ধরেছেন। এক সময় সাম্রাজ্যবাদে কুশীলবরা ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অপতৎপরতা উস্কে দিত তাকে ‘বলকানাইজেশন’ বলে অভিহিত করা হত। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক ধরনের সোশ্যাল বলকানাইজেশন সৃষ্টি করছে বলে ওবামা মনে করেন। যেখানে সকল মানুষের মধ্যে সমস্যা ও সম্ভাবনার একটি ঐক্যসুত্র রয়েছে, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট ভিন্ন ও অবাস্তব বিষয়কে সামনে এনে ঐক্য ধ্বংস ও অসংখ্য ভাগে বিভাজিত করে তুলতে পারে।
মাত্র দু’তিন দশক আগেও প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের সাধারণ মানুষ ধারনা করতে পারেননি যে কর্পোরেট মিডিয়ার সমান্তরালে একটি সর্বগ্রাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধের ধ্বংস ও বিনির্মানের অনুঘটক হয়ে উঠবে। শিক্ষাব্যবস্থার গতানুগতিক লক্ষ্য, পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনীতির তথাকথিত র্যাডিক্যালাইজেশনের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জটিল ভূমিকা প্রসঙ্গে সাবধান বানী উচ্চারণ করেছেন ওবামা। বিশেষত: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমন ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবিন্যস্ত, সমন্বয়হীন ভ’মিকা সামাজিক রাজনৈতিক ঐক্য প্রক্রিয়ার জন্য বড় বাধা হিসেবে গণ্য করছেন ওবামা। জাতীয় ও আন্তজার্তিক ইস্যুতে একসময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনমত গঠনে যতটা সুনির্দিষ্ট ও লক্ষাভিসারি ফলাফল লাভ করতে সক্ষম হতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুধা বিভক্ত ভ’মিকার কারণে এখন তা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও সহাবস্থানের পরিবেশ হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য বারাক ওবামা মূলত: রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই দোষারোপ করেছেন। কর্পোরেট মিডিয়ার আন্ডারকাভার্ড বা ছদ্মবেশি ভ’মিকা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মেনিপুলেশনের মাধ্যমেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত ব্যক্তিদের একদেশদর্শি ও হীন রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে জনমত গঠন ও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়। অপ্রত্যাশিত অবিন্যস্ত ও বিপরীতমুখী জনমত সামাজিক ঐক্যের বন্ধনগুলো শিথিল করে তুলতে পারে। সে ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহাবস্থানের সামাজিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্য মার খেতে পারে। প্রিন্স হ্যারির সাথে সাক্ষাৎকারে বারাক ওবামা এ প্রসঙ্গটিকেই সামনে নিয়ে এসেছেন। নিউ ইর্য়ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘ওবামা টেলস প্রিন্স হ্যারি: লিডার্স মাস্ট স্টপ করৌডিং সিভিল ডিসকোর্স’। এ ধরনের আশঙ্কার মূল কারন সম্ভবত এই যে, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশে দেশে যে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, তাতে সামাজিক সহাবস্থান, শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই বেশী আক্রান্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সামাজিক ঐক্য এবং ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে একটি সাধারণ ও সমন্বিত অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশ্বের নেতৃত্বশীল রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদকে একটি রিলে রেসের সাথে তুলনা করেছেন বারাক ওবামা। প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট তার মেয়াদকাল শান্তি ও সহাবস্থানের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা অক্ষুন্ন রাখার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করার মধ্য দিয়ে তার হাতের কাঠিটি অন্যের হাতে তুলে দেয়ার মধ্যেই তার দায়িত্বের সার্থকতা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে চাচ্ছেন এবং সবকিছু তিনি একাই শেষ করতে চান। এ ধরনের চিন্তা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারনার সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার যেখানেই শাসকশ্রেনীর মধ্যে এমন ধারনা থাকবে, কোন বিশেষ ব্যক্তি সবকিছু নিজেই শুরু ও শেষ করার অভিপ্রায় নিয়ে কাজ করবেন, সেখানেই দেখা দিবে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপত্তি, বিপর্যয় ও অস্থিতিশীলতা। দীর্ঘদিনের ধারবাহিক পরিকল্পনা ও কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যকে কোন একক দল, গোষ্ঠি বা ব্যক্তির দ্বারা কুক্ষিগত হওয়ার বাস্তবতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে একেবারেই মিলেনা। সবকিছু আমি বা আমরাই করেছি, আর কেই কিছু করেনি, সবকিছু আমাকে বা আমার দলকেই করতে হবে, ক্ষমতাবানের এমন অভিব্যক্তি দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে তোলে।
বহুদলীয় গণতন্ত্রে কর্তৃত্ববাদি শাসনের কোন স্থান নেই। আমেরিকার স্বাধীনতার পর আড়াইশ বছর বা বাংলাদেশের সাতচল্লিশ বছরের পথচলা ও অর্জনের পেছনে কোটি কোটি মানুষের ঘাম, রক্ত ও মেধার ভূমিকা রয়েছে। কেউ যদি অতীতের সব অর্জন এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে নিজের দলীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনার সাথে একীভ’ত করে বিচার করতে চায় এবং জনগনের উপর একটি স্থায়ী কর্তৃত্ব আরোপের চেষ্টা করেন, তাহলে আর মুক্ত সমাজ ও মুক্ত রাজনীতির পথ খোলা থাকেনা। গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা অবশ্যই রিলে রেসের মত। তবে রিলে রেসের শুরু ও শেষের পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ও সময়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও রাজনীতির রিলে রেসে তেমন কোন সুনিশ্চিত পরিসমাপ্তি নেই। ঐতিহাসিক কালের গন্ডিতে বিচার্য সব অর্জন ও দায় ইতিহাসের কুশীলবদের মধ্যে যার যার প্রাপ্য অনুসারে বন্টিত হয়। আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা অবাধ ও অবারিত থাকলে ভোটের মাধ্যমে জনগনের সমর্থন নিয়ে বার বার রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের সুযোগ থাকে। ব্যালটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পণকে ক্ষমতা না বলে দায়িত্বভার গ্রহণ বলে মনে করা কর্তৃত্ববাদি শাসনের খড়গ থেকে মুক্তির প্রথম মনস্তাত্বিক ধাপ। এ প্রসঙ্গে শাসক হিসেবে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের মনোভাব এমন ছিল, তিনি বলেছেন, দজলা ফোরাতের তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায় ওমরকে তার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এটি হচ্ছে শাসকের দায়-দায়িত্ব ও ন্যায়বোধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তখনকার দিনে সংবাদপত্রের প্রভাব, টেলিভিশন চ্যানেল বা ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ায় শাসকদের পক্ষে বিপক্ষে জনমত গঠনের কোন ব্যবস্থা না থাকলেও কর্তৃত্ববাদি শাসন থেকে জনগনকে রক্ষা ও জনকল্যাণের সর্বোত্তম রক্ষাকবচ ছিল মহাপরাক্রমশালী ও সর্বশক্তিমানের উপর শাসকের বিশ্বাস ও আত্মসমর্পনের ইমানদারি ভ’মিকা। আজকের দুনিয়ায় বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিস্কার, প্রযুক্তির ঔৎকর্ষ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাস্তব অগ্রগতি হচ্ছেনা। এর মূল কারণ শাসকশ্রেনীর মধ্যে নৈতিক মান ও দার্শনিক প্রজ্ঞার অনুপস্থিতি। শাসকের ক্ষমতালিপ্সা, দুর্নীতি এবং জনস্বার্থের প্রশ্নে বেপরোয়া মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে সাধারণ জনগনের মধ্যে। এরপরও বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে জনসমাজে একটি সাধারণ ঐক্য ও জনমত প্রতিষ্ঠার সুযোগ এখনো আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সে লক্ষ্যে একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পাশাপাশি এই মাধ্যমের অপব্যবহার এবং সুপরিকল্পিত মেনিপুলেশন শান্তি ও সম্ভাবনাময় ঐক্য প্রক্রিয়াকে বিপরীতমুখী বিশৃঙ্খলার পথে নিয়ে যেতে পারে। বারাক ওবামা খুব অল্প কথায় সে ধারনা জনসম্মুখে তুলে ধরেছেন। এর মর্মাথ হচ্ছে, সমাজ ও রাজনীতির শুভ শক্তি ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে ইতিবাচক কাজে লাগানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রযুক্তির পেছনের স্বার্থন্বেষী মহল যেন বিভাজন ও অশান্তি ছড়িয়ে যুদ্ধবাদি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সফল হতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বারাক ওবামা একটি সমকালীন রূঢ় বাস্তবতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ওঠার পর থেকেই অনবরত তার পূর্বসূরি বারাক ওবামার হেল্থ কেয়ার পরিকল্পনাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশকিছু প্রকল্প ও চুক্তির বিরোধিতার পাশাপাশি ওবামাকে রাজনৈতিকভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন করলেও ওবামা কখনো পাল্টা আক্রমন করেননি। হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করার পর থেকেই রাজনৈতিকভাবে অনেকটা নিরব থাকলেও সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কারসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ওবামা নিজের অবস্থান সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন। তবে হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নেয়ার পর এই প্রথম দেয়া হাই-প্রোফাইল ইন্টারভিউতে ওবামাকে তার পূর্বসুরির সমালোচনার সরাসরি জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি তার স্ত্রী সাবেক ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামার ডিকটাম বা নীতিবাক্য স্মরণ করিয়ে দেন, সেটা হচ্ছে-‘হোয়েন দে গো লো, ইউ গো হাই’। অর্থাৎ সংঘাত এড়িয়ে চলার নীতিকেই যথার্থরূপে গ্রহন করেছেন। বারাক ওবামা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মের সামাজিক-রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যে বার্তা তুলে ধরতে চান, তা হচ্ছে ঐক্য, শান্তি ও সহাবস্থানের গণতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখা। তার মতে বর্তমান নতুন প্রজন্ম বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক দক্ষ, সহনশীল, বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক আবহের সাথে মানানসই, উদ্যোগী এবং নতুন প্রযুক্তির প্রতি উৎসাহী হলেও তারা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থাশীল নয়। তিনি এই প্রজন্মের অনলাইন কমিউনিটির সদস্যদের ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে মাঝে মধ্যে অফলাইনে পারস্পরিক ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। ইন্টারনেটে সবকিছুকে একভাবে দেখতে অভ্যস্থ হওয়ার পর যখন তুমি কারো সাথে ব্যক্তিগতভাবে মুখোমুখি হবে তখন তা অনেক বেশী জটিল বলে মনে হবে। ফেইসবুক-টুইটারে বিপ্লব করার চেষ্টা বাদ দিয়ে পরিবর্তনের জন্য মাঠে নামতে হবে, কাজ করতে হবে। ওবামার এই উপলব্ধি প্রতিটি দেশে, প্রত্যেক সমাজের জন্যই মাত্রাভেদে সঠিক। বিশেষত রাজনৈতিক যে সব নেতা জাতিকে বিভাজিত করার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায় এবং গণমাধ্যম , সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটকে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ উঠে এসেছে প্রিন্স হ্যারির সাথে ওবামার কথোপকথনে। বৃটেন-আমেরিকার সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার সাথে ব্যাপক ব্যাবধান সত্বেও বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ওবামার বক্তব্যগুলো সমভাবে বাস্তব। গত কয়েক বছরে আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে উঠেছে। তবে সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য, স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ বিঘিœত করার ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশী আলোচিত হয়েছে। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে হামলা, ২০১৬ সালে কুমিল্লার নাসির নগরে হিন্দু বাড়িঘরে হামলা, গত বছর(২০১৭) রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় অনৈতিক উস্কানী। তবে আমাদের দেশে চর্চিত অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। নতুন বছরের শুরুতে জাতীয় নেতৃত্ব আমাদের জন্য কোন আশার বাণী শোনাতে পারেননি। রাজনৈতিক সমঝোতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের ফর্মুলা এখনো সুদূর পরাহত। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার রিলে রেসকে নিজেদের একক কর্তৃত্ব ও কৃতিত্বের মনুমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পরস্পরকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থার পরিবর্তনে দেশের নতুন প্রজন্মকে আরো রাজনীতি সচেতন হতে হবে। সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে ভার্চুয়াল জগত ও বাস্তবতার মধ্যে একটি কার্যকর মিথস্ক্রিয়া ও মেলবন্ধন রচনা করতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com